হারিয়ে-হারানোর শোক গল্পের শিরোনাম

হারিয়ে-হারানোর শোক
ফাবিহা খানম ছিদ্দিকা

 

এক.
রাস্তার এক পাশে, নিয়ন বাতির আলোয় সাফিন দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা অশ্রুর ঢল! নিস্তব্ধ শহরে স্তব্ধ হয়ে আছে— ব্যস্ত শহরে কারো খেয়াল নেই, এখানে কেউ স্থীর। কোথাও কি কোনো ভুল ছিলো তার,কি দোষ ছিলো,এমন কেনো হয়েছে, কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। কাকে সে বুঝাবে, কে তার কষ্ট বুঝবে— কোথাও কেউ নেই তার…।

দুই.
অনার্স শেষ করে চাকরির বাজারে কঠোর সংগ্রামে নেমেছে, আহমেদ সাফিন। বাবা-মা, চার বোন, দুই ভাই,আট জন সদস্যের একটি কোলাহল পরিবারে বড়ো হয়েছে। সাফিনের বাবা আহমেদ আনিস একজন সৎ, চরিত্রবান কৃষক। কৃষি পরিবার থেকে বড়ো হয়েছে সাফিন, পরিবার থেকে মননশীল চর্চা করে জীবন-যাপন তার। ছাত্রজীবনে কখনো কোনো অসৎ কাজে লিপ্ত ছিলো না। বাবার স্বপ্ন সাফিন বড়ো হয়ে, চাকরি করে সকল সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহযোগিতা করবে। বর্তমানে চাকরির বাজারে আসা যে কতো কঠিন— সদ্য অনার্স শেষ করা সাফিন আঁচ করতে পারছে। বাবার কড়া নির্দেশ, কখনো কোনো চাকরি অসৎ ভাবে নিবে না এবং চাকরি তে অসৎ উপায় অবলম্বন করবে না।আমাদের দেশে চাকরি করা এখন ব্যবসার মতো হয়ে গেলো!টাকা দিলে পাওয়া যায়, না দিলে সে কখনো ‘ইন্টারভিউ’র ধারে কাছেও যেতে পারে না। কখনো তো টাকা দিয়েও চাকরি হয় না। উচ্চবিত্তরা চাকরির বাজারে কঠোর সংগ্রাম থেকে মুক্ত,কারণ তাদের মোটা অঙ্কের টাকা আছে। ভোগান্তির স্বীকার হয় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। যারা চাকরি করছে তাদের অধিকাংশ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চেয়ার পেয়েছে কিংবা তাদের কোনো স্বজনের মাধ্যমে।যাদের সামর্থ নেই তাদের চামড়া জুতার থলা কষে পড়ে যায়,চাকরির বাজারে দৌড়াদৌড়ি করতে-করতে— সাফিন তাদের মধ্যে একজন।বিশেরও অধিক চাকরির আবেদন করেছে, তন্মধ্যে কয়েকটিতে ‘ইন্টারভিউ’তে ঠিকেও ঠায় হয়নি চাকরিতে।

হারিয়ে-হারানোর শোক

 

তিন.
রৌদ্রের খরতাপে চারদিকের পরিবেশ গরম হয়ে আছে।গরমে ফেনের বাতাস, পানি, বেড সবকিছুই গরম হয়ে আছে সাফিনের রুমে। সবকিছু যেনো তার হৃদয়ের মতো মরুময় হয়ে আছে! একটু বৃষ্টির পরম ছোঁয়া পাওয়ার অপেক্ষা..। হুট করে সাফিনের ফোন বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করতে-করতে সাফিন হেঁটে বেলকনিতে চলে যায়।
ফোনের অপর পাশে: হ্যালো, আপনি কি আহমেদ সাফিন বলছেন, আপনার বাবার নাম কি আহমেদ আনিস?
সাফিন:জি, আমি আহমেদ সাফিন।
ফোনের অপর পাশে: আপনাকে জয়েন্ট লেটার নিয়ে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জয়েন করতে হবে নতুবা আপনার জয়েন্ট লেটার বাতিল করা হবে।
সাফিন:জি আমি খুব শীঘ্রই জয়েন করবো ইনশাআল্লাহ…
সাফিন নিজেই বুঝতে পারছে না, সে কি সত্যিই চাকরি পেয়েছে! দ্রুত ফোন থেকে বাবা কে কল দিয়ে কান্না করে দিলো.. তার বাবা খুশি হয়ে ফোনের অপর পাশে কান্না করতে লাগলেন।অবশেষে তাদের স্বপ্ন পূরণ হলো — নতুনভাবে তৈরি হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে সাফিন। নতুন পরিকল্পনা, নতুন পরিবেশ, নতুন আমেজ— শুরু হলো আরেক সংগ্রাম…।

আরো পড়ুনঃ  অন্ধকারে খুঁজি তোমায়

চার.
কতো সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস কেটেছে সুখের পরশে সাফিনের। গত পরশু একজন সহকর্মী কে একটা উপদেশ দিয়ে বিপাকে পড়ে। সাইফুল্লাহ আমিন সেদিন একজন থেকে অফিসের কাজের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টাকা দাবি করে— এককথায়, ঘোষ। সাফিন তার সহকর্মীর এহেন কাজ সহ্য করতে না পেরে তাকে নিষেধ করলো। ‘ইসলামে ঘোষ দেওয়া-নেওয়া উভয় হারাম(নিষেধ), আর আপনি হারামের জন্য অন্যকেও বাধ্য করতে পারবেন না’, সাফিনের কথা শুনে সেদিন সাইফুল্লাহ তার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

আমাদের সমাজে শিক্ষিত অপরাধী কে তার অপরাধ সংশোধন করে দিলে সে তর্ক থেকে শুরু নানাবিধ অপবাদ দিয়ে দেয় কিংবা বিপরীতে থাকা আরেকটি সুন্দর মননশীল মানুষ কে ভেঙে চুরমার করে দেয়।

সেদিনের পরে সাফিন কে অফিসে ডেকে রিজেকশন লেটার ধরিয়ে দেয় অফিসার। একটি বারও তার কাছে জানতে চায়নি, কি হয়েছিল।কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাফিন কে অফিস থেকে বাহির করে দেয়।

সারাদিন কিছু খায়নি, সকালে হাল্কা নাস্তা করে অফিসে গিয়েছিল। অফিসে অনাকাঙ্ক্ষিত মূহুর্তের সম্মুখীন হয়ে সে, হতভম্ব। কাকে কি বলবে, তার চিন্তা-ভাবনায় আসে না..। বাবা মারা গিয়েছিল চাকরি পাওয়ার পরের বছরে। সাফিন চাকরি পাওয়ার পরে তার বড়ো দুই বোন কে বিয়ে দেয়,ছোট দুই বোন আর ছোট ভাই পড়াশোনা করছে। মা আইসিও তে আছে তিন ধরে, গতো একমাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সাফিন ভেবেছিলো বেতন পেয়ে মায়ের চিকিৎসার জন্য আরো উন্নত চিকিৎসা করবে। কিন্তু,রাত ২টা তে হাসপাতাল থেকে কল আসে তার মা আসমানী সাদা দলের সাথী হয়ে গেলেন।

সাফিন নিজেকে সামলে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। হাসপাতালে গিয়ে দেখে সবাই উপস্থিত— সাফিন কে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে তারা। আঁধার যতো ঘনিয়ে আসছে,সুবহে সাদিক ততো এগিয়ে আসছে..। এই শহরের চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কেউ নেই কোথাও, হারিয়ে-হারানোর শোকে পুঁড়ছে কেউ…

আরো পড়ুনঃ  ঘূর্ণিঝড়ের কথা

 

আরো পড়ুন এবং লেখুন চিরকুটে সাহিত্য প্লাটফর্মে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *