কন্যারা_এ_যুগে_পিঞ্জিরাবদ্ধ
আফিফা ইবনাত স্পর্শিয়া
সাল – ২০৫০
বদ্ধ ঘরে সোফার উপর গুটিশুটি মেরে আধ শোয়ার মতো চোখ বুজে বসে আছে পনেরো বছরের তিশা। দরজা , জালানা সব বন্ধ ; টেবিলের উপর ডিপডিপ করে জ্বলছে ছোট্ট একটা মোমবাতি। চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান , কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে আলমারির পেছন দিকটাই মাকড়সা খুব নিখুঁত ভাবে জাল বুনে তার ফাঁদ পেতে দিব্বি নিশ্চিতে খাদ্য আহরণের অপেক্ষায় বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখানে আদৌ কোন মানুষের বসবাস আছে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিশার শুকনো , হতাশাগ্রস্ত মুখে , গাঢ়ো কালো দাগ পড়া ফোলা চোখের উপর বেষ্টিত আছে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা। সামনে টেবিলের উপর পড়ে আছে একটা খালি বোতল , আর প্লেটে রাখা দুটো শুকনো রুটি। বদ্ধ ঘরে মোমবাতির আলোয় সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। তবে তিশার কাছে যেনো এইটুকু আলোই সূর্যের তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মির সমান। তিশা কিছুটা ঝুঁকে টেবিলের উপর রাখা রুটির উপর চোখ রাখলো। এক দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নাক টেনে লম্বা একটা দম নিলো তিশা ; সাথে সাথে খকখক করে কেশে উঠলো। তিশা বুঝতে পারলো রুটি দুটোতে ধুলোবালি বেশ ঘটা করে বাসা বেঁধেছে। বাঁধবে নাইবা কেনো ? আজ দুই দিন হলো রুটি দুটো এই বন্ধ ঘরে এভাবেই পড়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তিশার। তবে এখন এভাবে থাকতে থাকতে তিশার অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন দম বন্ধ হলেও আর কষ্ট হয় না। এখন তিশা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে পারে। এখন তিশার অভিমান হয় না, রাগও হয় না ; রাগ , অভিমান কি সেটাই ভুলে গেছে তিশা। শুধু মাঝেমাঝে একটু খুনের লোভ জাগে তার মনে। তবে সেটা রাগ নয় , লোভ সেটা। কাঠুরের যেমন কুড়াল নেওয়ার লোভ হয়েছিলো ঠিক তেমনিই তিশার মানুষের রক্ত ঝোরানোর লোভ জাগে। নিজের জীবনের প্রতি তীব্র ঘেন্না তার। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটাই তার জীবনের পাপ। খুব বড় একটা পাপ, মহাপাপ। তিশার এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার বয়স যখন আট বছর চলছে তখন তিশা তার দাদিমার সাথে বসে পান চিবোচ্ছিলো আর খোশগল্প করছিলো। তখন তো মন মজানোর গল্পেই আর হতো না। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ কারোর সাথে বসে দুদণ্ড কথা কহিবার সময়ও জেনো পায় না। দাদিমার সাথে তিশার খুব ভালো সখ্যতা। একে অপরের সাথে কথা না বললে যেনো দম নিতেও তাদের কষ্ট হয়। গল্পের এক পর্যায়ে দাদিমার মুখে হতাশা ভর করল। তার চোখ মোটা হয়ে এলো , ক্ষীণ গলায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
—তিশু আমি মনে হয় তোর সাথে আর কোনদিন এভাবে কথা বলতে পারব না।
ছোট্ট তিশা দাদিমার ওমন কঠিন কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রতিউত্তরে এক গাল হাসি দিলো।
দামিমা বুঝলো তার কঠিন কথাটা তিশার বয়স , বুদ্ধির কাছে সামঞ্জস্য হয়নি। দাদিমা তার অমসৃণ গলায় আবারও বলল,
—তিশু ? আমরা নারীরা স্বাধীন নয়। বয়সের একটা পর্যায় এসে আমাদের নারীদের পিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়। মেয়ে মানে ঘরের কোণে সাজিয়ে রাখা একটা আসবাবপত্র। নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে , বন্ধ ভাবে থাকাটাই নারীর শ্রেয়। আমি , তোর মা সবাই তাই করে এসেছি। তোদের মতে এটাতে নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় কিন্তু না এটাই নারীর জন্য সঠিক পন্থা। স্বাধীনতা শব্দটা নারী শব্দের সাথে যায় না। ওটা ছেলেদের মানায়। আমাদের বন্ধ ঘরে নিজেদের চিনতে হয়, জানতে হয়, অন্যর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। যখনি আমরা বন্ধ ঘরে থাকি তখনি আমরা একে অপরের অনুভূতি, বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজেদের মনে ধারণা করতে পারি। রাগ নামক অনুভূতিটা তখন আমাদের মন থেকে বিলীন হয়ে যায়। বেশ ভালোই হয় কারণ, রাগ ছেলেদের শোভা পায়। ছেলেরা উপার্জন করবে , আমাদের খাওয়াবে, পরিবারের ভার নিবে তাই রাগ শুধুমাত্র ছেলেদের-ই শোভা পায়।মেয়ে মানুষের আবার রাগ থাকতে হয় নাকি? না একদম না বরং ছেলেদের রাগের কারণ ভাঙ্গানোই মেয়েদের প্রধান কর্তব্য। অতিরিক্ত চাহিদার ইচ্ছেটাও মরে যায়। ওটাও ভালো হয়। দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে স্বামীর সুখটা পেলেই হলো ; ওতো চাহিদার আবার কি আছে। এছাড়াও বাহিরে জগত নারীদের জন্য একদম নিরাপদ নয় এবং এটা নারীদের কাম্যও নয়। নারীর এতো বাহিরে কি? লেখাপড়া শিখেই বা কি হবে? এখান থেকে কয়েক বছর আগে ধর ২৫ বছর আগে মেয়েদের লেখাপড়ার নিয়ম ছিলো তবে সেটা এখন আর নেই। ওটা ভুল নিয়ম ছিলো। অতো শিখে কি হবে? উচ্চশিক্ষিত হয়েই তো করবে ছেলেদের অপমান যা নারীদের করা কখনোই উচিত নয় ; তার চেয়ে ঘরের কাজকর্ম শিখে স্বামীর সেবায় নিয়োজিত হতে পারলেই নারীর জীবন স্বার্থক। মেয়ে মানে একটা বোঝাও বটে। অন্যর খেয়ে আবার এতো শখ করার কি আছে! তার চেয়ে দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে জীবন পার করলেই হলো। তিশু তোমার সময় এসে গেছে নিজেকে চেনার।
তিশা দাদিমার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সরু চোখে দাদিমার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদিমার এতো কঠিন কথা সে সবটা বুঝতে না পারলেও আংশিক বুঝতে পারলো। এই সমাজে মেয়েদের যে মূল্য নেই সেটা সে বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারল।
৪ বছর পর।
____________
আজ তিশার বারো বছর পূর্ণ হলো। লাউ ডগার মতো লম্বা হলো তিশা। শারীরিক মানসিক সব দিক দিয়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তার। একদিন তিশার আম্মু তাকে বলল,
— তিশা মেয়েদের রক্ষা কবচ, আর মেয়েদের অবস্থান একমাত্র ঘরের কোণেই শোভা পায়। যাও আজ থেকে এই ঘর-ই তোমার সব।
সেই থেকে আজ অব্দি বন্ধ তিশা এই ঘরে। আজ তিশা পনেরো বছরি যুবতী। দীর্ঘ সাতটা বছর বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ সে। অবশ্য বদ্ধ বলতে একেবারে বন্ধ না। এইতো প্রতিদিন এই ঘর থেকে উঠে সংসারের সব কাজকর্ম করে আবার এই ঘরেই ফিরে আসতে হয় তাকে। বারো বছর বয়সে তার জীবনের খাতা থেকে “বাহির” নামক শব্দটার ইতি ঘটেছে। এখন আর দাদিমার হাত ধরে পানের বাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ির গেটটা টপকানো হয় না তার। এখন আর ঘটা করে পাড়ার কাকিমাদের সাথে জবরুল কাকুদের বাড়িতে পানি আনতে যেতে পারে না সে। এখন আর ভর দুপুরের ঘুমের ভান ধরে পড়ে থেকে সবার অগোচরে চুপিচুপি পা ফেলে তার সমবয়সী ঝটুর সাথে খেলতে যেতে পারে না তিশা। এখন তিশা একেবারে অন্যর অধীনে। খাওয়া , আর সংসারে কাজ করে তার দিন কেটে যাচ্ছে। দাদিমাটার সাথে তার এখনোও কথা হয় তবে এখন তিশা সেই কথার মাঝে মজা খুঁজে পায় না। এখন দাদিমার কথা শুনলে তার কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে অথচ যেদিন তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় সেদিন তিশা তার দাদিমার সঙ্গে ঘুরতে যাবে বলে কি কাঁদাটাই না কেঁদে ছিলো।
ঝটুর কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে উঠলো তিশা। ওর নাম নেহাল, তিশা ছোট থেকে ঝটু বলেই অভ্যস্ত। ঝটুও এখন তিশার মতো বড় হয়ে গেছে। এইতো গতকাল ঝটু এসেছিলো তিশার সাথে দেখা করতে ; হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মাধ্যমিক পরিক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে সেই সুবাধে মিষ্টি আনা। ঝটুকে দেখে তিশার খুব আপসোস হলো। ইশশশ আজকে তিশাও ঝটুর মতো ভালো রেজাল্ট করে অন্যদের মিষ্টি খেতে দিতে। ঝটুর চাইতে তিশার ব্রেন শক্তি অনেক বেশি ছিলো। তিশার ছোট থেকে ইচ্ছে ছিলো পৃথিবী ঘুরে দেখার , অজানাকে জানার অথচ পরিস্থিতি এমন তিশা এখন নিজের বাড়ির গন্ডিটাই ঘুরে দেখতে পারে না। ঝটুর ভালো রেজাল্ট করার জের ধরেই নাকি ঝটুর আব্বু আম্মুর আনন্দের শেষ নেই। তিশার নিজের মেয়েলি জীবনের উপর খুব রাগ হলো। আজকে মেয়ে বলে সে নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছে কোনোটাই পুরুন করতে পারল না। বাংলা পড়াশুনা থাক অন্তত দ্বীনি শিক্ষা টুকুও তো তাকে শিখতে দিলে হতো! কই সেই অধিকার টুকুও তো দেওয়া হয়নি তিশাকে। তিশার তীব্র ইচ্ছে ছিল দ্বীনি শিক্ষায় নিজেকে দিক্ষীত করতে কিন্তু তা আর হলো না। স্বপ্ন কেনো নরমাল ভাবেও জীবনটা কাটাতে পারলো না সে। হুট করে তিশার মাথায় খুন চাপলো। তিশার সেই ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে ইচ্ছা হলো যে এমন নিকৃষ্ট নিয়ম তৈরি করেছে মেয়েদের জন্য। মেয়ে বলে তাদের কি শান্তিতে বাঁচার অধিকার টুকুও নেই! তাদের কি সখ , আল্লাদ , ভালো লাগা, স্বপ্ন বলে কিছু থাকার নেই! এই পৃথিবী কি মেয়েদের জন্য জাহান্নাম?! বদ্ধ ঘরেও তো তিশাকে একটু ভালো লাগা উপহার দেওয়া যেত! তিশা জানে নারীদের পর্দা করার জন্য ঘর-ই শ্রেয়! তবে নারীরাতো পর্দা করেও নিজেদের জীবনে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। পর্দা করেও তারা নিজেদের শখ , আল্লাদ ,স্বপ্ন পুরুন করতে পারে ; এখানে তো নারীদের পর্দা করার উপর কোনো জোর না দিয়ে বরং বদ্ধ করে অহেতুক কারণ বিহীন বন্দি করে রাখা হয়েছে। এখানে তারা ভালোবাসাতে পর্দায় আবদ্ধ না , এখানে যে তারা মেয়েরা শুধুমাত্র-ই বোঝা হিসেবে বন্দি।
আহা! কতো অধঃপতন! তিশার বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা চাপা কষ্টের দীর্ঘনিশ্বাস। হুট করে তিশার প্রচন্ড রাগ হলো। রাগে তিশার শরীর টগবগ করতে লাগলো। আজ অনেক দিন পরে তার আবারও রাগ হলো। তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে কালো ফোলা চোখ দুটো ক্রমশ লাল রং ধারন করছে। নাকের পাতাটা থেকে থেকে ফুলে উঠছে। তিশা অনুভব করলো রাগে তার গলা শুকিয়ে গেছে। এক ঝটকায় টেবিলের উপর থাকা বোতলটা হাতে নিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। বোতলে পানি নেই। শেষ অংশে একটু পানি দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বোতলটার দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে থেকে আবারও স্বস্থানে সেটা রেখো দিলো। দ্রুত ছুট মেরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে জানালার পর্দা খুললো। মাথাটা কাত করে চোখ দুটো আকাশ পানে আবদ্ধ করে দেখতে লাগলো সূর্য মামাটা কি ২৫ বছর আগের মতো মেয়েদের জীবন তার আলো দিয়ে আলোকিত করবে বলে আলোয় সাজছে! নাকি সেও এই মানুষদের মতো স্বার্থপর হয়ে মেয়েদের আলো দেওয়া থেকে বঞ্চিত করছে! না তিশা কোন আভাস পেলো না। একটু আগে ফজরের আজান দিলো। রাতের কালচে আঁধার কেটে একটু , একটু করে আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে। তিশা মাথাটা আরো একটু কাত করে সূর্য মামার মুখটা দেখতে চাইলো তবে সে দেখতে পেলো না। বাড়ির চারপাশে বেষ্টিত সুউচ্চ পাচুল স্বার্থপরের মতো সেটা আগলে দাঁড়িয়ে আছে , যেনো তিশার সাথে তার বহু দিনের শত্রুতা। কিছুতেই তিশাকে সূর্য মামার মুখোমুখি হতে দেবে না সে। তিশা মলিন হাসি দিলো। পাচুলটাকে তার বড্ড স্বার্থপর মনে হলো। কেমন স্বার্থপরের মতো সূর্য মামার সব আলোটা নিজের জীবনে নিলো। একটু তিশাকে দিলে কি হতো! কতো বছর হলো তিশা সূর্য মামার সদ্য উঠা লাল গোলাপের মতো রক্তরাঙা রুপটা দেখতে পায় না। আরো একবার মলিন হাসি দিলো তিশা। তিশার মনে হলো ওই যে পাচুলটা ওইটা হলো মেয়েদের জন্য তৈরি করা সেই বিশ্রী নিয়মটা। যে নিয়মে প্রতি মুহূর্তে কুরবান হচ্ছে হাজারো মেয়ের জীবন। আহা! তিশার বুকটা ভারি হয়ে এলো। নিশ্চয়ই তার মতো হাজারও মেয়ে প্রতিনিয়ত এভাবে আপসোসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হিসাব মেলাতে বসেছে। নিশ্চয়ই তাদের হিসাবের খাতাটাও বারংবার তিশার মতো শূন্যতে পূর্ণ হয়েছে! চোখ বুঝলো তিশা। বার কয়েক জোরে জোরে দম নিলো সে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে আবারও আকাশ পানে তাকালো , ব্যথিত মনে , মলিন হেসে, ক্ষীণ গলায় অস্পষ্ট স্বরে বলল…
—একদিন ঠিকিই কেউ না কেউ ওই পাচুল ভেঙ্গে আমাদের সূর্য মামার সাথে পরিচয় করে দিবেন। একদিন আমরা মেয়েরা ওই পাচুল টপকে সূর্য মামার সদ্য উঠা লাল লালিমা রুপটা দেখবো। সেদিন আমরা বোঝা নয় ; সেদিন আমরা কারোর না কারোর ভরসার আশ্রয়স্থল হবো। কারোর প্রচন্ড ভালোবাসা হবো, কারোর জীবনের বেঁচে থাকার এক অনন্য কারণ হবো আমরা। সেদিন আমরাও খুব মজা করব। মুক্ত পাখির মতো একটা প্রশান্তি সেদিন আমরাও অনুভব করব। আমিও সেদিন ততোটাই মজা করব যতোটা মজা ঝটু করে! সেদিন বেশি দুরে নয়।
(বর্তমান নারীদের শোচনীয় অবস্থার উপর আলোকপাত করে পর্বতী সমাজের অবস্থার পরিপেক্ষেতেই গল্পটা তৈরি)
সাল – ২০৫০
বদ্ধ ঘরে সোফার উপর গুটিশুটি মেরে আধ শোয়ার মতো চোখ বুজে বসে আছে পনেরো বছরের তিশা। দরজা , জালানা সব বন্ধ ; টেবিলের উপর ডিপডিপ করে জ্বলছে ছোট্ট একটা মোমবাতি। চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজমান , কিছু কিছু জায়গায় বিশেষ করে আলমারির পেছন দিকটাই মাকড়সা খুব নিখুঁত ভাবে জাল বুনে তার ফাঁদ পেতে দিব্বি নিশ্চিতে খাদ্য আহরণের অপেক্ষায় বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখানে আদৌ কোন মানুষের বসবাস আছে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিশার শুকনো , হতাশাগ্রস্ত মুখে , গাঢ়ো কালো দাগ পড়া ফোলা চোখের উপর বেষ্টিত আছে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা। সামনে টেবিলের উপর পড়ে আছে একটা খালি বোতল , আর প্লেটে রাখা দুটো শুকনো রুটি। বদ্ধ ঘরে মোমবাতির আলোয় সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। তবে তিশার কাছে যেনো এইটুকু আলোই সূর্যের তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মির সমান। তিশা কিছুটা ঝুঁকে টেবিলের উপর রাখা রুটির উপর চোখ রাখলো। এক দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নাক টেনে লম্বা একটা দম নিলো তিশা ; সাথে সাথে খকখক করে কেশে উঠলো। তিশা বুঝতে পারলো রুটি দুটোতে ধুলোবালি বেশ ঘটা করে বাসা বেঁধেছে। বাঁধবে নাইবা কেনো ? আজ দুই দিন হলো রুটি দুটো এই বন্ধ ঘরে এভাবেই পড়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তিশার। তবে এখন এভাবে থাকতে থাকতে তিশার অভ্যেস হয়ে গেছে। এখন দম বন্ধ হলেও আর কষ্ট হয় না। এখন তিশা দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতে পারে। এখন তিশার অভিমান হয় না, রাগও হয় না ; রাগ , অভিমান কি সেটাই ভুলে গেছে তিশা। শুধু মাঝেমাঝে একটু খুনের লোভ জাগে তার মনে। তবে সেটা রাগ নয় , লোভ সেটা। কাঠুরের যেমন কুড়াল নেওয়ার লোভ হয়েছিলো ঠিক তেমনিই তিশার মানুষের রক্ত ঝোরানোর লোভ জাগে। নিজের জীবনের প্রতি তীব্র ঘেন্না তার। মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটাই তার জীবনের পাপ। খুব বড় একটা পাপ, মহাপাপ। তিশার এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার বয়স যখন আট বছর চলছে তখন তিশা তার দাদিমার সাথে বসে পান চিবোচ্ছিলো আর খোশগল্প করছিলো। তখন তো মন মজানোর গল্পেই আর হতো না। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ কারোর সাথে বসে দুদণ্ড কথা কহিবার সময়ও জেনো পায় না। দাদিমার সাথে তিশার খুব ভালো সখ্যতা। একে অপরের সাথে কথা না বললে যেনো দম নিতেও তাদের কষ্ট হয়। গল্পের এক পর্যায়ে দাদিমার মুখে হতাশা ভর করল। তার চোখ মোটা হয়ে এলো , ক্ষীণ গলায় কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
—তিশু আমি মনে হয় তোর সাথে আর কোনদিন এভাবে কথা বলতে পারব না।
ছোট্ট তিশা দাদিমার ওমন কঠিন কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রতিউত্তরে এক গাল হাসি দিলো।
দামিমা বুঝলো তার কঠিন কথাটা তিশার বয়স , বুদ্ধির কাছে সামঞ্জস্য হয়নি। দাদিমা তার অমসৃণ গলায় আবারও বলল,
—তিশু ? আমরা নারীরা স্বাধীন নয়। বয়সের একটা পর্যায় এসে আমাদের নারীদের পিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়। মেয়ে মানে ঘরের কোণে সাজিয়ে রাখা একটা আসবাবপত্র। নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে , বন্ধ ভাবে থাকাটাই নারীর শ্রেয়। আমি , তোর মা সবাই তাই করে এসেছি। তোদের মতে এটাতে নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় কিন্তু না এটাই নারীর জন্য সঠিক পন্থা। স্বাধীনতা শব্দটা নারী শব্দের সাথে যায় না। ওটা ছেলেদের মানায়। আমাদের বন্ধ ঘরে নিজেদের চিনতে হয়, জানতে হয়, অন্যর জন্য নিজেকে তৈরি করতে হয়। যখনি আমরা বন্ধ ঘরে থাকি তখনি আমরা একে অপরের অনুভূতি, বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিজেদের মনে ধারণা করতে পারি। রাগ নামক অনুভূতিটা তখন আমাদের মন থেকে বিলীন হয়ে যায়। বেশ ভালোই হয় কারণ, রাগ ছেলেদের শোভা পায়। ছেলেরা উপার্জন করবে , আমাদের খাওয়াবে, পরিবারের ভার নিবে তাই রাগ শুধুমাত্র ছেলেদের-ই শোভা পায়।মেয়ে মানুষের আবার রাগ থাকতে হয় নাকি? না একদম না বরং ছেলেদের রাগের কারণ ভাঙ্গানোই মেয়েদের প্রধান কর্তব্য। অতিরিক্ত চাহিদার ইচ্ছেটাও মরে যায়। ওটাও ভালো হয়। দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে স্বামীর সুখটা পেলেই হলো ; ওতো চাহিদার আবার কি আছে। এছাড়াও বাহিরে জগত নারীদের জন্য একদম নিরাপদ নয় এবং এটা নারীদের কাম্যও নয়। নারীর এতো বাহিরে কি? লেখাপড়া শিখেই বা কি হবে? এখান থেকে কয়েক বছর আগে ধর ২৫ বছর আগে মেয়েদের লেখাপড়ার নিয়ম ছিলো তবে সেটা এখন আর নেই। ওটা ভুল নিয়ম ছিলো। অতো শিখে কি হবে? উচ্চশিক্ষিত হয়েই তো করবে ছেলেদের অপমান যা নারীদের করা কখনোই উচিত নয় ; তার চেয়ে ঘরের কাজকর্ম শিখে স্বামীর সেবায় নিয়োজিত হতে পারলেই নারীর জীবন স্বার্থক। মেয়ে মানে একটা বোঝাও বটে। অন্যর খেয়ে আবার এতো শখ করার কি আছে! তার চেয়ে দুবেলা দু-মুঠো খেয়ে জীবন পার করলেই হলো। তিশু তোমার সময় এসে গেছে নিজেকে চেনার।
তিশা দাদিমার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। সরু চোখে দাদিমার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদিমার এতো কঠিন কথা সে সবটা বুঝতে না পারলেও আংশিক বুঝতে পারলো। এই সমাজে মেয়েদের যে মূল্য নেই সেটা সে বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারল।
৪ বছর পর।
____________
আজ তিশার বারো বছর পূর্ণ হলো। লাউ ডগার মতো লম্বা হলো তিশা। শারীরিক মানসিক সব দিক দিয়ে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তার। একদিন তিশার আম্মু তাকে বলল,
— তিশা মেয়েদের রক্ষা কবচ, আর মেয়েদের অবস্থান একমাত্র ঘরের কোণেই শোভা পায়। যাও আজ থেকে এই ঘর-ই তোমার সব।
সেই থেকে আজ অব্দি বন্ধ তিশা এই ঘরে। আজ তিশা পনেরো বছরি যুবতী। দীর্ঘ সাতটা বছর বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ সে। অবশ্য বদ্ধ বলতে একেবারে বন্ধ না। এইতো প্রতিদিন এই ঘর থেকে উঠে সংসারের সব কাজকর্ম করে আবার এই ঘরেই ফিরে আসতে হয় তাকে। বারো বছর বয়সে তার জীবনের খাতা থেকে “বাহির” নামক শব্দটার ইতি ঘটেছে। এখন আর দাদিমার হাত ধরে পানের বাজার যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ির গেটটা টপকানো হয় না তার। এখন আর ঘটা করে পাড়ার কাকিমাদের সাথে জবরুল কাকুদের বাড়িতে পানি আনতে যেতে পারে না সে। এখন আর ভর দুপুরের ঘুমের ভান ধরে পড়ে থেকে সবার অগোচরে চুপিচুপি পা ফেলে তার সমবয়সী ঝটুর সাথে খেলতে যেতে পারে না তিশা। এখন তিশা একেবারে অন্যর অধীনে। খাওয়া , আর সংসারে কাজ করে তার দিন কেটে যাচ্ছে। দাদিমাটার সাথে তার এখনোও কথা হয় তবে এখন তিশা সেই কথার মাঝে মজা খুঁজে পায় না। এখন দাদিমার কথা শুনলে তার কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে অথচ যেদিন তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয় সেদিন তিশা তার দাদিমার সঙ্গে ঘুরতে যাবে বলে কি কাঁদাটাই না কেঁদে ছিলো।
ঝটুর কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে উঠলো তিশা। ওর নাম নেহাল, তিশা ছোট থেকে ঝটু বলেই অভ্যস্ত। ঝটুও এখন তিশার মতো বড় হয়ে গেছে। এইতো গতকাল ঝটু এসেছিলো তিশার সাথে দেখা করতে ; হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মাধ্যমিক পরিক্ষায় বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে সেই সুবাধে মিষ্টি আনা। ঝটুকে দেখে তিশার খুব আপসোস হলো। ইশশশ আজকে তিশাও ঝটুর মতো ভালো রেজাল্ট করে অন্যদের মিষ্টি খেতে দিতে। ঝটুর চাইতে তিশার ব্রেন শক্তি অনেক বেশি ছিলো। তিশার ছোট থেকে ইচ্ছে ছিলো পৃথিবী ঘুরে দেখার , অজানাকে জানার অথচ পরিস্থিতি এমন তিশা এখন নিজের বাড়ির গন্ডিটাই ঘুরে দেখতে পারে না। ঝটুর ভালো রেজাল্ট করার জের ধরেই নাকি ঝটুর আব্বু আম্মুর আনন্দের শেষ নেই। তিশার নিজের মেয়েলি জীবনের উপর খুব রাগ হলো। আজকে মেয়ে বলে সে নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছে কোনোটাই পুরুন করতে পারল না। বাংলা পড়াশুনা থাক অন্তত দ্বীনি শিক্ষা টুকুও তো তাকে শিখতে দিলে হতো! কই সেই অধিকার টুকুও তো দেওয়া হয়নি তিশাকে। তিশার তীব্র ইচ্ছে ছিল দ্বীনি শিক্ষায় নিজেকে দিক্ষীত করতে কিন্তু তা আর হলো না। স্বপ্ন কেনো নরমাল ভাবেও জীবনটা কাটাতে পারলো না সে। হুট করে তিশার মাথায় খুন চাপলো। তিশার সেই ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে ইচ্ছা হলো যে এমন নিকৃষ্ট নিয়ম তৈরি করেছে মেয়েদের জন্য। মেয়ে বলে তাদের কি শান্তিতে বাঁচার অধিকার টুকুও নেই! তাদের কি সখ , আল্লাদ , ভালো লাগা, স্বপ্ন বলে কিছু থাকার নেই! এই পৃথিবী কি মেয়েদের জন্য জাহান্নাম?! বদ্ধ ঘরেও তো তিশাকে একটু ভালো লাগা উপহার দেওয়া যেত! তিশা জানে নারীদের পর্দা করার জন্য ঘর-ই শ্রেয়! তবে নারীরাতো পর্দা করেও নিজেদের জীবনে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। পর্দা করেও তারা নিজেদের শখ , আল্লাদ ,স্বপ্ন পুরুন করতে পারে ; এখানে তো নারীদের পর্দা করার উপর কোনো জোর না দিয়ে বরং বদ্ধ করে অহেতুক কারণ বিহীন বন্দি করে রাখা হয়েছে। এখানে তারা ভালোবাসাতে পর্দায় আবদ্ধ না , এখানে যে তারা মেয়েরা শুধুমাত্র-ই বোঝা হিসেবে বন্দি।
আহা! কতো অধঃপতন! তিশার বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা চাপা কষ্টের দীর্ঘনিশ্বাস। হুট করে তিশার প্রচন্ড রাগ হলো। রাগে তিশার শরীর টগবগ করতে লাগলো। আজ অনেক দিন পরে তার আবারও রাগ হলো। তার ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচে কালো ফোলা চোখ দুটো ক্রমশ লাল রং ধারন করছে। নাকের পাতাটা থেকে থেকে ফুলে উঠছে। তিশা অনুভব করলো রাগে তার গলা শুকিয়ে গেছে। এক ঝটকায় টেবিলের উপর থাকা বোতলটা হাতে নিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। বোতলে পানি নেই। শেষ অংশে একটু পানি দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বোতলটার দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকিয়ে থেকে আবারও স্বস্থানে সেটা রেখো দিলো। দ্রুত ছুট মেরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে জানালার পর্দা খুললো। মাথাটা কাত করে চোখ দুটো আকাশ পানে আবদ্ধ করে দেখতে লাগলো সূর্য মামাটা কি ২৫ বছর আগের মতো মেয়েদের জীবন তার আলো দিয়ে আলোকিত করবে বলে আলোয় সাজছে! নাকি সেও এই মানুষদের মতো স্বার্থপর হয়ে মেয়েদের আলো দেওয়া থেকে বঞ্চিত করছে! না তিশা কোন আভাস পেলো না। একটু আগে ফজরের আজান দিলো। রাতের কালচে আঁধার কেটে একটু , একটু করে আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে। তিশা মাথাটা আরো একটু কাত করে সূর্য মামার মুখটা দেখতে চাইলো তবে সে দেখতে পেলো না। বাড়ির চারপাশে বেষ্টিত সুউচ্চ পাচুল স্বার্থপরের মতো সেটা আগলে দাঁড়িয়ে আছে , যেনো তিশার সাথে তার বহু দিনের শত্রুতা। কিছুতেই তিশাকে সূর্য মামার মুখোমুখি হতে দেবে না সে। তিশা মলিন হাসি দিলো। পাচুলটাকে তার বড্ড স্বার্থপর মনে হলো। কেমন স্বার্থপরের মতো সূর্য মামার সব আলোটা নিজের জীবনে নিলো। একটু তিশাকে দিলে কি হতো! কতো বছর হলো তিশা সূর্য মামার সদ্য উঠা লাল গোলাপের মতো রক্তরাঙা রুপটা দেখতে পায় না। আরো একবার মলিন হাসি দিলো তিশা। তিশার মনে হলো ওই যে পাচুলটা ওইটা হলো মেয়েদের জন্য তৈরি করা সেই বিশ্রী নিয়মটা। যে নিয়মে প্রতি মুহূর্তে কুরবান হচ্ছে হাজারো মেয়ের জীবন। আহা! তিশার বুকটা ভারি হয়ে এলো। নিশ্চয়ই তার মতো হাজারও মেয়ে প্রতিনিয়ত এভাবে আপসোসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হিসাব মেলাতে বসেছে। নিশ্চয়ই তাদের হিসাবের খাতাটাও বারংবার তিশার মতো শূন্যতে পূর্ণ হয়েছে! চোখ বুঝলো তিশা। বার কয়েক জোরে জোরে দম নিলো সে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে আবারও আকাশ পানে তাকালো , ব্যথিত মনে ,