নিস্তদ্ধ রাতের বর্ণমালা
~ আতিয়া মাহজাবিন
একদম ছুটতে ছুটতেই ট্রেন ধরলো জিয়াদ। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে । ট্রেনে উঠতেই একেবারে ভিজে গেছে ও । তাও শেষ মুহূর্তে এসে ট্রেনটা পাওয়ায় ভালো লাগছে । সিট খুঁজে নিয়ে বসে, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । কেমন যেন শীত শীত লাগছে ওর । এসি বার্থে সিট পেয়েছে ।
' ভাই যে ভিজে গিয়েছেন একেবারে !'
কারো কণ্ঠ পেয়ে ফিরে তাকালো জিয়াদ। বার্থে আরো একজন ব্যক্তি আছেন । লোকটা না বললে হয়তো কাপড় বদলানোর কথা মাথায় ও আসতো না এই চলন্ত মস্তিষ্কে । দ্রুত ওয়াসরুম থেকে কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে এলো । কিছুটা ফ্রেশ লাগছে এখন নিজেকে । তবে এসিটা কিছুটা কমানো দরকার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ও। বৃষ্টি ধোয়া রাতের আকাশ কেমন ধোয়াটে ! গাঢ় মেঘ জমে আছে নগরীর প্রান্ত জুড়ে । যেন যে কোনো সময় আবার ভিজিয়ে দিবে শহরটাকে । তবুও শহরে যান্ত্রিক ব্যস্ততায় ছুটছে সবাই যার যার গন্তব্যে । এটেন্ডেন্ট দরজায় নক করতেই এসিটা কমাতে বলল জিয়াদ। সাথে এক কাপ কফি ও অর্ডার করে বেশ স্বস্তি পেলো । আসলেই এই শীত শীত সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা কফি পেলে শরীরের সাথে মন ও চাঙ্গা হয়ে উঠবে । কফি আসতেই কফির মগ টা হাতে তুলে নিয়ে মনোনিবেশ করলো । ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের সাথে নিকোষ কালো রাতের আকাশ, আর সাথে ছুটে চলা জনপদের রং বদল - সব মিলিয়ে কেমন জমাট একটা আবহ । অন্য সময় হলে দারুণ ইনজয় করতো। কফি শেষ হতেই এবার চিন্তারা ঝাঁপিয়ে পরলো ওর মগজে । ঐ পার্সেলটা আসলে কারা পাঠালো? ঠিক কোন পক্ষ? ইদানিং অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছে ও । জটিল বিষয়গুলোর অন্ধকার উন্মোচন করতে ভালোই লাগে ওর । এখন কি মাদক চোরাচালানের উৎস খুঁজতে খুঁজতে উপর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় কারো আঁতে ঘা লাগল ? নাকি বাজারের মজুদদার সিন্ডিকেট! নাকি গুমের উপর রিসেন্ট রিপোর্টটা কারো ঘুম হারাম করল ? গুম নিয়ে রিপোর্ট লিখতে গিয়ে সমসাময়িক সব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটা বিষয় ওর কাছে ক্লিয়ার হয়েছে । শুধু নিজের দেশের স্বার্থে না , অন্য দেশের মন রক্ষার্থেও নাগরিক গুম করা হয়ে থাকে। আবার যুদ্ধাপরাধের বিষয়টিও কেমন প্রশ্নবিদ্ধ লাগে ওর কাছে ! এসব নিয়ে এতো গভীরভাবে ভাবার কারণে অবশ্য সম্পাদকের কাছে বকা খেয়েছে । ওকে অবশ্য ভালোই বাসেন প্রবীণ সম্পাদক মহোদয় । গুমের রিপোর্টটা নিয়েও কিছুটা খুঁত খুঁত করছিলেন তিনি । তবে, ওর তথ্যবহুল যৌক্তিক আলোচনা দেখে আর তেমন বাঁধা দেননি । এখন ঠিক কাদের লেজে পাড়া লাগলো , সেটা অনেক ভেবে ও বের করতে পারছে না । ভাবনাটা আরো গভীর হতো যদি ট্রেনটা না থামতো ! থেমে গেছে ট্রেন। কিছু যাত্রী গন্তব্য পেয়ে চলে যাচ্ছে , কেউ বা কোথাও যাওয়ার জন্য এক রকম যুদ্ধ করেই উঠে পরছে ট্রেনে । বার্থের দরজায় টোকা পড়লো । দরজা খুলতেই এক লম্বা চওড়া সুদর্শন ভদ্রলোক মাথা ঢুকিয়ে বললেন , 'আমার সিট ছিল এখানে ।'
' জ্বি, আসুন আসুন।'
জিয়াদ সরে দাঁড়ালো। ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে সিটে বসলো। জিয়াদ মনোযোগী দৃষ্টি দিল তার দিকে। অগোছালো চুল ,কুচকানো শার্টটাও অর্ধেক ইন করা, বাকি টুকু অবহেলায় ঝুলে আছে । সব মিলিয়ে লোকটাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে তার ।লোকটার সাথে ছোট ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই।
'বসো '
লোকটার কণ্ঠস্বর কানে আসতেই তড়িঘড়ি করে জিয়াদ উত্তর দেয় ,
- ' না মানে আমার সিট উপরে ।'
' আরে বসো তো । আমি ঘুমাব না। পরে উপরে যেও । আমার নাম মেজর তারিক ।'
হাত বাড়িয়ে দিলেন লোকটা । জিয়াদ ও হাত মিলিয়ে ধীরে ধীরে সীটের একপাশে বসলো। অবাক কণ্ঠে বলল,
' আপনি ঘুমাবেন না কেন ? রাতে ঘুমান না আপনি? '
ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো তারিক নামের ভদ্রলোক।
- ' না । রাতে আমি ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই অসহ্য যন্ত্রণা। তাই জেগে থাকি। রাতে কথা বলার মানুষ পেলে ভালোই লাগে আমার। রাত টা কি দীর্ঘ!'
জিয়াদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো - ' আপনি মেজর , আই মিন কোথায় আছেন ?'
উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন মেজর তারিক । কেমন বিদঘুটে লাগলো সে হাসি ! একসময় হাসি থামিয়ে সামনের সিটের দিকে তাকিয়ে বলল, ' সরি ! ওনার ঘুমে ডিস্টার্ব করা উচিত হবে না আমার। আচ্ছা , আস্তেই বলি । আমি র্যাবে ছিলাম। এখন অবসরে আছি ।'
তার চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে জিয়াদ বলল,
' কিন্তু , আপনার কি অবসরে যাওয়ার বয়স হয়েছে ? মনে তো হয় না !'
- "তুমি তো অনেক নজর রাখো দেখছি । কি করো তুমি?"
' জ্বি , আমি একজন নিউজ রিপোর্টার। '
- " তাই বলো । তোমার মতো মানুষকেই আমি খুঁজছি । আমি চাচ্ছিলাম এসব মানুষের নজরে আসুক । আর কত মানুষের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো যায় ?"
' মানে বুঝলাম না , স্যার?'
- " উহু, মোটেই স্যার বলবে না । আমার ভালো লাগে না । কিসের অভিশাপ বোঝো নাই? ও তুমি কীভাবে বুঝবে ? বুঝছি তো আমি । এই বয়সে কেন অবসরে গেলাম জিজ্ঞেস করছিলে । ওই যে আজ ২ টা বছর ঘুমাতে পারি না । ঘুমহীন ক্লান্ত মস্তিষ্ক নাকি কোনো কাজের না । আর্মির যোগ্য তো নয়ই । চরম অভিশপ্ত আমার জীবন! "
চোখ বড় বড় করে মেজরের কথা শুনছে জিয়াদ। থামলে বলল - ' ঠিক কবে থেকে ঘুমান না আপনি ?'
সিটে হেলান দিলেন ভদ্রলোক। বলতে শুরু করলেন-
" এসব হাতের কামাই । বুঝলে ? আমি ইচ্ছা করে কিছু করি নি । তবে আমাদের দিয়ে কি করানো হয় তোমার জেনে রাখা ভালো । কেউ আর মুখ খুলবে না তোমার কাছে । শোনো , ঘটনাটা তোমায় খুলেই বলি ।"
সাংবাদিক মন নিয়ে জিয়াদ ও ঘুমহীন চোখে শুনলো সাবেক মেজরের বক্তব্য।
- " মাঝে মাঝেই একে ওকে ধরে আনা হয় আমাদের অফিসে। যাদের দুনিয়াতে থাকার কোনো অধিকার নেই। বিশেষ করে বিরোধী দলের মেধাবী মুখগুলোর পা এ পাড়ায় বেশী পরে । একেক জনকে একেক কারণে ধরে আনা হয় । আবার নিপীড়নের পর হুমকি ধামকি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় গুটি কয়েক জনকে । তারা নেহায়তই ভাগ্যবান । আমার হাতেও অনেক গেছে । তখন কিছু মনে করি নি । একদিন এক মেধাবী ছাত্র নেতার দায়িত্ব পরে আমার উপর। ছেলেটার সুন্দর মায়াবী চেহারা আমার সৈনিক হৃদয়েও তোলপাড় করেছিল । কিন্তু বড্ড এক রোখা ছেলেটা । বার বার প্রশ্ন করছিল, কেন তাকে ধরে আনা হয়েছে। আমার ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় । কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেই । গালে হাত দিয়ে আলতো করে ছেলেটা বলেছিলো - 'সব তোলা থাকবে । একদিন এর মাশুল দিতে হবে আপনাদের। '
খুব তাড়াতাড়ি উপর থেকে অর্ডার আসে । এক রাতে মাঠে নিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করে আমার লোকেরা । এর আগে ছেলেটা নামাজ পড়ার অনুমতি চাচ্ছিলো। দেই নি । শেষ মুহূর্তে ছেলেটি জোড়ে জোড়ে কোরআন তিলাওয়াত করছিল। কিছুক্ষণ ছটফটানির পর শান্ত হয়ে যায় ওর দেহটা । আকাশের দিকে তাকানো ছিল ওর চোখ জোড়া, মুখে ছিল এক টুকরো হাসি । পরদিন পত্রিকায় আসে ক্রসফায়ারের সাজানো নাটক। সেই থেকে আমি ঘুমাতে পারি না । ঘুমালেই সেই ছেলেটা তার রক্তাক্ত দেহ আর চোখ নিয়ে তাড়া করে ।আহ ! কি বিভৎস হাসিতে টিটকিরি দেয় সে আমাকে ! "
চোখ বন্ধ করে ফেলেন মেজর তারিক । স্তম্ভিত জিয়াদ। মুখে ভাষা আসছে না ওর । রুম জুড়ে নিস্তদ্ধতা রাজ করলো ।
সকালে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে চলে গেলেন তিনি । ওখানে নিজের বাড়ি ।ওকে যেতে অফার করলেন বারবার । ব্যস্ততার কথা বলে দ্রুত বিদায় নিল জিয়াদ। জানালা দিয়ে মুগ্ধতা নিয়ে বাইরে তাকায় ও। সবুজ পাহাড় গুলোর ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ভোরের শিশু দিবাকর। কে বলবে একটু পরেই সকালকে দুপুর বানিয়ে যৌবনে পদার্পণ করবে ওটা ! ফজর পর সকালের নাস্তা মেজরের সাথেই করেছে সে । বিলটা তিনিই দিয়েছেন। বেচারার জন্য কেমন মায়া লাগছে জিয়াদের । এক সময়ের দাপুটে সেনা কর্মকর্তার কি নিদারুণ নিঃসঙ্গতা ! স্ত্রী সাথে থাকে না তার। এক ছেলেটার একসিডেন্টে মারা গিয়েছে । প্রকৃতির প্রতিশোধ ? নাকি জীবনের চলমান বাস্তবতা ? আর কতকাল তাকে এভাবে রাতের আকাশ দেখে মাশুল গুনতে হবে ?
সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ নাহিদ হাসান প্রধান
Copyright © 2024 Chirkute Sahitto. Powered by Chirkute Team.