একটুখানি ভালোবাসা
মোঃ রেবেকা আক্তার
মিজান গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। তার ড্রাইভার ফারুখ তাকে না বলেই গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন গেছে। ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার।
কিছু না বলে বলে বেশী লাই পেয়ে যাচ্ছে ড্রাইভারটা, মনে মনে গালি দিল মিজান।
এদিকে তার মায়ের সবকিছু গোছানো হয়ে গেছে। তার বৌ পিংকি বার বার তাগদা দিচ্ছে তাকে। বৃদ্ধা আশ্রমে ঠিক সময়ে পৌছাতে হবে। অনেকটা দূরের পথ, এখনি রওনা দেয়া দরকার।
বার বার ফোন দেয়ার পরেও ফোন রিসিভ করছে না ড্রাইভার ফারুখ।
মিজান তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-মা, কিছু ফেলে যাচ্ছো না তো আবার। সব চেক করে নিয়েছো তো? দেখো, তোমার যা ভুলো মন, ওখানে গিয়ে আবার খোঁজাখোঁজি করবে।
মিজানের মা কিছু বলল না, শুধু অশ্রুশিক্ত নয়নে ছেলের দিকে একবার তাকালো, মনে মনে বলল,
-সবি তো রেখে যাচ্ছি এখানে।
কিন্ত মুখে কিছুই বলল না।
মিজানের এক ছেলে, এক মেয়ে। দুজনেই কলেজে পড়ে। দাদীকে বিদায় দিতে এসেছে তারা, দাদীর গলা জড়িয়ে বলল,
-মিস ইউ গ্রান্ড মা..
এতটুকুই। তাদেরই বা দোষ কি! যামানাটাই এমন। কলেজ, ফেসবুক, বন্ধু বান্ধব সবকিছুকে সময় দিতেই তাদের সময় থাকে না। দাদীকে আলাদা করে সময় দেবার মত সময় কই তাদের।
মিজান আর পিংকি দুজনই জব করে।
আফিয়া বেগমের, এই বিশাল ফ্লাটে একা একা দম বন্ধ হয়ে আসে। সে কথা জানাতেই তার ছেলে আর ছেলের বৌ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৃদ্ধা আশ্রমে থাকলেই নাকি তিনি সবচেয়ে ভালো থাকবেন। আফিয়া বেগমের মনে আছে, তিনি স্কুলের চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছিলেন তার এই ছোট ছেলের জন্যই। বড় দুটো মেয়ের পরে এই একটিমাত্র ছেলে। তাই আদরের কমতি ছিল না। সবার আদর পেয়ে পেয়ে মিজান ভীষন দুষ্টু হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে একগাদা অভিযোগ পেত ছেলের নামে আফিয়া। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছিল, ছেলেটা অন্তত মানুষ হোক।
হ্যাঁ ছেলে মানুষ হয়েছে। বিশাল বড় কোম্পানীতে অনেক উঁচু পদে চাকরী করে, যা অনেকের স্বপ্ন থাকে।
তার বড় দুটো মেয়েও বিয়ে করে বিদেশে সেটেল।
দূর থেকে তাকে দেখে যে কেউ ভাববে একজন সফল মা, সুখী মানুষ। হ্যাঁ! এ কথা ঠিক, মা হিসাবে সে সফল কিন্ত মানুষ হিসাবে কি সে আসলেই সুখী?
মিজান বলল,
– আমি রাস্তায় গিয়ে দেখছি ড্রাইভার টা এল কিনা।
রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতেই, ড্রাইভার ফারুখ গাড়ি নিয়ে আসল। তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে বলল,
– সরি স্যার, সরি! আসলে আমি হাসপাতালে ছিলাম, তাই আপনার ফোন রিসিভ করতে পারিনি।
হাসপাতালের কথা শুনে মিজান আর কিছু বলল না, শুধু জিজ্ঞেসা করল,
-হাসপাতালে কেন গিয়েছিলে, আমাকে না বলে?
-আমার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়েটা ফোন দিয়ে জানালো, আর মায়ের অসুখের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি নিয়েই চলে গিয়েছিলাম। সরি স্যার। সময় মত না গেলে মায়ের বড়সড় সমস্যা হয়ে যেত।
ড্রাইভারের উত্তরটা শুনে মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল মিজানের! তার মা আফিয়া বেগম কতদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলছিল তাকে কিন্ত তার তো সময় হয়নি কখনো। তার মাকে রেগুলার চেকাপের জন্য সব সময় একাই যেতে হয় হাসপাতালে। সেই কবে তার ছোট বোন দেশে থাকতে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে, তারপর থেকে তাদের পরিবারের একটি সদেস্য কখনো সাথে যায়নি তার।
মিজান, তার ড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-ঠিক আছে তুমি এখন যাও। দারকার হলে তোমাকে ফোন দেব।
মিজান তার ফ্ল্যাটে এসে দেখে তার মা লাগেজ গুছিয়ে বসে আছে যাবার অপেক্ষায়। মা কে কতদিন ভালো করে দেখেই না মিজান। মায়ের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মিজার ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল। তার মায়ের চোখের নীচে কালি জমেছে। কত রাত ঠিকমত ঘুমায় না, কে জানে!
এত সুন্দর মুখশ্রী, কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে।
মিজান তার মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল,
– মা আজ না গেলে হয় না।
– যেতেই যখন হবে বাবা, তো আজ গেলেও যা, কাল গেলেও তা।
– না গেলে হয় না, মা?
মিজানের বৌ পিংকি পাশেই ছিল। মিজানের কথা শুনে পিংকি বলল,
– কি বলছো? মা কে অলরেডি ভর্তি করানো হয়ে গেছে বৃদ্ধাশ্রমে, এ মাসের বেতনসহ ভর্তি ফি ও পরিশোধ করা হয়ে গেছে। এখন না গেলে কিভাবে হবে?
– মায়ের সাথে অনেক অন্যায় করেছি। মা কোথাও যাবে না। আমাদের সাথে এখানেই থাকবে।
-তুমি এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়র কথাটা বললে, যেন মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর সিদ্ধান্তটা আমার একারই ছিল?
ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল পিংকি!
আফিয়া বেগম সবই বোঝে। সে চায়না কারো সংসারের অশান্তির কারন হয়ে থাকতে। তাই সে ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
– দেখ বাবা, তোরা সবাই এত ব্যাস্ত থাকিস যে আমার কথা বলার মত একটা মানুষ পাইনা। কাজের লোকের সাথে আর কতক্ষন গল্প করা যায়? কাজের ডিস্ট্রাব হয় জন্য ওরাও খানিক বিরক্ত হয়। তারচেয়ে বরং তুই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেই দিয়ে আয়। সেখানে আমার মত আরো অনেকেই আছে। গল্পে সল্পে বেশ সময় কেটে যাবে।
মায়ের কথা শুনে নিজেকে আর আটকাতে পারল না মিজান। মায়ের পায়ে বসে কাদঁতে লাগল। মাকে বলল,
– মা আজকের পর থেকে আমি চারটার মধ্যেই বাড়িতে ফিরব, তুমি আমার জন্য কফি বানাবে, ঠিক আগের মত। তারপর কফি খেতে খেতে মা ছেলে গল্প করব, ঠিক আগের মত।
মা ছেলের কথার উত্তরে কেবল একটু হাসলেন। বললেন-
– সময় হবে তো বাবা? এতদিন যেহেতু সময় পাসনি। এখন অফিসের এত কাজ সামলে সময় করতে পারবি তো!
-পারবো মা, বেশ পারবো। কিন্ত তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
– পাগল ছেলে।
এতদিনের জমানো অভিমান এক নিমেষেই পানি হয়ে গেল।
আমরা ছেলে মেয়েরা যতই অপরাধ করি না কেন, বাবা মা তা কিছুই মনে রাখেন না। ভালোবেসে তাদের পাশে একটু বসলেই তারা সব ভুরে যান।
কিন্ত আমাদের সেই সময়টাই হয় না। আমাদের সকলেরই উচিত দিন শেষে আমাদের বৃদ্ধ বাবা মা কে একটু সময় দেয়া।
সমাপ্ত