আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ কলমে সুমি আক্তার

আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ

আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ
~ সুমি আক্তার

 

ঈদের ছুটিতে এবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হবে। দাদাজান অনেক অসুস্থ, তাই ওনার ইচ্ছেতে এবার আব্বু ও চাচ্চুরা সবাই একসাথে কোরবানি দেবেন। ঈদে গ্রামে যাবো শুনে আমি তো অনেক খুশি। খুব ছোটবেলায় গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রাম আমার ভীষণ ভালো লাগে। কী সুন্দর সবুজ শ্যামল প্রকৃতি!
ঘরের পেছনে পুকুর, পুকুরের পাড়ে আমগাছ। পথের দু’পাশে সারি সারি তালগাছ, নারকেলগাছ—ঠিক যেন ছবির মতো গ্রামবাংলা।

গ্রামে যাওয়ার জন্য পুরোদমে তোড়জোড় চলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ঈদের আগে কোনো ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়নি। ঈদের দিন রাতের টিকিট পেয়েছি—মানে ঈদের দিনটা শহরেই থাকতে হবে। আব্বু ফোন দিয়ে বড়চাচ্চুকে জানালেন, তখন চাচ্চু বললো, “টিকিট যহন পাস নাই কি করবি, তাইলে রাইতেই আয়।”

আমরা ঈদের পরের দিন ভোরে গ্রামে পৌঁছালাম। আব্বুদের গ্রামটা একদম অজপাড়াগাঁ। দূরে মসজিদে আজান শোনা গেলো। পুকুরঘাটে অজু সেরে নামাজ পড়ে নিলাম। রাতভর জেগে থাকায় চোখে ঘুম নেমে এল। বড়চাচি আমাকে এক ঘরে নিয়ে গিয়ে শুতে বললেন। ঘুম ভাঙল ছোট ছোট বাচ্চাদের কোলাহলে। ওরা আমার বড়চাচ্চু আর মেঝো ফুফুর মেয়েরা—রূপা, রিমু, হিমু আর আয়েশা। সঙ্গে এসেছে পাশের বাড়ির মিষ্টি চেহারার মিম—আরিফ চাচার মেয়ে। বাচ্চাদের পেলে আমিও যেন বাচ্চা হয়ে যাই, ওদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠলাম।

এমন সময় আম্মুর ডাক পড়লো। রসুইঘরে গেলাম—বড়চাচি পিঠা বানাচ্ছেন। ওনার পাশেই চাচির বয়সি আরেকজন মহিলা, চোখে পানি টলমল করছে আর চাচির সাথে কি নিয়ে যেনো কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে থেমে গেলেন। আমি ওনাকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “আরে বাহ, সাদিক ভাইয়ের মেয়েটা তো বড় হয়ে গেছে।” আমি একটু লজ্জা পেলাম। তিনি হেসে উঠলেন; ওনার হাসি দেখে আমিও মুচকি হাসলাম। তাঁকে হাসতে দেখে ভাবলাম, কী সহজে মানুষ কান্না লুকিয়ে হাসতে পারে। সত্যিই, রব মানুষকে কষ্ট লুকিয়ে হাসার এক অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছেন।

আরো পড়ুনঃ  নাঈম ইসলাম বাঙালির ছোট্ট গল্প শালিক পাখি

চাচি পিঠা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই কি পিঠা ঘরে নিয়া যাবি, না এহানেই বইয়া খাবি?” আমি ভাবলাম, আমি থাকলে অপরিচিত চাচি হয়তো অপ্রস্তুত হবেন। তাই পিঠা নিয়ে ঘরে এলাম। ঠিক তখনই শুনলাম তিনি বলছেন, “না ভাবি, ছোড মাইয়াডা পিঠা খাওনের লাইগা কানছে—ওর লাইগা এই পিঠাডা লইয়া যামু।” বুঝলাম, নিজের জন্য পিঠা না খেয়ে মেয়ের জন্য নিয়ে যাবেন। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ইচ্ছে করছিল, সব পিঠা ওনাকে দিয়ে দিই—তবু তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বড়চাচির হাতে চুপিচুপি বাকি পিঠা দিয়ে বললাম, “ওনাকে দিও।”

সকালের নাস্তার পর্ব শেষ। বাড়ির মহিলারা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত আর আমি ছোটদের সাথে খেলতে ব্যস্ত।
বিকেলবেলা বড়চাচি আমার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। আমি তেল দিই না মাথায়—এই কথাটা আম্মু চাচিকে বলে দিয়েছেন। আর চাচিও এখন জোর করে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন ভালোই লাগছে।

এর মধ্যেই সকালের ওই অপরিচিত মহিলার কথা মনে পড়লো। চাচিকে জিজ্ঞেস করলাম, “চাচি, সকালের ওই মহিলা কে ছিলেন?”
চাচি বললেন, “পাশের বাড়ির তোর আরিফ চাচার বউ। মিমের মা।”

তখন আমার মনে পড়লো সকালের সেই মিষ্টি মেয়েটার কথা। তার মানে উনি মিমের আম্মু। ওনার কান্না করার কারণ জানার জন্য আরও আগ্রহ হলো।
চাচিকে বললাম, “আচ্ছা চাচি, উনি কান্না করছিলেন কেন তখন?”
চাচি বললেন, “বুজানের বড় পোলার লাইগা।”
আমি বললাম, “কেন? ওনার বড় ছেলে কি মারা গেছে?”

চাচি উত্তরে বললেন, “না। শোন তাইলে—আরিফ ভাইয়ের ৪ মাইয়া আর এক পোলা। পোলার নাম রাকিব। পোলাডা সবার বড়। ছোটবেলা থেইকা পোলাডা পড়ালেহায় অনেক ভালা। হের লগের বন্ধুবান্ধব তো হের নাম দিছিলো ‘বিদ্যাসাগর’। স্যারেরাও হের অনেক প্রশংসা করতো। মেট্টিকে গোল্ডেন এ প্লাস পাইছে। আরিফ ভাই তো পুরা গ্রামের মাইষেরে মিষ্টি খাওয়াইছে। রাকিব ঢাহা ভার্সিটি পড়তো চাইছে। বাপেও আর না করে নাই। একটা মাত্র পোলা। পোলাডা মানুষ হইলেই তো মাইয়াগুনের একটা ব্যাবস্থা অইবো। পোলায় বড় অফিসার অইবো। তহন আর হেগো কোনো দুঃখ থাকতো না—এই আশায় পোলারে ঢাহা পাডাইছে। টেহার মিল অয় নাই দেইখ্যা গোয়ালের গরুডাও বেইচা দিছে।

আরো পড়ুনঃ  বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক গল্প | বাবার টর্চ কলমে সাজেদা সুলতানা কলি 

প্রথম বছর ভালোই আছিলো। পোলায় ঢাহা ভার্সিটি ভালা একটা সবজেট্টে চান্স পাইছে। অনেক টিউশনিও করাইতো। নিজের খরচ চালাইয়া বাপ মা’রে ও মাইঝে মইদ্দে টেহা দিতো। কিন্তু ৫–৬ মাস আগে একবার গ্রামো আইছে—হেয় নাকি নিজেরে মাইয়া মনো করে। মাইয়াগো মতো চোকো কাজল দেয়, মাইয়াগো থ্রিপিছ পিন্দে। গ্রামের আমরা সবে তো অবাক অইয়া গেছি। আরিফ ভাই ভাবছে পোলাডারে মনে হয় জিন পরিয়ে ধরছে। ওনি কবিরাজের কাছেও গেছে। কবিরাজ বেডাও মিথ্যুক। কবিরাজে কয়, আম্নের পোলারে ৩ ডা পরীর পছন্দ অইছে। তেনারা আম্নের পোলারে লইয়া যাইতে চায়। এমন কয়্যা অনেকগুলা টাকা নিছে। প্রথমেই তোর চাচা কয়ছিলো কবিরাজ-টবিরাজ বিশ্বাস না করার লাইগা। হেরা তোর চাচার কথা হুনে নাই। কয় এই কবিরাজ নাকি অনেক ভালা। পরে গ্রামের সবাই বুদ্ধি দিছে রাকিব রে আর ঢাহা যাইতে দিয়েন না। আরিফ ভাইও যাইতে দিতে চায় নাই, কিন্তু পোলাডা বাপ মার কথা হুনে নাই। ঘরের জিনিসপত্তর ভাইঙ্গা চুইরা জোর কইরা ঢাহা গেছে। অহন এইবার ঈদে বাড়িত আইতে চায় নাই। মা’য় কাইন্দা কাইট্টা আনাইছে। ঈদের ২ দিন আগে গ্রামে আইছে। কিন্তু ঈদের দিন কয়, কোরবানির নামে আমরা বোলে পশুহত্যা করি। আল্লাহ কয়্যা বোলে কিচ্ছু নাই (নাউজুবিল্লাহ)। অথচ এই রাকিব পোলাডা ছোড থাকতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। কী সুন্দর কণ্ঠে কোরআন পড়তো। এডি দেইখ্যা মাইঝা মাইয়াডারে বিয়া দিতে পারতাছে না। বিয়ার বন্দোবস্ত করওনের টেহা নাই। আরিফ ভাইও বয়সের ভাড়ে ভারী কাজকাম করতো পারে না। এর লাইগাই হের মায় কানছে সহালে।”

ততক্ষণে আসরের আজান শোনা গেলো। সবাই নামাজ পড়তে চলে গেলাম। কিন্তু চাচির মুখে শোনা ঘটনায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। আরিফ চাচা আর চাচির কথা মনে পড়লো। এমন হয়তো অনেক বাবা-মা নিজের সব সম্বল দিয়ে ছেলেকে অনেক বড় শিক্ষিত, বড় অফিসার কিংবা সরকারি চাকরি করার জন্য শহরে পাঠান। কিন্তু উচ্চশিক্ষার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে ওরা হয়ে ওঠে নাস্তিক ও সমকামী কিংবা ট্রান্সজেন্ডার—সবাই যে এরকম হয়, এমনটা নয়।

আরো পড়ুনঃ  বাবা হারানোর কষ্ট | আব্বু তুমি ফিরে এসো

কিন্তু গ্রামের ওই সহজ-সরল অশিক্ষিত বাবা ট্রান্সজেন্ডারের সংজ্ঞা জানেন না। তারা শুধু বোঝেন—প্রিয় ছেলে আর আগের মতো নেই। এই অজানা পথ তাদের ভয় দেখায়।

এটা সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির আশীর্বাদ, না অভিশাপ—আমার বুঝে আসে না। যার কারণে আজকাল মানুষ তাদের ধর্ম ও নৈতিকতা ভুলে হয়ে ওঠে আপন প্রবৃত্তির দাস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *