খেয়া বালিকা কলমে বখতিয়ার উদ্দিন

খেয়া বালিকা
বখতিয়ার উদ্দিন

 

সুজন মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজ গ্রীষ্মের ছুটি দিয়েছে। ছুটি কাটাতে সুজন শহর থেকে সোজা চলে আসে গ্রামের মামা বাড়িতে।
গ্রামে আসতে পথে কত যে বিড়ম্বনা, মহাসড়ক ছেড়ে উপ-সড়কে, তারপর গ্রামের কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিয়ে আবার সামনে পড়ে খেয়া ঘাট।
সুজন খেয়া ঘাটে এসে দেখে, নৌকা এই পাড়ে নেই।নদীর ঐ পাড়ে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে খেয়া।
সুজন খেয়াঘাটে কিছু ক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকে।আর কোন খেয়া পারাপারের যাত্রীর দেখা নেই। দুপুরে সূর্য ঠিক মাথার উপর চলে এসেছে। নদীর ধারে চরে উত্তপ্ত রোদ আর রোদ। উত্তপ্ত রোদের মাঝে মিশে রয়েছে হালকা মিষ্টি বাতাস আর নদীর বুকে সু- ঘ্রাণ জলের স্রোত।আরো দূরে দাঁড়িয়ে আছে , সবুজ ঘাস আর সারি সারি সাদা কাঁশফুল। জম্ম থেকে শহরে বেড়ে উঠা সুজনের মনে এই সব দৃশ্য দেখে খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ সুজনের চোখে ভাসে, একটি বালিকা নদীর জলের মৃদ ঢেউয়ের উপর দিয়ে ভেসে খেয়া এই পাড়ে নিয়ে আসছে।
বালিকাটি এই খেয়া ঘাটের মাঝি। যাত্রী দেখে আয় হবে ভেবে মাঝির মুখে মৃদ হাসি। মাঝির হাসি দেখে সুজনও সৌজন্যবোধ মৃদ হাসে।
সুজন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে নৌকায় উঠে বসে।মেয়েটি নৌকার বৈঠা ধরে অনেক ক্ষণ বসে থাকে।নৌকা বাইছে না দেখে সুজন বলে,নৌকা বাও।
অস্থির হয়েন না, ধৈর্য্য ধইরা একটু বইসেন।আরো যাত্রী আইব, এই বলে মেয়েটি ফিক্ করে হেসে উঠে।



মেয়েটির এমন হাসি দেখে সুজন বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। মেয়েটি আরো হেসে যাচ্ছে দেখে সুজন বোকার মত হা করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখে,মেয়েটির বয়স এগার কিংবা বার বছর হবে।মাথায় লম্বা এলোমেলো খোলা কালু চুলের মাঝ খানে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ চাঁদের মত একখানা গোলাকার মুখ। মুখের মাঝ খানে দাঁতগুলো সাদা বুকের মত ধবধবে সাদা।মায়া ভরা চোখ জোড়ার মাঝে যেন কিসের তীক্ষ্ণ অপেক্ষা। চোখ জোড়ার চাহনির মাঝে যেন একটি স্বপ্নের ঘোড়া তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মৃদ হাসি মাখা ঠোঁট জোড়ার মধ্যে সদা কিসের এক আকর্ষণ লেগে আছে।এই জন শূন্য খেয়াঘাটে এমন একটি মেয়ে দেখে মেডিকেলে পড়া সুজন সত্যি খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায়। এমন একটি মায়াবী মাখা বালিকা খেয়া ঘাটের মাঝি হতে পারে তা সুজন কোন দিন কল্পনা করেনি। সুজন নিজেকে একটু স্বাভাবিক রেখে বলে, তোমার নাম কি?
মেয়েটি খুব সরল ভাবে উত্তর দেয়, রোকসানা।
সুজন উত্তর পেয়ে বলে, তোমার মা- বাবা নেই?
আছে।
পড়ালেখা করো?
আগে কইরতাম।এখন আর কইরা হয় না।
কেন করা হয় না?
ক্লাস ফাইভে সরকারি বৃত্তি পেয়েছি তাই আর পড়া হয় না, রোকসানা অনেক স্বাভাবিক ভাবে কথাটি বলে।
রোকসানা ক্লাস ফাইভে সরকারি বৃত্তি পেয়েছে শুনে সুজন আরো অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সুজনের ক্লাস ফাইভের কথা মনে পড়ে মেয়েটির কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। সুজন মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র হয়েও ক্লাস ফাইভে সরকারি বৃত্তি না পাওয়ার কারণে কত দিন যে মন খারাপ করে কেঁদেছিল তা এখনো তার মনে আছে।
সুজনের ম্লান চেহারা দেখে রোকসানা নিজ থেকে জিজ্ঞেসা করে, আপনার নাম কি?
সুজন এবার একটু চাপা স্বরে বলে, সুজন।
সুজন নাকি প্রিয়জন, এই বলে প্রকৃতির চির চাঞ্চল্যকারী কন্যার মত রোকসানা আবার ফিক করে হেসে উঠে।
এই রকম প্রকৃতির মানস পেটে বেড়ে উঠা মেয়ের সামনে সুজনের সব কিছু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবুও সুজন নিজেকে খুব স্বাভাবিক রেখে ভদ্র ভাবে বলে, খেয়া পারাপার করে দৈনিক কত টাকা আয় করো?
রোকসাসা এবার খুব শান্ত হয়ে বলে, দৈনিক এক শত টাকা।
তা দিয়ে কি করো?
কেন?এই টাকা দিয়ে বাবা আমাকে বিয়ে দিবে, এই বলে রোকসাসা এক বার আকাশের দিকে আরেক বার সুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি যেন ভেবে সেই আবার বলে, আপনি কি চাকুরী করেন?
রোকসানার প্রশ্নে সুজন নদীর জলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, না। আমি মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ছি মাত্র।
সুজনের কথায় রোকসানা এবার খুব উৎসাহ আর আবেগ নিয়ে বলে, আমারও খুব ইচ্ছে ডাক্তারী পড়ার।কিন্তু যে আর পড়তে পারবো না।
রোকসানার কথায় সুজন বোবার মত নীরব হয়ে বসে থাকে।শত ইচ্ছে শর্তেও মুখ থেকে আর কোন শব্দ বের করেত পারছে না।মাঝে মধ্যে রোকসানার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাব উদয় হয়।সুজনের এমন অবস্থা দেখে রোকসান নিজের অজান্তে বলে ফেলে, আমাকে আপনি বিয়ে করবেন?

আরো পড়ুনঃ  অপূর্ণতা কলমে ফাহিয়া হক ইন্নি

 

রোকসানার কথায় সুজন আরো অন্য রকম হয়ে যায়।মনখানি ছোট হয়ে হৃৎপিণ্ডটা জলের মাছ ডাঙ্গায় উঠার মত ছটফট করতে থাকে।সুজন জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছে, কিন্তু কারো সামনে এমন অবস্থায় পড়েনি।সুজন রোকসানাকে কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় কয়েক জন খেয়া পাড়ের যাত্রী চলে আসে বিধায় আর কিছু বলতে পারলো না।যাত্রী পেয়ে মাঝি সু – নিপুণ ভাবে নীরব মনে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা বাইতে শুরু করলো।রোকসানার সরল দৃষ্টির মাঝে সুজনের চেহারার দিকে যেন কিসের উত্তর খোঁজে যাচ্ছিল। এই দৃষ্টির চাওয়া যেন স্বপ্নের জীবনের কিছু চাওয়া।
জীবনের স্বপ্নের ভেলার মত এক সময় খেয়া নদীর এই পাড়ে এসে থেমে যায়। স্বপ্ন দেখানোর মূল মাঝি পাড়ে এসে কোন রকম খেয়ার ভাড়া গছিয়ে মামার বাড়ি চলে যায়।


সুজন মামা বাড়িতে পাঁচ দিন থাকে। এই পাঁচ দিনে সুজন এক মূহুর্তের জন্যেও রোকসানার কথা গুলো ভুলতে পারেনি। এমন কি অন্য বারের মতো মামাতো ভাই – বোনদের সাথে তেমন আনন্দ করতে পারেনি। সেই প্রকৃতির খেয়ালে কি চেয়েছে?তার মনের প্রত্যাশা কি? হয় তো প্রকৃতির লালিত কন্যরা এমন হয়।এরা হয়তো অনেক অনেক মিথ্যা বলে প্রকৃতিকে জাগিয়ে রাখে। জীবনে বরফের মতো গলে গিয়ে সুজনের মনে শতো ইচ্ছে হয়, খেয়াঘাটে গিয়ে তার সাথে একটু দেখা করে আসতে।কিন্তু যাব যাব করে আর কিছুতেই যাওয়া হয়নি।
পাঁচ দিন পর শহরের উদ্দেশ্যে সুজন আবার খেয়া ঘাটে এসে হাজির হয়।সুজনের মনে অনেক খুশি, কারণ রোকসানার সাথে আবার দেখা হবে।এবার সাহস করে তার সাথে ভালো করে কথা বলে সব জেনে নিবে।



সুজন অনেক ক্ষণ ধরে খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে প্রকৃতির মাঝে যেন এক কিসের শূন্যতা। সুজনের মনে হচ্ছে, আজ এই জায়গায় সেই দিন নেই। একটু পর সুজন দেখে, খেয়ার আসনে বসা আর একটি বালিকা। প্রকৃতি আর মনের মধ্যে এমন শূন্যতা দেখে সুজন বালিকাটি থেকে জিজ্ঞেসা করে, এখানে আরেক জন ছিল সেই কোথায়?
মেয়েটি রাজ্যের শত হতাশা আর কিছুটা উৎসাহের চেহারা নিয়ে বলে,রোকসানা বুর কথা কথা কইছেন?তার তো বিয়া হইয়ে গেইছে।
বালিকাটির কথা শুনে সুজন যেন আকাশ থেকে পড়ে।মনে মনে কত উৎসাহ ছিল তা যেন কোথায় হারিয়ে গেল।সুজন অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, সত্যি কি রোকসানা কোন কিছু মিথ্যা বলেনি?সেই কি চেয়েছিল?সত্যি কি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের জন্য সংগ্রাম করে কোন কঠিন দারিদ্র্যতার শিকল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল।
সুজন মেয়েটি থেকে আরো জানতে পারে,দুই দিন আগে পাশের গ্রামের এক রাখালের সাথে রোকসানার বিয়ে হয়েছে। এখন রোকসানার থেকে দেড় বছরের ছোট রেহেনা খেয়া ঘাটের মাঝি।

আরো পড়ুনঃ  পরিবর্তন কলমে ফারহানা মরিয়ম

 

 

 

আরো পড়ুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য

1 thought on “খেয়া বালিকা কলমে বখতিয়ার উদ্দিন”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *