
স্বপ্নের পথচলা
জেরিন জাহান দিশা
খলিশাকুন্ডি গ্রামে বাস করতো রমিজ আলী।রমিজ আলী
পেশায় একজন ভ্যানচালক। তাঁর একমাত্র ছেলে নীলয়
ক্লাস নাইনে পড়ে। নীলয়ের স্বপ্ন বড় হয়ে সে একজন ডাক্তার হবে । কিন্তু তাদের পরিবার খুবই অস্বচ্ছল।
ঠিকমতো খাবার জোটেনা। রমিজ আলী নীলয়ের মাথায়
হাত রেখে বলে। আমি যেভাবে পারি তোকে আমি ডাক্তার বানাবো। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।
গ্রামের অনেক লোক নীলয় কে খোঁচা মেরে কথা বলে । নীলয়ের এক সহপাঠীর বাবা নীলয় কে বলছে তোমাদের ঘরে তো ঠিকমতো খাবার জোটে না।আর তুমি স্বপ্ন দেখতো ডাক্তার হবার কথাটা শুনে নীলয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল।নীলয় মন খারাপ করে তাঁর বাবাকে বলে আমরা
এতো গরিব কেন?
গরিবদের কি কোন স্বপ্ন দেখতে নেই। ছেলের মুখে
এমন কথা শুনে রমিজ আলী বলে।মন খারাপ করিস না
বাবা ।লোকে যে যাই বলুক তোকে প্রমাণ করতে হবে। ইচ্ছা
আর জেদ থাকলে সব কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়।
বাবার কথা নীলয়ের বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিল।
সে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল।
দিনের আলোতে মাঠের ধারে বসে পড়া, আর রাতে কেরোসিনের আলোয় চোখ ভিজিয়ে পড়তে থাকল।
গ্রামের অনেকে হাসাহাসি করত, আবার কেউ কেউ উৎসাহ ও দিত। স্কুলের শিক্ষক মুজিব স্যার নীলয়ের পড়ার আগ্রহ দেখে বললেন,নীলয় তুমি যদি এই মেধাটা ধরে রাখো,
একদিন তুই অবশ্যই ডাক্তার হবে। গরিব ঘরে জন্ম নিয়ে মানুষ বড় হয় না, বড় হয় ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমে।স্যারের
বলা কথাটা নীলয়ের মনে দাগ কাটলো।
সে নিজের স্বপ্নের সঙ্গে বাবার কষ্টের চেহারাটা ও মিলিয়ে নিল। ভ্যান চালাতে চালাতে রোদে পোড়া মুখ, ঘামে ভেজা গায়ে বাবার সংগ্রাম যেন তার শক্তি বাড়িয়ে দিল। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে নীলয় অন্যের মাঠে কাজ করে যা
টাকা পায়।সেই টাকা জমিয়ে রাখে।যাতে বিপদে তাঁর
কাজে লাগে।
দিন যায়, মাস যায়। পরীক্ষার সময় নীলয় গ্রামের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ে, শিক্ষকদের সাহায্য নেয়। ফলাফল বের হলে নীলয় পুরো ক্লাসে প্রথম হয়। ফলাফল হাতে নিয়ে বাবার কাছে দৌড়ে এসে বলল,বাবা আমি পেরেছি। তোমার কষ্ট কে বৃথা যেতে দেয়নি। রমিজ আলী আনন্দে
তাঁর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে আমি খুব খুশি হয়েছি।
বাবা, তুই যদি এই জেদ আর পরিশ্রম ধরে রাখিস, তুই একদিন অবশ্যই ডাক্তার হবি। তখন মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিবি। তখন লোকে আর তোর স্বপ্ন নিয়ে হাসাহাসি করবে না।নীলয় আকাশের দিকে তাকাল। তাঁর চোখে তখন স্বপ্নের তারাগুলো জ্বলছে।
দারিদ্র্য যত বড়ই হোক, স্বপ্নের শক্তি তার চেয়েও বড় এ
এ বিশ্বাস নিয়েই নীলয় এগিয়ে যেতে থাকল।বছরের পর বছর কেটে গেল। পরিশ্রম, অদম্য জেদ আর বাবার আশীর্বাদে নীলয় অবশেষে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো। কঠিন সংগ্রাম পার করে, একদিন গ্রামের সবার বিস্ময় আর গর্ব হয়ে সে ডাক্তার হলো।
সাদা অ্যাপ্রন গায়ে, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে যখন নীলয় গ্রামে ফিরল, তখন যারা একসময় তার স্বপ্ন নিয়ে হাসাহাসি করেছিল তারাই এখন হাততালি দিয়ে বলল,
দেখো, গরিব ভ্যানচালকের ছেলে আজ ডাক্তার হয়েছে!
কিন্তু নীলয় কখনো কারো প্রতি অভিমান পোষণ করল না। সে মনে রাখল, দারিদ্র্য তাকে স্বপ্ন দেখা থেকে আটকাতে পারেনি, বরং আরও শক্ত করেছে। ডাক্তার হওয়ার পর নীলয় শুধু রোগীদের চিকিৎসা করল না, গ্রামের গরিব,
ছেলেমেয়েদের জন্য একটি ‘স্বপ্ন ফান্ড’ গড়ে তুলল। যারাই পড়াশোনার খরচ জোগাতে না পারে, নীলয় তাদের পাশে দাঁড়ায়। সে বই কিনে দেয়, স্কুলের ফি দেয়, এমনকি নিজের হাতে পড়াতেও শুরু করে। এমনকি এক ছোট্ট ছেলে কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলল, আমাদের ঘরে তো জোটে না, আমি কি বড় হয়ে ইন্জিনিয়ার হতে পারব ডাক্তার ভাই?
নীলয় হেসে ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বলল, স্বপ্ন দেখতে
কখনো ভয় পাবে না। মনে রাখবে, গরিব মানে ছোট না। আর কাউকে তার স্বপ্ন নিয়ে হাসতে নেই। আজ আমি পেরেছি, তুমিও পারবে। গ্রামের মানুষ তখন বুঝল,আসল
বড় মানুষ সেই ,যে শুধু নিজের নয়, অন্যের স্বপ্ন ও পূরণে
সাহায্য করে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে নীলয় মনে মনে বাবাকে বলল,
বাবা, তোমার দয়ায় আর কথাই আমার শক্তি ছিল। আজ আমি ডাক্তার, আর আমার শপথ কোনো গরিব বাচ্চাকে স্বপ্ন ভাঙতে দেব না। তাঁর চোখে তখন আবার ও জ্বলছিল
স্বপ্নের তারাগুলো।