
দাজ্জালের ফিতনা ও সূরা কাহাফ
শুক্রবার। দিনটি এলেই আমাদের মধ্যে অনেকেই সূরা কাহাফের কথা মনে করি। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি এই সূরা দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করবে।
ক্লাস ৮ম থেকে সব শুক্রবারে সূরা কাফ পড়া অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেসে, কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে রক্ষা করবে দাজ্জালের ফেতনা থেকে? কেন এই সূরা এত তাৎপর্যপূর্ণ? আমরা কি এর এর বার্তা বুঝে পড়ি, নাকি শুধু অভ্যাসের তাড়নায় আওড়াই?
আধুনিক সময়ে ধর্মীয় অনুশীলনের সবচেয়ে বড় সংকট হলো অবচেতনতা জানি না কী করছি, কেন করছি। ফলে প্রজন্মের বৌদ্ধিক বিকাশ কমে যায়, সমাজ চালিকা শক্তি হারায়, আর আমরা ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে শুধু অভিযোগ করতে থাকি। আমাদের অনুযোগের নেই শেষ, একটার পর একটা অভিযোগ।
ঠিক এই জায়গাটিতে সূরা কাহাফ নতুন করে কি শেখায় আমাদের ।
কুরআনের অবিচলিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী : সূরা কাহাফ শুরুই হয় একটি মৌলিক ঘোষণা দিয়ে “প্রশংসা সেই সত্তার, যিনি এই গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যার মধ্যে কোনো বক্রতা নেই।”
মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, নৈতিকতা, আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধ সময়ের সাথে বদলে যায়। ১৯৯০-এর দশকে যেসব চিত্র অগ্রহণযোগ্য ছিল, আজ সেগুলো স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব সমাজের স্ট্যান্ডার্ড সময়ের সাথে বেকে যায়, কিন্তু প্রশ্ন থাকে, এমন কোনো স্ট্যান্ডার্ড কি আছে যা বেঁকে যায় না?
হ্যাঁ আছে কুরআন।
কারণ কুরআন এমন নীতির কথা বলে যা সময়, সমাজ ও সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে সততা, পবিত্রতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, মানবতা। এগুলো পৃথিবীর যেকোনো সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধ।
কুরআনকে তাই বলা হয়েছে গভীর-মূলওয়ালা বৃক্ষ। জ্ঞান বৃক্ষ। ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু বৃক্ষ থাকে অটল। এই অটল মানদণ্ডই দাজ্জালের যুগে সত্য-মিথ্যার রেফারেন্স পয়েন্ট হয়ে উঠবে।
দাজ্জালের ফিতনা, চার দিক থেকে আঘাত : হাদিসে দাজ্জালকে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতারণাকারী বলা হয়েছে।
তার আক্রমণের চারটি মূল মাত্রা।
1. বিশ্বাস
2. সম্পদ
3. জ্ঞান
4. ক্ষমতা
এই চারটি দিকই গঠিত মানুষের চারটি অস্তিত্বিক প্রয়োজন মাইন্ড, হার্ট, বডি ও সোল।
আর আশ্চর্যের বিষয় হলো: সূরা কাহাফে ঠিক এই চার দিকের জন্য চারটি কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। চার কেস স্টাডি ও চারটি সুরক্ষা কৌশল।
১. আশহাবে কাহাফ: বিশ্বাসের সুরক্ষা
কয়েকজন যুবকের গল্প, যারা সমাজের ভুল রীতি থেকে নিজেদের ঈমান রক্ষা করেছিল।
সুরক্ষা কৌশল:
- সৎ সঙ্গ
- ভুল পরিবেশ থেকে দূরে থাকা
- অগ্রাধিকার বোঝা
- মূল বিশ্বাসে দৃঢ় থাকা
২. দুই বাগানের মালিক:
সম্পদের বিভ্রম, একজন অহংকারী মালিক সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে পড়ে।
সুরক্ষা কৌশল হলো: জীবন ক্ষণস্থায়ী এ উপলব্ধি রিজিক আল্লাহর হাতে এ বিশ্বাস সম্পদের কারণে সম্পর্ক নষ্ট না করা,অহংকার পরিহার।
৩. হজরত মুসার জ্ঞানযাত্রা:
জ্ঞানের অহংকার ভাঙা,মুসা (আ.) উচ্চতম সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।
সুরক্ষা কৌশল: বিনয়
যোগ্য মেন্টর নির্বাচন
না বুঝলে ধৈর্য,ঘটনাকে তাত্ক্ষণিক না বিচার করা,জ্ঞানকে চরিত্রে প্রতিফলিত করা।
৪. যুলকারনাইনের শাসননীতি:
ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার অসাধারণ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শাসকের বিনয়, দূরদর্শিতা ও ন্যায়পরায়ণতা।
সুরক্ষা কৌশল:
ক্ষমতায় ন্যায়, মানবসেবায় অগ্রাধিকার
প্রযুক্তিগত দক্ষতা, দলগত কাজ করা
সৃজনশীল সমাধান, আল্লাহর উপর ভরসা।
দাজ্জালের কৌশল
ধোঁকার বিস্তৃত নকশা,দাজ্জাল শক্তি দিয়ে নয়, প্রলোভন দিয়ে মানুষকে বশ করবে:
- তথ্য নিয়ন্ত্রণ
- জ্ঞান বিকৃতি
- ক্ষমতাবানদের ব্যবহার
- বৈশ্বিক গভর্নেন্স দখল
- খাদ্য ও বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ
- অলৌকিক প্রদর্শনী
শেষে নিজেকে ঈসা (আ.) দাবি তারপর নিজেকেই ‘খোদা’ ঘোষণা তার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ধীরে ধীরে সত্য থেকে সরিয়ে নেওয়া।
সূরা কাহাফের লক্ষ্য
বৌদ্ধিক ও নৈতিক সুরক্ষা কাহাফ মানে “গুহা”। যেমন প্রাচীন মানুষ বিপদের সময়ে গুহায় আশ্রয় নিতো, তেমনি দাজ্জালের যুগে আশ্রয় হবে মানসিক গুহা, আধ্যাত্মিক গুহা, অর্থাৎ সূরা কাহাফের শিক্ষা।এটি শুধু পড়ার সূরা নয় বোঝার সূরা। বিশ্লেষণের সূরা। সময়ের ফিতনা মোকাবিলার সূরা।
তাই প্রয়োজন আসলে কি? তাফসীরসহ অধ্যয়ন করা, বিভিন্ন আলেমের ব্যাখ্যা পড়া নোট নেওয়া,নিজের বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
কারণ দাজ্জাল কোনো সাধারণ বিষয় নয়, এটি মানবসভ্যতার সবচেয়ে সিরিয়াস সতর্কবার্তা।
যে সময়ে ট্রেন্ড নৈতিকতার জায়গা দখল করে নিচ্ছে, যে সময়ে সত্যের সংজ্ঞা প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে সে সময়ে সূরা কাহাফ হয়ে উঠবে আমাদের মানসিক প্রতিরোধশক্তির কেন্দ্রবিন্দু।
কাহাফ শুধু একটা সূরা নয়, এটি এক সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। অতএব প্রতি শুক্রবার শুধু তিলাওয়াত নয়, বোঝা, উপলব্ধি করা এবং জীবনে প্রয়োগ করাই হবে, দাজ্জালের ফিতনা মোকাবিলার প্রকৃত প্রস্তুতি।
- মাহজাবীন তাসনীম রুহী
- অনার্স ২য় বর্ষ
- এম সি কলেজ সিলেট




