বর্ষার জলছবি
দীপঙ্কর বেরা
বর্ষা মানেই বৃষ্টি। আর বৃষ্টি মানেই বর্ষা। বর্ষার সঙ্গে আমার সখ্যতা নেই তবে বৃষ্টির সঙ্গে আছে।
খুব ঝমঝমিয়ে যখন বৃষ্টি নামে ভিজতে খুব ভাল লাগে। খোলা আকাশের নিচে কেমন শন শন শব্দ করে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এঁকেবেঁকে বৃষ্টি পড়ছে। আর আমি একা। কোথাও কোন জনপ্রাণী নেই। সবাই ঘরে না হয় কোন ছাদের নিচে আশ্রয় নিয়েছে।
রান্না হয়ে গেছে, ঠিক স্নান করব করব, দুপুরের গা জ্বালানো গরমে হাঁসফাঁস এমন সময় আকাশ কালো করে একটু ঝোড়ো হওয়ার সাথে ঝেঁপে এল বৃষ্টি। ব্যাস, আমিও হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভিজতে। কি ভাল লাগে?
এর সঙ্গে দু তিনটে ব্যাপার খুব গোলমাল বাঁধিয়ে দেয়। কি বলব? বাইরে বেরিয়ে যদি দেখি বিটকেল বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে এল বটে কিন্তু হল না। হল রিমঝিম রিমঝিম। গা টা ভিজবে কি ভিজবে না করছে। ওই বর্ষাকালে যেমন হয় আর কি? কিন্তু আমার কি হল? বাড়ির যে ক'টা লোক আমাকে দেখছিল তারাও হাসাহাসি করতে লাগল। কি খুব শখ হয়েছে ভেজার? এখন ভেজো। প্রেস্টিজ পাংচার। আমিও ছাড়বার পাত্র নয়। আকাশের দিকে বার বার তাকাচ্ছি। আয় না, আয় না ভাই বৃষ্টি। আসে না তো আসেই না। গুঁড়ি গুঁড়ি ঝিরঝির। গা টা ভিজতেই চাইছে না। শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথে ঘরে এসে যেই বাথরুমে ঢুকেছি এসে গেল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আচ্ছা বলুন তো, কি রাগটাই না হয়? কিন্তু কিছু করার নেই। বর্ষার বৃষ্টি বলে কথা।
তারপর ধরুন খুব জোরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ভিজছি আর সঙ্গে সঙ্গে ধড়াম করে চড়াম করে কাছেই পড়ল বাজ। ব্যাস হয়ে গেল বৃষ্টিতে ভেজা। সব মাটি। বাড়ির লোক উপর থেকে চেঁচাচ্ছে। চলে আয় বলছি , চলে আয়। বৃষ্টির ঝাপটায় আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার বুক ধড়াস ধড়াস করে উঠছে। বাপরে! কি বিদ্যুৎ! অনেক হয়েছে। চলো ভাই। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে চল।বৃষ্টি ও বর্ষার এবং ভিজতে থাকা বর্ষার আমেজে এই এক সব থেকে বড় বিড়ম্বনা।
এই বিড়ম্বনার জন্য এখন আর বৃষ্টিতে ভিজতে পাই না। গাছ কমে যাওয়ার জন্য নাকি পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য নাকি আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য বৃষ্টির হওয়ার আগে মেঘ ডাকতে শুরু করে আর বজ্রপাত শুরু হয়ে যায়।
সেই ছোট্টবেলায় বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে করতে এই রকম ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এসে যায়। মা বলেছিল মনে হয় বৃষ্টি আসবে মেঘ কালো হয়ে আসছে। চলো বাড়ি ফিরে যাই। বাবা বলেছিল - এই তো এইটুকু কাজ বাকী রেখে যাব। শেষ করেই যাচ্ছি। বৃষ্টি আসবে না। তারপর বৃষ্টিতে আমরা মাঠ থেকে দৌড়ে ফিরছি অনেকের মত। মাঠের ধারে এসে বড় বাঁধের ধারে বাবা মার মাঝখানে আমি। মা আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে আমার মাথা। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। জল জমছে পায়ের তলায়। বজ্রপাতও হচ্ছে অল্প অল্প।
তারপর বৃষ্টি থেমে যেতে মায়ের হাত ধরে কাদা রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি ফিরছি। চারিদিক কেমন ধোয়া ধোয়া জীবন। ঘর বাড়ি গাছপালা মাঠ ঘাট খাল বিল। ধুলোবালি ময়লা আবর্জনা সব ধুয়ে মুছে একসা। পৃথিবী যেন নোংরা মুক্ত।
এখন ড্রেন ভর্তি ময়লা উপচে মাঠ ঘাট রাস্তা বাড়ির চারপাশ ভরে যাচ্ছে। বাড়ি ঘর গাছপালা সব কিছু যেমন ধোয়া ধোয়া মনে হয় তেমনি পৃথিবী যেন জঞ্জালে একসা।
যাক গে সে সব কথা। বর্ষার আগমনের কথা যখন আবহাওয়া দপ্তর বলে তখন বৃষ্টি আসবে জেনে আজকাল আর তেমন খুশি খুশি মনে হয় অথবা হয় না। বৃষ্টিতে ভিজতে পারব কি পারব না? দুপুরবেলা সেই বৃষ্টি আসবে কি আসবে না? চারিদিকে এত বাড়ি ঘরদোর সেই হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরে নিচে নামতে পারি না বয়স বাড়ছে। যদিও আমি তা মনে করি না। মনে করে বাড়ির লোক। কেন না অসুখ করলে কষ্টটা তাদেরকে পোয়াতে হয়।
তবু আজকাল অফিস থেকে ফেরার পথে যদি বৃষ্টি এসে যায় তখন আর সেই সুযোগ নষ্ট করি না। বাড়ির লোক জিজ্ঞেস করলে বলি, ছাতা নিয়ে যেতে ভুলে গেছি।
কিন্তু ছাতা যদি ব্যাগ থেকে খুঁজে পায় তো বলি, এমা! আমি ভেবেছি ছাতা নেই। কিংবা ঘরের ঢোকার একটু আগে ছাতা খুলে সেই ছাতা থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলি, ছাতা মাথায় দিয়েও আটকাতে পারলাম না। ভিজে গেলাম।
অন্য সবাই এটা ওটা বলতে থাকে। কিন্তু বাথরুমে টাওয়াল দিতে দিতে উনি একটু মুচকি হেসে বলেন - তোমার ভীমরতি আমি বুঝি না মনে করেছো?
আহা! আসুক বৃষ্টি! আসুক বর্ষা! আসুক না অসুখ বিসুখ! থোড়াই কেয়ার করি? এর জন্যই বেঁচে থাকি আমি হাজার হাজার জীবনের জলছবি।
সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ নাহিদ হাসান প্রধান
Copyright © 2024 Chirkute Sahitto. Powered by Chirkute Team.