বাবার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো

বাবার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের
সেই দিনগুলো
মিঠুন মিত্র

১৯৭১ সাল।পূর্বপাকিস্তানে নরপশুদের অত্যাচার।
এর ব্যতিক্রম হয়নি তখনকার বরিশাল জেলাও। কী নির্মম, কী নিদারুণ ঘটনা ঘটেছিল তা বললে আজও, বাবার হৃদয় কেঁপে ওঠে। বাবার বয়স তখন ছিল ৭- ৮। আকাশে ঘুড়ি ওড়াতো,হাডুডু খেলত, পাঠাশালায় যেত। এইভাবে দিন অতিবাহিত হতো।



একদিন বাবা ও তার বন্ধুরা মিলে বিকেল বেলা আকাশে আগের দিনগুলোর মতোই ঘুড়ি ওড়াতে লাগলো। আচমকাই কয়েকজোড়া ঠাস,ঠাস শব্দ শুনতে পেল। পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো মিলিটারি আইছে, পালাও..
যতগুলো ঘুড়ি আকাশে ছিল সব ঘুড়ি স্বাধীনভাবে উড়তে লাগলে। আর গ্রামের সব মানুষ পালাতে লাগলো। বাবাও তাদের দলে। বাবাও প্রচন্ড গতিতে দৌড়াচ্ছে। পাগলা ঘোড়া দৈড়ানোর সময় কোনদিকে যাবে, কোথায় গিয়ে থামতে হবে?সে যেমন জানেনা, মাদ্রা গ্রামের মানুষ ও সেই দিন জানতো না কোন দিকে যাবে। কোন ঠিকানা নির্ভয়ের।যে দিক পারে যাচ্ছে, ভাই-বোন,বাবা-মা, সন্তান কে কোথায়? তার খোঁজ ছিল না। বাবা ছুটতে ছুটতে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। ভাগ্য ভালো থাকলে যা হয়, সেই ঘরের মালিক ছিল তাঁর বাবার বন্ধু রহমত মিয়া। বাবাকে দেখে বললো,পংকজ তুই? বাবা সব ঘটনা তাঁরেখুলে বললো। সব শুনে সে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। আর বললো ওরা মানুষ নারে পংকজ। ওরা জানোয়ার। মিলিটারি কী গাঁ, গ্রাম চেনে? ওরা মিলিটারির থেকেও খারাপ। দেহিস, এ্যাকদিন এইদেশ স্বাধীন অবে। তখন ওদের বিচার অবে। মোগো নেতা শেখ মুজিবুর আছে তো ।
বাবা, বললো কাগা, শেখ মুজিব কেডা? নেতা কারে কয় আবার।
রহমত কাকা বললো, ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে যে নেতা , তার নামই শেখ মুজিব। রাত্তির অনেক হইছে রহিমা,পংকজরে খাইতে দে।
রহিমা হলো রহমত মিয়ার স্ত্রী।
পরের দিন সকালে রকমত মিয়া বাবাকে বাড়িতে পৌঁছে দিল। দাদু বাবাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। রহমত মিয়া দাদুরে বললো,বিনোদ যদি বিপদ দ্যাহো, সোজা চলে যাবি মোর বাড়ি। সবাই বেইমানি করলেও তোর এই বন্ধু বেইমানি করবে না।কিছুক্ষণ থেকে রহমত মিয়া বাড়ি চলে গেল। বাবা, তাঁর মাকে বললো, তোমরা কোথায় পালাইছিলা?সে প্রশ্নের উত্তরে কইলো গইয়া কান্দিতে। আর তোর বাবা বাড়ি ছিল। পুহুর পাড়ের ছৈলা গাছের নিচে পলাইছিল। বাবা পুকুর পাড়ে গেল।দেখল কতগুলো শিকর উপর থেকে জলের ভিতর। কিছুই বুঝতে পারল না। দাদু বললো, মাঝু মোরে মিলিটারিরা তালাশে পাবে না। যদি আইতে পারি পুহুরপাড়ে। শিহরের নিচে ফাঁকা জায়গা আছে ওই হানে ছিলাম। আর শ্বাস নিছিলাম নল দিয়া। পরে সবকিছু বুঝতে পারল বাবা।

আরো পড়ুনঃ  দাদুভাইয়া ও নানুভাইয়ার গল্প

পরেরদিন বেলা দশটার দিকে শুনতে পেল পরেশ ও সুরেশ দুই ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। দাদু শুনে পুরা হতভম্ব। সে ওই বাড়ি যাবে? কিন্তু কীভাবে?রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। নৌকায় ও যাওয়া যাবে না।তাহলে…বুকসমান জলভরা ধানের জমি। সেই জমিতে নেমে পানকৌড়ির মতো ডুব দিতে দিতে সুরেশদের বাড়ি গেল। ঐ বাড়িতে যেন কালবৈশাখী ঝড়। দাদুকে দেখে সুরেশের মা বললো বিনোদ রে, মোগো সুরেশ-পরেশ আর বুঝি…। সবার সে কী কান্না। পরেশের বিয়ে হইছে অল্প কয়েকদিন। নদীর ঢেউ যেমন তীব্র গতিতে তীরে আছড়ে পড়ে ঠিক তেমন কেঁদে চলেছে পরেশের স্ত্রী। এই অবস্থা দেখে আর সহ্য হলো না দাদুর। সে ফিরে আসলো বাড়িতে। ঠিক সন্ধ্যা বেলা,
খবর আসলো।সুরেশ,পরেশ বাড়ি ফিরেছে। সে কী আনন্দ সবার মনে! বিধাতার চাওয়ায় হয়তো বেঁচে ফিরে এসেছে। আনন্দের পরে বেদনার আগমন দুইদিন পরে ঘটেছিল। বাড়িতে কুডি মিয়ার বাহিনী ঢুকলো। তাঁদের উদ্দেশ্য হিন্দুদের মালামাল লুটপাট। দাদু বললো, কুডি শেষ পর্যন্ত তুই? কুডি অট্টহাসি দিয়া বললো, মুই রহমত মিয়া নই, যে হিন্দুগো আশ্রয় দিমু,খাওন দিমু, অতো ঠেহা নাই। ও বেইমান। কিন্তু মুই মোর স্বজাতির লগে বেইমানি করতে পারমু না। এদেশ মোগো, মোরা রাজত্ব করমু। তোদের জানের মায়া থাকলে ভারতে ভাগ।বাবা বললো, মোগো নেতা আছে শেখ মুজিব, মোগো ঘরের কিচ্ছু নেতে দিমু না। কুডি মিয়া বললো বিনোদ তোর পোলার দেহি ভালোই সাহস। এতো সাহস ভালো না। ঐ মকবুল আগে এই ঘরে দ্যাখ কী কী আছে?
মাডির মাইটা আগে বাইর কর।টাহা, পয়সা তালাশ কর, সোনা- দানা কোনহানে দ্যাখ, আতালের গরু কয়ডা নিয়া আয়। দাদু বললো, কুডি রে লাল বাছুরডারে ডারে থুইয়া যা,আর চাউল কয়ডা। তা অবে না বিনোদ। বাঁধা দিস না। সব লাগবো মোর। বেশি জোরাজোরি করলে, ও হো হো তোর..। দাদু আর কিছু বললো না। যাদের সাথে ছোটবেলায় খেলায় মেতেছে। তারাই আজ এসব করে।রাজাকার বাহিনী লুটপাট করার পর আগুন জ্বালাইয়া দিল ঘরে। আগুনে পুড়ে গেল ঘর। একে একে সব ঘর লুট করলো, আগুন দিল। কোনো হিন্দুরা রেহাই পাইনি। খবর শুনে রহমত মিয়া বায়ুর বেগে বাড়িতে আসল।রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসতে হলো। তাঁরও তো ভয় আছে। যদি রাজাকাররা মিলিটারিদের কাছে বলে দেয়, ও হিন্দুগো সাহায্য করে। রহমত বললো, বিনোদ মোরা আছি ভয় নাই। মোরা সকলে কুডি না। মোরা একলগে এই দেশে থাকতে চাই, বাঁচতে চাই। রহমতের চোখ ছলছল। এ যেন বন্ধুত্বের অটুট বন্ধন। চাউল,ডাইল, লবন আনছি তোদের লইগা, তড়তড়ি রান্না কইরগা পোলাপান গো খাওন দে। মুই কাইল রাত্তিরে আবার আসমু। মুই একা না, মোর লগে মোর মতো অনেক মানু। দেশকে তো মিলিটারিগো দেওন যায় না।এই বলে রহমত মিয়া চলে গেল। বিনোদ দাদুর ভাই কুমোদ বললো, বউরা রানধো। একলগে সবাই খাই।
দাদু বললো, রহমত মানুষ আর কুডি.. ।
ও নরপশু, মীরজাফর। ঠিক কইছো দাদা, দাদুর ভাই বললো।পরের দিন সকালে দাদুর ভাইপো জহোর পাশের গ্রাম থেকে এসে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, কাগা মাইয়া, বউগো ঐ রাজকার, মিলিটারিরা ধইরা নিতাছে। মুই দূর থাইককা নিজের চোহে দেখছি। ময়নারেও ধইরা নিছে ঐ বেইমান রা। এতো পায়ে ধরলো ওদের। কিন্তু ময়নারে ছাড়ে নাই।টানতে টানতে নিয়া গেল। নেতে বাঁধা দেওয়ায় বাড়িতেই ওর বাপ আর ছোডো ভাইডারে গুলি দিছে, কাগা।ভাঙা পোলডায় অনেকরে বাইনগা ক্রস ফায়ার দিছে।খালডার জল লাল আর লাল।এতো পাষাণ ক্যামনে ওরা। এই বলে দাদুকে জড়াইয়া ধরলো। দাদু বললো, জহোর রে, কান্দার সময় নাই,দেরি করা যাবে না।সবাইরে খবর দে, ওগো যে সৎকার করতে হবে। তা না হলে…. যুবক, মুরব্বিরা যেয়ে সৎকার করলো। গোপন সূত্রে জানা গেল, মিলিটারি গো পরের টার্গেট মাদ্রা গ্রামে। তাঁরা এই গ্রাম লালে-লাল করবে। ক্যাম্প করবে, আর মাইয়া, বউগো….



গ্রামের মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতেই পরিবারের সবাইরে নিয়ে ভারতে রওনা দেবে। শুধু কিছু পোলাপান, যুবক বাদে। যারা থাকবে মিলিটারিগো বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। রাজাকারদের বেইমানির বদলা নেওয়ার জন্য। যে কথা, সেই কাজ। তাঁরা বাদে সবাই ভারতে গেল। কিন্তু যারা গেল তাদের মন পড়ে থাকল এই দেশে। এ যেন দেশের জন্য মায়া, ভালোবাসা। স্বাধীন হবার পরে দাদু-ঠাকুরমার সাথে বাবাও দেশে আসলো। এসে দেখল অনেক হিন্দুদের জায়গা- জমি দখল নিয়েছে রাজাকাররা৷ ছলে,বলে, কলে দলিল করেছে। আর বড় বড় কথা বলছে।

আরো পড়ুনঃ  একজন মায়ের গল্প

আজ বাবার বয়স ষাটের দ্বারপ্রান্তে। যেসব রাজাকাররা তখন ষড়যন্ত্র করেছিল তার বংশধরেরা অনেকে বড়- বড় পদে আছে। বিজয়ের বুলি ওড়ায়৷
অপরদিকে, রহমত মিয়ার মতো মহামানবের বংশধরেরা হয়তো কোথাও -কোথাও ধূলোয় লুটোপুটি খায়।

 

নিয়মিত পড়ুন এবং লেখুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *