আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে পরিবার ও শিক্ষকদের ভূমিকা।
মোঃ গোলাম দস্তগীর
বর্তমান পৃথিবী আজ গ্লোবাল ভিলেজে(বিশ্বগ্রামে) পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে ক্রমেই। বহির্বিশ্বে এখন এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি!
আধুনিকতা আজ বাতাসের মত গতিময়। তা সত্ত্বেও যান্ত্রিকতা ও আন্তঃজালে(ইন্টারনেটে) আটকে গেছে সকল মানব সভ্যতা। ক্রমেই মানুষ তার নৈতিকতা, স্নেহবোধ, শ্রদ্ধাবোধ এবং ঐশ্বর্যপূর্ণ সোনালী অতীত ও আদর্শকে বিলীন করে দিচ্ছে।
জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে প্রতিটি অভিভাবকদের। এ চরম উৎকর্ষতায় আদর্শ পরিবার গঠন ব্যতিরেকে আদর্শ ও সুষ্ঠু সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পুরো পরিবারকে একটি সুনির্দিষ্ট নৈতিক নিয়মের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে। সকল অঙ্গনে শালীনতাবোধ জাগাতে হবে। স্নেহবোধ ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ সাধন করতে হবে।
বিশেষ করে প্রতিটি সন্তানের মা কে সুশিক্ষিত বিদ্বান করে গড়ে তুলতে হবে। কেননা সন্তানের প্রথম শিক্ষক তিনিই। আর প্রথম শিক্ষাঙ্গন হলো পরিবার। জন্মের পর থেকে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা, আচার-আচরণ, নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিষয়গুলো পরিবারেই শিক্ষা লাভ করে।
প্রসঙ্গত লোই(Lowie) তাঁর Social organization(1948) বইয়ে ‘ইয়াগানদের'(Yaghan) সমাজে চলমান শিক্ষার বর্ণনা তুলে ধরেছেন। এ সমাজে প্রত্যেক মেয়ে বা ছেলে ঘনিষ্ঠ মানুষ দ্বারা পড়াশোনা শিখতো।এরা এদের চরিত্রের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিত এবং সংশোধনের ব্যবস্থা করে দিতো। আর এভাবেই মানব সমাজে বৃত্তিমূলক(Vocational) শিক্ষার আগমন ঘটে। বর্তমানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও মূলত শিক্ষার ভিত্তি হয় পরিবারেই। বর্তমানে অনেক উন্নয়নশীল দেশেই সন্তানের শিক্ষার প্রথম হাতেখড়ি হয় পরিবারে। তাছাড়া ব্যক্তির সামাজিকীকরণ,সংস্কৃতিকরণ এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে পরিবারই সর্বাগ্রে মূখ্য ভূমিকা রাখে।
তাই সেই সাথে ভালো প্রতিবেশী আছে এমন স্থানে আবাসন গড়া। কেননা প্রতিবেশীর আচরণগত,ভাষাগত, সংস্কৃতিগত ও নৈতিকতাগত প্রভৃতি প্রভাব শিশুদের উপর পরে। আর এ প্রসঙ্গত রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “বাড়ি করার আগে প্রতিবেশীর নৈতিকতা দেখা প্রয়োজন। এক প্রতিবেশীর কাজ-কর্ম অপর প্রতিবেশীকে প্রভাবান্বিত করে।” এমন কি তিনি এরূপ দোয়াও করেছেন যে, হে আল্লাহ্! আপনার নিকট পানাহ চাই মন্দ প্রতিবেশী থেকে স্থায়ী বসত বাড়িতে।(বুখারী)।
পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকগণও একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আদর্শ ও নৈতিক সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ শিক্ষকগণ হলেন একজন জ্ঞান সাধক ও জ্ঞান বিতরণকারী। তিনারা আমাদের শুষ্ক মস্তিষ্কের প্রেত্যেকটা স্নায়ুকোষকে জ্ঞানরসে সিক্ত করে তোলেন, অনুপ্রেরণা জাগান আমাদের মাঝে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে।
এ প্রসঙ্গে শেখ সা’দী (রহঃ) বলেন, ঊষর মরুর ধূসর বুকে যদি একটি শহর গড়ো, একটি জীবন সফল করা তার চেয়েও অনেক বড়। ঊষর মরুর ধূ-ধূ প্রান্তরের বুক চিরে ফসল উৎপাদন যতটা কঠিন ও শ্রমসাধ্য তার চেয়েও বহুগুণ বেশি কঠিন বাস্তবতা হলো মনুষ্যকুলের সফলতার ইতিহাস রচনা করা। আর এ দুঃসাধ্যই সাধন করে থাকে আদর্শ শিক্ষক সমাজ। কারণ জ্ঞানার্জনের মতই জ্ঞানদান করাও একটা সাধনার ফল।
বিশেষত এ কালে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং। আর এ চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই খরা মরুর ন্যায় শুষ্ক মস্তিষ্ককে জ্ঞানরসের পানি দ্বারা সুশোভিত করে তোলেন শিক্ষকগণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দেখা যায় উল্টো চিত্র। একটা সময় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্য, পিতা-পুত্রের ন্যায়। কিন্তু বর্তমানে এ চিত্র খুব একটা চোখে পড়েনা। ইতিহাসের সেই বাদশাহ আলমগীরের পুত্র ও দিল্লির ঐ মৌলভীর মত শিক্ষক এখন কেবল গল্প, প্রবন্ধ কিংবা রূপকথাতেই মানায়!
খানিকটা বিরল হলেও এ কালে এমনি একজনের শিষ্যত্ব লাভের সুযোগ হয়; যার আদর্শকে তুলে ধরা জাতির জন্য কল্যাণকর মনে করছি।
কেননা তিনি এমনি একজন ব্যক্তি যিনি একাধারে একজন আদর্শ শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক, সফল নাগরিক, দক্ষ ও বিনয়ী প্রশাসক(স্বীয় বিভাগে)।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে যার মিষ্টি হাসিতে মুক্তা ঝড়ে।এত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গুছিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, সকল শিক্ষার্থীরা নিজের অজান্তেই গল্পের ছলে পড়া সব শিখে যায়। শুধু যে পাঠদানে ব্যস্ত তা নয় বরং তিনি একজন দীক্ষা দাতা ও সামাজিক অবক্ষয়রোধকারী সমাজ সেবকও। তিনি তার স্টুডেন্টসদের সব সময় সেবামূলক কর্মকাণ্ড, কৌলীন্যরোধ, আচার-আচরণ, নৈতিকতা, পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে নানামুখী আলোচনা করেন।
এইতো সেদিন আমাদের ৪র্থ বর্ষের ভাইভা প্রস্তুতি ক্লাসে আমরা বিদায়ী শিক্ষার্থী হিসেবে প্রাণ খুলে অভিভাবকের ন্যায় দীক্ষা দিলেন এবং মার্জিত পোশাক সম্পর্কে, জীবনে সফল ও আদর্শ নাগরিক হওয়ার জন্য নানামুখী পরামর্শ দেন।
স্যার এতোটা বিনয়ী ও আন্তরিক মানুষ যে, অচেনা লোক দেখলে ভাববে পিতা তার সন্তানের সাথে কথা বলছে।
আয়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সে মহান মানুষটি হলেন চট্টগ্রাম মহানগরের ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সরকারি সিটি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জসিম উদ্দিন স্যার।
তাই জাতির সকল শিক্ষকদের এভাবে বিনয়ী ও অভিভাবক সুলভ দীক্ষাদানে সকল ছাত্র সমাজের নৈতিক অবক্ষয়রোধে আদর্শ সমাজ গঠনের অংশীদার হয়ে জাতি ও দেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখুন। যেন কখনো এমন প্রতিধ্বনিত না হয় অমুক/তমুক স্কুল/কলেজ/ভার্সিটিতে শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক খুন/লাঞ্ছিত!!
এজন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষক সমাজকে নৈতিক/আদর্শ চরিত্র গঠন, শিক্ষার পাশাপাশি দীক্ষাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
ফলে খুব শীঘ্রই আমরা ফিরে পাব সেই সোনালী সকাল। যখন কোনো বোনের ধর্ষণের নিউজ পড়তে হবেনা খবরের কাগজে। শুনবোনা কারো কলমের খোঁচায় দেশের হাজার কোটি টাকা লুট।পড়তে হবেনা কোনো পিতৃসম শিক্ষকের লাঞ্চনার সংবাদ। থাকবেনা কোনো দুর্নীতি। মা-বাবারা পাবে তাদের শেষ আশ্রয়স্থল সন্তানের বুক।
তখন দেখা যাবে সোনার দেশ, প্রকৃতই সোনায় ভরপুর। ক্রমেই শুনতে পাব পৃথিবী তার সুখ সাচ্ছন্দ্যে ফিরে পেল আপন রূপ।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
শিক্ষার্থী: অনার্স ৪র্থ বর্ষ ভাইভা পরীক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ-চট্টগ্রাম।