শাহানশাহ
আতিয়া মাহজাবিন
পূর্ব দিগন্তের কপালে যখন ভোরের প্রথম শিরা স্পন্দিত,
নীল আসমানের তসবিহ দানায় জ্বলে ওঠে অদৃশ্য স্মরণারত নূর,
হাওয়ার অদেখা কাঁধে কে রাখে স্নিগ্ধ হাত?
কিসের স্ফুলিঙ্গে নদী শিখে নেয় শান্তির ভাষা?
কে সেই অদেখা কারিগর, যিনি জাহেলিয়াতের কালিকায় এঁকেছেন মেহেদি রঙা শুভ্র প্রভাত?
হে রহমার বার্তাবাহক! এক বিহঙ্গ আসে,
ডানায় তার ঝুলে আছে উষার কোরাস,
চোখে তার কোরআনের অক্ষর তরী;
উড়ে এসে বলে যায়, যেখানে জাগে আপনার স্মৃতি,
সেখানে কষ্টের ক্ষরিত লবণও হয়ে ওঠে মিষ্ট!
কাঁপে ধুরন্ধর মরু, কাঁপে চির শুষ্ক গিরি,
ঘুমভাঙা ধূলোয় নড়ে ওঠে শতাব্দীর গোপন পাপড়ি;
দিগন্ত জুড়ে প্রশ্ন, আজও কি দেখা যাবে আলোর প্রবাহ?
বুকের গভীর অন্ধকূপে কে জ্বালাবে তবে দিদারের কেরোসিন চেরা জ্যোতি?
হে প্রিয়তম ﷺ!
এসেছিলেন বলেই ভাষা পেয়েছে দয়া, শ্বাস পেয়েছে সরলতা।
আপনি ব্যতীত তবে কিসে ভিজতো অনাথের কপাল?
কে শেখাতো বণিককে সত্যের লাভ ক্ষতির হিসাব?
কে মুছিয়ে দিতো দাসের গলায় বালির দড়ি?
জাহিলিয়্যাত!
আহত রাতের গায়ে তা তো ছিল কদর্য হাসির থুতু,
বালির নিচে কবর হতো সদ্যজাগা মেয়ে শিশুর নিঃশ্বাস !
সীসার গ্লাসে মাতাল হতো বিবেক,
পুতুলের বুকে শিকল পরিয়ে কাবার দিকে ঠোকাঠুকি,
আর, মানুষ নামের বহুত্ববাদী পশুতা।
হে আলোক প্রেরিত! আপনার স্মৃতিরা আজও কেঁপে ওঠে,
যেন তা আবাবীলের পাথরে ভাঙা অহংকারের ছাই।
শৈশবের ছায়া!
পিতৃহীন মাতৃহীন সেই নীরব বটপাতা চোখ,
ধুলোর রথে বয়ে চলা কাফেলা,
সিরিয়ার বাণিজ্যে নীল আকাশের নিচে “আল-আমিন” নামের নিশ্চয়তা।
আপনার হাসিতে তো মরু শিখতো আর্দ্রতা,
আর আপনার হাতে খেজুরের গুছি বদলে যেতো দয়ার তসবিহে।
তারপর হেরা?
নিঃসঙ্গ গুহা, পাথরের ঠাণ্ডা কপাল,
দীর্ঘ নিঃশ্বাসে তসবিহ গোনা তারকাসংখ্যা।
মরুর দারিদ্র্যে সমৃদ্ধ একাগ্রতা,
চোখের ভিতর চোখ রেখে আপনি খুঁজতে গিয়েছিলেন পরম একত্ব,
শব্দহীন আয়াতের আগুন।
তারপর,
অকস্মাৎ দিশাহীনতা, আলিঙ্গনের বজ্র,
সমস্ত সৃষ্টির বুক বরাবর উচ্চারণ ছিল “পড়ো!”
পড়ে উঠেছিল আসমান, পড়ে উঠেছিল ধুলোকণাও!
আপনার কণ্ঠে ঝড়, আপনার বুকের সেই নাম রবের।
সাফার ঢালে দাঁড়িয়ে ডেকেছিলেন সত্য,
ব্যালকনির বারান্দা থেকে তুষার ধ্বসে পড়ার মতো
মূর্তিগুলো আত্মসমর্পণ করতো সেই জোয়ারের আগে পিছে।
গলির অন্ধকারে জেগে উঠতো বিদ্বেষের কাটাচামচ;
পাহাড়ের ছায়ায় আপনার পায়ের সেই বসন্ত জখম,
তাইফের রাস্তায় রক্ত দোয়া হয়ে ঝরেছিলেন আপনি,
তবু করুণার হাত ছাড়েননি।
সেদিনই আকাশ শুনেছিল ক্ষমার উষ্ণতা।
এক রাতে তো......
দিগন্ত জুড়ে তামার তারে বেজে উঠেছিল সরাসরি আহ্বান,
বোরাকে চেপে সময়ের সেই উর্ধ্ব সোপান,
সিদরাতুল মুনতাহা!
ব্যাপ্ত ব্যাখ্যার ওপরে যে নীরবতা,
আপনি সেখানে রেখে এলেন উম্মতের জন্য নিবিড় সেলাই করা উপশম সালাত।
হিজরাহ!
অনিশ্চিত গুহায় মাকড়সা বুনে দিয়েছিল নিশ্চিন্ততার পর্দা,
ঘুমন্ত শিরায় সাহস ঢেলে দিয়েছিলেন আপনি সাথীর বুকে।
মদিনা!
খেজুরবাগানের পাতায় বজ্র স্নেহ,
আনাসের হৃদয়ে বাসা বাঁধা সাদা কবুতর শান্তির।
এক মসজিদের মেঝেতে যে ধূলি পড়েছিল প্রথম সিজদায়!
আজও তা সুবাসিত আযানের ধ্বনিতে।
বদর!
মেঘের কিনারায় ফেরেশতা সৈন্যের নীরব গতি;
উহুদ!
দুঃখের পাহাড়ে সেলাই করা অধ্যবসায়;
খন্দক!
দূরদর্শিতার মাটি কাটে কুয়াশায়;
হুদাইবিয়া!
ধৈর্যের কালি দিয়ে লেখা বিজয়ের প্রস্তাবনা।
ফতহে মক্কা?
চুন সাদা ক্ষমার হাতে ভেঙে পড়েছিল কালো পাথর অহংকার;
সিজদাহয় নুইয়ে যাওয়া শিরে,
উঁচু হয়েছিল মানবতার কপাল।
এদিকে ঘরের ভিতর
নিজের জুতো নিজেই সেলাই,
চালার ধারে কাঁধে তুলে আনতে ইট!
রাজদরবার থেকে দূরে, নিঃশব্দ মহিমা;
রাত্রির ক্ষুধা আপনি লুকাননি দোয়ার নিবিড়তায়,
অন্নের অনুপস্থিতিতে তো জ্বলেছে প্রেমের চেরাগ।
সিদ্দিকের বুকে পেয়ালা নিশ্চয়তা,
ফারূকের চোখে আইন উজ্জ্বল সুবিচার,
জুনায়ের ধারে উসমানের লজ্জা রঙা উদারতা,
আলির হাতে তলোয়ারে ন্যায়ের নীল নক্ষত্র।
খালিদ তারেকের পতাকা তো বাতাসে কোরআনের ব্যাকরণ,
বিলালের স্বরের আজানে কেঁপে উঠতো সন্ধ্যার শিরদাঁড়া।
শতাব্দী গড়িয়ে
জিলানি, চিশতি, নকশবন্দের চোখে অশ্রুর কালি,
মুজাদ্দিদের নিশান,
নূর স্রোত নেমে আসে গলি থেকে গহ্বরে।
তবু পৃথিবী?
আজও বুকে বহে বারুদের গন্ধ,
অশ্রুতে রাফাহ, যন্ত্রণায় কুদস,
সমুদ্রের মুখে তার জাল ছুঁড়ে দেয় অশালীন আধিপত্য।
হে নূরের নবী ﷺ,
আজ যে বুকে কান পাতলে আমরা শুনি
মানুষের আর্তি মিশ্রিত একি মাদানী তরঙ্গ;
তবু আমরা পথ হারাই, শ্লথ হয় দরূদের শ্বাস,
অজুহাতে ছোট হয়ে যায় ভালোবাসা,
এই লজ্জায় নিস্তব্ধ নীহারিকা!
সবুজ গম্বুজের ছায়া,
অশ্রুতে রঞ্জিত মাটির ওপর আমি মাথা রেখে
শুনতে চাই আপনার কদম চিহ্নের নরম কড়মড়,
আরশি কাঁচে প্রতিফলিত করুণা,
রওজার পাশে সুঁইয়ের ফোঁড়ের মতো নিবিড় শান্তি।
হে রহমাতুল্লিল আলামীন!
আমার বুকের ভিতর যে গোপন তাপ,
তার আখেরি নাম হচ্ছে আপনার স্মরণ;
আমার নিঃশ্বাসে যে লবণ ঝর্ণা,
তার একমাত্র সুর যে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!
বলতে দিন!
আপনি না হলে আমার অন্তরের কৃষ্ণ গহ্বর
কখনো শিখতো না ভোরের ব্যাকরণ;
আপনি না হলে শব্দরূপ দিত না ক্ষমা,
দাঁড়াত না ন্যায় বিচারকের মতো সোজা।
আমি তাই প্রতিটি সেকেন্ডের কবুলি দেবো,
কণ্ঠে দরূদ, কপালে সিজদা, ক্বলবে মাদিনাহ!
কে বললো প্রেম কেবল কাব্যের অলঙ্কার?
আপনার নাম উচ্চারণে
পাথরও শিখে নেয় মলিনতার প্রতি ঔদার্য,
ঝড়ও থেমে যায় শিশিরের শিষ্টাচারে।
আমার রক্তের প্রতিটি কণায় আজান বাজে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”,
আঁধারের পর্বত ভেঙে পথ করে দেয় এক সারি আলো।
হে প্রিয়তম ﷺ,
আমার তৃষ্ণার নাম যদি হয় “দিদার”,
আমার তীর্থের মানচিত্র “রওজা”;
আমার পাথেয় আপনার সুন্নাহ,
আমার আবাস আপনার দয়ার ছায়া।
আমি পথের ধূলি হতে রাজি!
শুধু আপনার পদযুগলের নিচে
এক মুহূর্তের জন্য হলেও
চূর্ণ হয়ে উঠুক অহংকারের নীল কাচ!
আপনি যেখানে,
সেখানে অনাথের কপাল উজ্জ্বল,
সেখানে বিধবার হাঁসিতে দোয়া,
সেখানে দাস মুক্ত, বাজার ন্যায়ের,
সেখানে শাসক নম্র, জ্ঞানী বিনয়ী,
সেখানে শিশুরা বালির নিচে নয়,
জুঁই চামেলির বাগানে বড় হয়!
এই যে কারবালার বেদনাও
আপনার দুর্দম সত্যেরই ধারাবাহিক শিক্ষা!
অন্যায়ের সামনে মাথা নোয়ানো যাবে না,
তবেই লুপ্ত হবে না প্রেমের ঋজুতা।
এই যে দুনিয়ার বড় বড় আকর্ষণ,
তারাও শেষ পর্যন্ত খোঁজে আপনার সুন্নাহর ঘাট;
কারণ সেখানে তো বাঁধা থাকে শান্তির জোয়ার।
আমার ভিতর যে অন্ধ হরিণ,
সে আপনার নাম শুনলেই পানির কাছে ছুটে যায়;
আমার ভিতর যে ক্লান্ত সারস,
সে আপনার দরূদে ডানা মেলে উচ্চে উড়ে,
শহরের ওপর, ঢেউয়ের ওপর, ব্যর্থতার ওপর।
আপনি আছেন বলেই আক্ষেপ শেখে আলোর ব্যাকরণ;
সুন্নাহ আছে বলেই মৃত্যু শেখে নবজন্মের নাম।
তাই আমি বলি!
হে মানবতার শাহানশাহ, হে নূরের বাদশাহ,
আপনার ইশক্ব ছাড়া আমার কালে কুসুম ফোটে না;
আমার কপাল আপনার সহবতের ধূলি চায়,
আমার চাহনি আপনার ছায়ায় শান্তি চায়,
আমার কাজ আপনার পথের কাঁধের বোঝা চায়।
শেষে?
সবুজ গম্বুজের নিচে নিভে যাক ক্রোধের প্রদীপ,
জ্বলে উঠুক কাওসারের ধারা,
শুকনো মরুতে প্রেমের বীজ বুনি,
দরূদের জলের সিঞ্চনে পেকে যাক সুবাসিত দিন!
আমার রাত দিন, রুটির ফাঁকে,
দুঃখের রন্ধ্রে, হাসির উপকূলে,
একই ধ্বনি, একই সালাম,
সালাম, হে রাসূলুল্লাহ ﷺ!
আমাদের নিঃশ্বাসের রেশে, আমাদের কপালের ইবাদতে,
আমাদের সন্তানের নামের উচ্চারণে,
আমাদের ক্ষুধার ধৈর্যে, আমাদের প্রাচুর্যের নম্রতায়,
সালামুন আলাইকা, ইয়া নূরাল আলমীন!
সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ নাহিদ হাসান প্রধান
Copyright © 2024 Chirkute Sahitto. Powered by Chirkute Team.