নীরব পাখিদের দেশে হারিয়ে যাওয়া ভোর
লেখক: সাহিল বিন কামাল
যেখানে একদিন ভোর মানেই ছিল পাখির গান, সেখানে এখন সকালের অর্থ একটানা যান্ত্রিক শব্দ, অ্যালার্মের কর্কশতা আর জানালার কাচে ধুলোর স্তর। সেইসব দিন, যেসব দিন শুরু হতো দোয়েলের কুজন আর ঘুঘুর ধ্যানমগ্ন ডাক দিয়ে, তারা যেন কালের আবরণে ঢেকে গেছে। এখনকার শিশুরা আর চেনে না সেই মিষ্টি সকালের স্বরলিপি, জানে না ঘুম ভাঙার প্রকৃতির ছন্দ কতটা নরম, কতটা স্নিগ্ধ। আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেই সকালের ঠিকানা—যেখানে সূর্যের আগমন হত পাখির সুরে সুর মিলিয়ে, গাছের ডালে ডালে নৃত্য করত বাতাসের সঙ্গে প্রকৃতির সঙ্গীতজ্ঞেরা।
ভোরবেলার পাখির ডাক কেবল একটুখানি শব্দ ছিল না, ছিল একধরনের ডাক—জেগে ওঠার, ভাবনায় ফেরার, প্রকৃতিকে অনুভব করার আহ্বান। আমাদের পূর্বপুরুষেরা দিনের সূচনা করতেন এই ডাক শুনেই। সে এক আলাদা ধারা, যার মধ্যে ছিল শুদ্ধতা, ছিল ছন্দ, ছিল প্রাণ। মা ভোরে উঠেই উঠানে পানি দিতেন, রান্নাঘরে আগুন জ্বলত, আর দালানের পাশের গাছ থেকে পাখিরা জানাতো, “সকাল হয়েছে, মানুষ জাগো!” এখন সে ডাক নেই। সকালে ঘুম ভাঙে মোবাইলের নোটিফিকেশনে, গাছের বদলে জানালায় লোহা, পাখির বদলে কেবল ইট-বালুর নীরবতা।
এই নিস্তব্ধতা আসেনি হঠাৎ। এসেছে মানুষের ইচ্ছাকৃত অন্ধতায়। একের পর এক গাছ কাটা হয়েছে, শহরের আকাশ থেকে আকাশচুম্বী ভবন গজিয়েছে, নদী ভরাট, জলাভূমি ধ্বংস, এবং প্রকৃতির সব আশ্রয়স্থল মুছে ফেলা হয়েছে নির্বিকার ভাবে। ফলে পাখিরা পিছু হটেছে। তাদের গান থেমে গেছে। এখন কোনো সকালে দোয়েলের গান শোনা যায় না, শালিকদের দল দেখা যায় না, এমনকি চড়ুইয়েরাও যেন নির্বাসনে। শিশুরা আজও পাখি চেনে, তবে বইয়ের পাতায়, ইউটিউবের ভিডিওতে—বাস্তব জীবনের কোনো ছোঁয়া তারা পায় না।
পাখি মানে শুধু কিচিরমিচির করা প্রাণী নয়। পাখি মানে প্রকৃতির এক অনন্য ভারসাম্য। তারা কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশকে সজীব রাখে, পরাগ ছড়িয়ে দেয়, মৃত প্রাণী খেয়ে দূষণ কমায়। তারা প্রকৃতির এমন এক অংশ, যার অনুপস্থিতি কেবল নৈঃশব্দ্য নয়, বরং একটি পরিবেশগত সংকেত। পাখির হারিয়ে যাওয়া মানে প্রকৃতির ভারসাম্যের ক্ষয়, একটি বিপন্ন ভবিষ্যতের পূর্বাভাস।
এখনো যদি আমরা না জাগি, তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে নিঃসঙ্গ, একঘেয়ে, অনুভূতিহীন। পাখির গান না থাকলে সকালে জেগে ওঠা হবে নিছক সময়ের বাধ্যবাধকতা, কোনো সৌন্দর্য থাকবে না তাতে। মানুষের অনুভূতি যেমন পাথর হয়ে যায় ধীরে ধীরে, তেমনি এই নিঃসঙ্গ ভোরগুলো আমাদের মনের প্রান্তরেও ফেলছে খরা। শিশুদের শৈশব একরকম সুরহীন হয়ে যাচ্ছে। তারা জানে না সকালের গান কেমন, জানে না একটি ঘুঘুর ডাকে কতটা কোমলতা থাকে, জানে না গাছের ডালে একসাথে বসা পাখিদের দোলা কতটা শান্তিদায়ী।
সমস্যার গভীরে গেলে দেখা যাবে, এই সংকট কেবল পাখির নয়, আমাদের অস্তিত্বেরও। যখন পাখি হারিয়ে যায়, প্রকৃতি নীরব হয়ে পড়ে, তখন মানুষও তার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন আমরা হারিয়ে ফেলি সৌন্দর্য বোধ, কোমলতা, আর সবচেয়ে বড় কথা—জীবনের ছন্দ। একসময় পৃথিবী কেবল মানুষের শহর হয়ে যাবে, যেখানে থাকবে প্রযুক্তি, কিন্তু থাকবে না প্রাণের সুর।
তবুও সব শেষ হয়ে যায়নি। আমরা চাইলে সেই হারানো ভোরকে ফিরিয়ে আনতে পারি। শুধু দরকার একটু সচেতনতা, একটু ভালোবাসা। চাইলে গাছ লাগাতে পারি, শব্দদূষণ কমাতে পারি, খোলা আকাশ ফিরিয়ে দিতে পারি পাখিদের। চাইলে একটা জানালায় বসা পাখিকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি নতুন করে। তাদের খাবার রাখতে পারি, বাসা বাঁধার জায়গা করে দিতে পারি। চাইলে শিশুকে শেখাতে পারি—একটা পাখির ডাক মানে কি, তার সুরে কী বার্তা।
প্রকৃতি কখনোই প্রতিশোধপরায়ণ নয়। বরং আমরা তাকে একটু ভালোবাসা দিলে, সে ফিরে আসে আরও সুন্দর হয়ে। পাখিরা অভিমান করে গেছে, কিন্তু তারা অপেক্ষায় আছে—একটা সুরময় সকাল ফিরিয়ে আনার। তারা চায় আবার গাইতে, চায় আবার আমাদের ঘুম ভাঙাতে। আমাদের দরকার শুধু সেই কানে শোনা, হৃদয়ে রাখা ক্ষমতা। যেন একদিন আবার সকাল হবে পাখির গানে, জানালার পাশে কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙবে, আর আমরা বলব—এই তো সেই হারিয়ে যাওয়া ভোর ফিরে এসেছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ নাহিদ হাসান প্রধান
Copyright © 2024 Chirkute Sahitto. Powered by Chirkute Team.