বারেক দাদার ছোটবেলা | স্বাধীনতা দিবসের গল্প

বারেক দাদার ছোটবেলা | স্বাধীনতা দিবসের গল্প

বারেক দাদার ছোটবেলা 
মোঃ ইমরান হোসাইন 

শহরে থাকা মানে খাঁচায় বন্দী পাখির মত।শহরের মানুষগুলো ঠিক ইট-পাথরের মতই বেশ জটিল চাইলে ও যে কারো সাথে গল্প করা যায় না, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।এই বন্দী জীবন থেকে বের হয়ে আসাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। তাই একটু সময় পেলেই ছুটে যায় আমার মায়ের কাছে স্মৃতিবিজরিত সেই পুরোনো গ্রামের বাড়িতে। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত ক্লান্তি দুঃখ মুছে যায়। চিরচেনা সেই গ্রামের মানুষ গুলোর মুখ শৈশবের বিদ্যালয়-মাঠ, কংস নদ, খাল-বিল, গাছ-গাছালি, কাঁদামাখা-সরুরাস্তা আরোও কত’কি! আমি গ্রামে আসলেই একদম মুক্ত পাখির মত উড়ে বেড়ায়। আর যেকেউ আমাদের এই গ্রাম আসলে খানিকের জন্য হলেও তাকে মুগ্ধ হতেই হবে। 

সেদিন ফজরের নামাজ শেষে আমি, বোরহান আর আনিস মিলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে মোশাফর কাকার দোকানে গিয়ে বসলাম। তারপর মোশারফ কাকা’কে বলালাম “কাকা  আমাদের তিনজনকে চা দেন।” ওনিও যথা সময়ে চা দিলেন।

এতপর আমরা তিনজন মিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে 

 মোশারফ কাকার সাথে গ্রামের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে গল্প করতেছি। এমন সময় খালেক দাদা এসে উপস্থিত। ওনার পুরো নাম খালেকুর রহমান হলেও বেশির ভাগ মানুষ ওনাকে খানেক মিয়া নামেই চেনেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি ওনার মুখটা বেশ মলিন। 

আমি জিজ্ঞেরা করলাস “দাদা আপনার কী মন খারাপ।”

তিনি বললেন” বারেক ভাইয়ে শরীরটা বেশি ভালো না।” 

আমি বললাম “তাহলে চলেন গিয়ে দেখে আসি।” 

“আচ্ছা ঠিক আছে চল” খালেক দাদা বললেন। 

তারপর, চায়ের কাপ রেখে এ কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হলাম বারেক দাদার বাড়িতে গিয়ে দেখি ওনি বারান্দায় বসে বই পড়ছেন। আমাকে দেখেই ওনি বলে উঠলেন

 “আরে রাঙা ভাই যে! এইদিকে এসে বসো।”

আমি সহ সবাই বারান্দায় একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। এরপর ওনার শারীরিক বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। এর মধ্যেই আনিস প্রশ্ন করে বসলো, 

“আচ্ছা দাদা আপনি তো সরাসরি যুদ্ধ করেছেন সে সমম কি হয়েছিল? এটা আজকে আমরা সবাই শুনতে চাই!”

আরো পড়ুনঃ  এক চিলতে আবেগ

আছা ঠিক আছে তাদের শুন” এটা বলেই বারেক  দাদা শুরু করলেন: ১৯৭১ সালের ২৫ ইশে মার্চ মধ্য রাতে পাকবাহিনীরা নিরীহ বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেদিন তারা দানবের মত অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে ছিল।তখন সারাদেশব্যপী প্রতিবাদের ঝড় শুরু হলো। স্বাধীনতার ডাক পড়ে গেলো, সবাই যে যার মতো করে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিলো। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, খুব একটা বড় না হলেও তখনকার পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারতাম। আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা আর বাড়ির বড়রাও দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে বেশ কথাবার্তা বলতেন। আমাদেরকে দেশের জন্য সব সময় জাগ্রত থাকতে বলতেন। এর আগে শেখ মুজিব রহমানের ভাষণটিও শুনেই বুঝে দেশে বড় কিছু হবে। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো হওয়ার পর স্কুল-কলেজ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমাদের গ্রামের অনেকেই মুক্তিসেনার খাতায় নাম লিখিয়ে ট্রেনিং-এ চলে যায়। আমি তখনো যেতে পারিনি। তার কারণ হলো আমি বয়সে ছোট ছিলাম । কিন্তু আমার আর ঘরে বসে থাকা সইছিল না। মকবুল কাকার দোকানে গিয়ে রেডিওতে নিয়মিত সংবাদ শুনতাম। পাকসেনাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিসেনার লড়াইয়ের খবর প্রচারিত হতো। লোকমুখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা কথাবার্তা শুনে আমি সুযোগ খুঁজছিলাম কীভাবে যাবো।

একদিন রাতে বারান্দায় একা শুয়ে শুয়ে ভাবতেছিলাম কিভাবে আমি যুদ্ধে যাব । এমন সময় কিছুদূর থেকে হঠাৎ করে কার যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি উঠে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম, তিন-চারজন মানুষ আমাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছেছিল। পথিমধ্যে আমাকে দেখে তারা আমাকে অনেককিছু জিজ্ঞেস করে। আমি তখন বাড়ি দেখিয়ে বললাম, এই যে আমার বাড়ি। তাদের কাছে আমি পরিচয় জানতে চাইলাম। তারা প্রথমে বলতে না চাইলেও আমার জোরাজোরির কারণে  একজন বলল, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা’।

ওরা মুক্তিযোদ্ধা শুনেই আমি তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য জেদ  ধরলাম। আমার কথা শুনে উনারা একজন আরেকজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। হয়তোবা এতো ছোট ছিলাম যে উনারা আমার কথা শুনে কী বলবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে সেদিন আমাকে না নিয়ে আশ্বাস দিলেন কয়েকদিন পর নিয়ে যাবেন। আমি তাদের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রতিদিন রাতে ঠিক এই সময়টাতে আমি তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু তাদের সঙ্গে আর যাওয়া হয়নি। তারপর শফিক নামে আমার এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিসেনাদের ক্যাম্পে চলে যায়। প্রথমে আমাকে শফিক ভাইয়ের সাথে দেখে ক্যাম্পের বাকী সদস্যরা দ্বিধায় পড়ে যান। পরে শফিক ভাই সবাই কে আমার বিষয়ে বুঝিয়ে বলে। এমনকি তারা আমার আগ্রহ দেখে সঙ্গে রাখবেন বলে আশ্বস্ত করলেন।

আরো পড়ুনঃ  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগিং; অসহায় বাবা মা কলমে সাজেদা সুলতানা কলি

পরে ক্যাম্পে মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং দেখতাম, উনারা বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করতে যেতেন তাও শুনতাম, কীভাবে পাকসেনাদের সঙ্গে লড়াই করতেন। একদম কাছে থেকে তখন মুক্তিযুদ্ধ দেখতে পেরেছিলাম। মনে মনে ভাবতাম যদি আমাকেও যুদ্ধ করতে নিতো এবং ট্রেনিং দেওয়াতো!তাহলে তো আমিও তাদের সাথে যুদ্ধে যেতে পারতাম। তবে এই আসা বেশিদিন অপূর্ণ থাকেনি।একদিন আমি গাছের নিচে একা বসে আছি। তখন আমাকে দেখে ক্যাম্পের প্রধান তার কাছে ডেকে নেয় এবং কিছু কাজ করতে বলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো- নিয়মিত রেডিওতে খবর শোনা, তবে এ কাজ করতে হবে একদম আড়ালে গিয়ে, তারপর নিজেদের ক্যাম্পে সতর্কতাবস্থায় থাকা, পাকসেনাদের ক্যাম্পে ছদ্মবেশে চোখ রাখা এবং তাদের চলাফেরার দিকে খেয়াল রাখা। আমিও সব কাজ ঠিক করতাম। 

একদিন আমি একা কাউকে না জানিয়ে পাকবাহিনীর একটা ক্যাম্প দেখার জন্য গেলাম। ছোট বলে ওরা আমাদের উপর তেমন নজর দেয়নি। চারপাশ দেখে যখন বের হবো তখন এক পাকসেনার সামনে পড়ে যাই। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, এখানে কী করি। আমি উত্তরে হাত দেখিয়ে বললাম,”ওইযে গরু মাঠে ছেড়ে আসতে গেছিলাম।” পরে সে আর কিছু বলে নাই। 

এর কিছুদিন পর আমি আবার পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাই, গিয়ে দেখি দুইজন অফিসার কথা বলতেছে। আমিও খেলার বান ধরে  আড়ি পাতলাম। আর শুনতে পেলাম ওদের একজন বলছে আগামীকাল তো উল্লাপাড়া ক্যাম্পে  অপারেশন করবো । যে ক্যাম্পটায় আমি ও আমাদের মুক্তিসেনারা অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছি। আমাদের  অপারেশন করতে আসছে শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো, নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে আসি। আমাদের ক্যাম্প-প্রধানের কাছে খবরটা পৌঁছে দেই। উনি সবার সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন, কীভাবে ওদের প্রতিহত করা যায়। সবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা খুব দ্রুত ক্যাম্প ত্যাগ করি। ওদের প্রতিহত করতে আমাদের প্রস্তুতি চলতে লাগলো। এদিকে আমি আরেকজনকে সাথে নিয়ে  পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে তাদের অবস্থা দেখে আসি। রাত তখন আড়াই টা চারদিকে নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। জঙ্গলের এক পাশ থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক। হঠাৎ করেই গুলির আওয়াজ এসে কানে বাজে। বুঝতে আর বাকি নেই ওরা এসে গেছে আক্রমণ চালাতে। আমরা আমাদের কৌশলী অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করছি। ওরা আক্রমণ করেই যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের থেকে কোনো রকম পাল্টা আক্রমণ না পেয়ে মনে মনে বেশ খুশি হয় পাকসেনারা।

আরো পড়ুনঃ  বর্ষার জলছবি | বর্ষা নিয়ে গদ্য

ক্যাম্পের একদম কাছে এসে আক্রমণ চালাতে থাকে, তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আস্তে আস্তে ওদের গুলির আওয়াজ কমতে থাকে। আমরা তাদের অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে এগিয়ে আসি। যখন আর কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো না, ঠিক তখনি শুরু হয় আমাদের পক্ষ থেকে পাকসেনাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ। আকস্মিক আক্রমণে ওরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। পেছন দিক থেকে আমাদের আক্রমণে ওরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়ে।

কিছু সময়ের মধ্যে পাকসেনাদের সবগুলোকে খতম করে দিতে সক্ষম হই। সেদিন প্রায় ২৫থেকে ৩০ জন পাকসেনা আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে। সেদিনের কৌশলী যুদ্ধ আজও আমার মনে পড়ে, তখন গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তবে আজ দেশের এই বাজে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে। আমরা পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হলেও কিছু অসাধু মানুষের হাত থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আমরা আজও মুক্তির প্রকৃত স্বাদ পাইনি। 

সুতরাং তোমাদের মত তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। সকল দুর্নীতি পিছনে পেলে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *