পরিণতি বখতিয়ার উদ্দিন ( উপন্যাস)

পরিণতি
বখতিয়ার উদ্দিন
(উপন্যাস)

১.
বর্ষাকাল।
বিশাল পাট ক্ষেত।
এই পাটের দেশে প্রায় অঞ্চলে পাট জম্মে।পাট দিয়ে অনেক জিনিস পত্র তৈরী হয়। তাই বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা বেশি।
প্রকৃতির বুকে মাঝে মধ্যে অভিরাম বৃষ্টি পড়ে যায়। আবার মাঝে মধ্যে বৃষ্টি থামে।অভিরাম বৃষ্টির ভিতর দিয়ে বিশাল ক্ষেতে সারি সারি পাট গাছ দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে দুই চোখে মনে হয় রাশি রাশি সবুজের সমাহার।এক পলক চোখ বুলালে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। সৈনিকের মতো সারিবদ্ধ পাটগাছ রাজি এই দেশের মানুষের সাহসের প্রতীক এবং জীবনের পরিচয় তুলে ধরে।এই সবুজ ক্ষেত মনে হয় চিরদিন সবুজ, চিরকাল প্রাণবন্ত।বিশাল ক্ষেত দেখলে হৃদয় নাড়া দিয়ে উঠে। মাঝে মধ্যে মন খানি স্বপ্নে দোলা দিয়ে হাজার স্বপ্ন বুনে যায়।এই পাট ক্ষেতের ভিতর দিয়ে কত স্বপ্ন বিলাশিত হয়।আবার কত স্বপ্ন শ্রাবণ মাসের মেঘের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে থাকে,তা বৃষ্টি রুপে কখনো ঝরতেই পারে না।
পাটের দেশে বিশেষ করে উত্তর অঞ্চলে বেশি পাট ক্ষেত রয়েছে। এমন একটি পাট ক্ষেতের বুকে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি নালা।
বর্ষায় বৃষ্টির জল নালার বুকে গড়িয়ে যাচ্ছে। এই বৃষ্টির জল নালার বুকে চির ধারার মতো অনেক দূরে গড়িয়ে যায়। দূর থেকে স্বপ্ন বিলাশে বসে মনে হয় এই জল চির দিনের জন্য কোথায় গড়াচ্ছে? নালার শেষ প্রান্তের দিকে তাকাতেই দেখা যায় ঝাপসা কুয়াশা কুয়াশা ঠিকানা বিহীন ভূবণ। অবুঝ মনে শতবার ইচ্ছে করে ঐ ঠিকানাহীন ভূবণে নিত্য যেতে।কিন্তু দিন গড়িয়ে যায়, রাত পার হয়ে বিদায়ের দিন আসে তবুও ঐ ভূবণে যাওয়া হয় না।কিন্তু নালার বুকে জলরাশি অতি ধীরে ধীরে ঐ দূর দেশে চলে যাচ্ছে। এই জল স্রোতের গতি অতি ধীর।হয়তো এই জলরাশীর কোন চিন্তা নেই,কোন তাড়া নেই। নালার ধারের নুয়ে পড়া পাট গাছ হালকা জলের স্রোতে কম্পন করে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে একটি দুইটি হলদে রং ধরা পাতা বাতাসে ঝরে পানির স্রোতের সাথে ভেসে ভেসে বহুদূরে চলে যায় । এই ঝরে পড়া পাতা ভেসে যাওয়ার পর জীবনে আর কোন খবর থাকে না।তারা কোথায় যাচ্ছে?গিয়ে কোথায় থাকে?তাদের পরিণতি কি হয়? কেউ তার খবর রাখে না।হয়তো যে গাছ থেকে ঝরে যায় সেই গাছ নীরব মনে ভাবতে থাকে।হৃদয়ের মধ্যে খানে হা হুতাশ অস্থিরতায় থাকে।আবার মনের মাঝে এতো এতো ভাবনা কিসের জন্য আসে তা সহজে বুঝা যায় না।
পাট ক্ষেতের ধারে একটি বাগান।এই বাগানের এক পাশে রয়েছে একটি ঝুপড়ী ঘর।এই ঝুপড়ী ঘরে থাকে কালু।
এই ঝুপড়ী ঘর, এই বাগান,পাট ক্ষেত সব নূর আলীর।কালু তাদের কাজের ছেলে।কালুর কাজ হলো বাগান,পাটক্ষেত দেখাশুনা করা।
কালু নীরবে বসে বসে পাটক্ষেত আর বাগান দেখা শুনা করে। ক্ষেতে বা বাগানে কাজ না থাকলে প্রায় সময় বাগানের এক ধারে বসে নালার জল স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপন মনে বসে বসে কত কি ভাবে।মাঝে মধ্যে ভাবন্তর মনে অজানা দেশে হারিয়ে যায়।
বর্ষার জলে নালা ভরে গেছে। প্রায় সময় নালার জলের উপর দিয়ে একটি দুইটি নৌকা বয়ে চলে যায়। মাঝে মধ্যে মাটির হাঁড়ি পাতিল,থালা-বাসান ভরা সম্পান আসে।সাম্পানের দাঁড় টানা খুবই সুন্দর। সুন্দর সুর করা একটি শব্দ বের হয়। কালু এক ধ্যানে বসে তাকিয়ে থাকে। ধ্যানের মধ্যে সাম্পান যেন কোথায় হারিয়ে যায়।
এই হাঁড়ি পাতিল ভরা সাম্পান গুলো এই দিকে সওদা করতে আসে।পাড়ার বউ-ঝিয়েরা রান্না – বান্নার কাজে ব্যাবহার করার জন্য ক্রয় করে।গ্রাম গঞ্জে মাটির হাঁড়ি -পাতিলের বেশ চাহিদা।
নালার ভিতর দিয়ে আরো ডিঙি নৌকা আসে।নৌকা নিয়ে এরা দূর পাড়া গাঁ থেকে পাটক্ষেত দেখা শুনা করতে আসে।ক্ষেতের ধারে নৌকা বেঁধে রেখে সারাদিন ক্ষেতে কাজ করে সন্ধ্যায় আবার নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরে।
অনেকে নালার ভিতর দিয়ে নৌকা নিয়ে বড় নদীতে চলে যায়। এর মধ্যে অনেক নৌকা কালুর পরিচিত আবার অনেক নৌকা অপরিচিত। বাগানে এক ধ্যানে বসে ঐ নালার দিকে তাকিয়ে থাকে। কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলে না।মাঝে মধ্যে একটি দুইটি পরিচিত ডিঙি থেকে কেউ ডাক ছেড়ে কথা বললে তার উত্তর দেয়। ডিঙির অনেক যাত্রী জানে এখানে কালু থাকে।তাই তারা বাগানের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় ডাক ছেড়ে বলে, কালু ক্যান আইছ?
কালু ধ্যান ভেঙে ভগ্ন মনে বলে, ভালা আইছি। এই বলে চোখ জোড়া পেঁচার মতো বড় বড় করে ঐ ডিঙির দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলকে ডিঙি গুলো ভেজা জলের স্রোতের উপর নরম ভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কালুর বয়স প্রায় আঠারো বছর হবে। তার বাবা নেই। তেতাল্লিশের দূর্ভিক্ষের সময় অনাহারে মারা গেছে। এলাকার সবাই জানে,তার বাবা খেতে না পেয়ে ক্ষিধায় খুব যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেছে। তার মা বেঁচে আছে কিনা তেমন কেউ জানে না।মাঝে মধ্যে কেউ কেউ বলে তার মা বেঁচে আছে, আবার কেউ কেউ বলে তার মা অনেক দিন আগে মারা গেছে। এক সময় এই খবরটা মানুষের মুখে মুখে ছিল। এখন সেই খবরটা কালের ধারায় লোকের মুখে চাপা পড়ে
যায়।
তেতাল্লিশের দূর্ভিক্ষের সময় কালুর মা কালুকে খুব কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছিল।মা-বাবা না খেয়ে কালুকে খাওয়েছিল।তখন পাটের দেশে প্রতিটি ঘরে ঘরে খাবারের অভাব। যে দিকে যায় সেই দিকে খাবার শূন্য। সাধারণ মানুষেরা খাবার হাতের কাছে মোটেই পাচ্ছিল না।পেটে ক্ষিধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মানুষ লতা-পাতা খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল। কি যে ক্ষিধার যন্ত্রণা, যে অতিক্রম করেছে সেই বুঝেছে।পথের কুকুর খেতে না পেয়ে পথের ধুলাবালি খেয়েছে। আনাহারের এই করুণ অবস্থা এই পাটের দেশের মানুষ জীবনেও ভুলবে না।দশদিকে হাঁ হাঁ কার শুধু হাঁ হাঁ কার ছিল। অনাহারে পেটের যন্ত্রণায় পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল। এমন কত হাজার যন্ত্রণা ভোগ করে কত হাজার প্রাণি মারা গেছে। মারা যাওয়ার কালে কারো শরীরে হাড্ডি ছাড়া গায়ে তেমন গোস্ত ছিল না।না খেয়ে মারা যাওয়ার যন্ত্রণা তারা বুঝেছে।অনাহারে মারা গিয়ে লাখো মানুষ শান্তির জগতে চলে গেছে। এই দূর্ভিক্ষের কথা বাংলার মানুষ জীবনেও ভুলবে না।

আরো পড়ুনঃ  উপন্যাস বেরঙিন পথে শুরু হলো কথা

প খ১
কালুর বাবা জীবনে অনেক সময় অনাহারে থেকে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। জীবনের শেষ কালে একটু খাবার পেয়েছিল তা না খেয়ে নিজের পেটকে যন্ত্রণা দিয়ে কালুকে খাওয়া ছিল।শেষে ক্ষিধার যন্ত্রণা আর সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে চলে যায়। ক্ষিধার যন্ত্রণায় অনাহারে একটি প্রাণী জগৎ থেকে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা বড়ই করুণ।
কালুর বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের জীবন আরো করুণ অবস্থায় পড়ে যায়। কারো কাছে আর তার মায়ের খবর নেই। এই রকম প্রতিটি ঘরে ঘরে কত করুণ পরিণতির কাহিনী। কারো জীবন নিয়ে মাথা ব্যথা করার কোন সময় নেই। এখন যে যার যার কাজে ব্যস্ত থাকে।
কালু দেখতে খুব কালু।বৈষ্ণব কবির মানসপুত্র কৃষ্ণের মতো কালো।গায়ের রং কালো বলে সবাই তাকে কালু বলে ডাকে।পাটের দেশের একটি সমস্যা হলো,কেউ অসহায় বা দূর্বল দেখলে তার অসহায় আর দূর্বলতা নিয়ে নাম রেখে দেয়। যেমন- কেউ রোগা হলে রোগা মিয়া।কারো গায়ের রং ধলা হলে ধলা মিয়া।কেউ শারীরিক ভাবে ছোট হলে গোরা মিয়া।কেউ লম্বা হলে লম্বু মিয়া ইত্যাদি নাম জড়িয়ে যায়। কালুর নামটিও তেমনি ভাবে হয়েছে। এই রকম নাম ডাকার মধ্যে সরল মানুষেরা কত কষ্ট পায় তা কেউ বুঝার চেষ্টা করে না।
কালুর পরিবারে সবার গায়ের রঙ কালো।মনে হয় তারা কৃষ্ণের বংশ।কালুকে দেখতে ঠিক কৃষ্ণের ছোট ভাইয়ের মতো লাগে। বাহুগুলো বাঁশের মতো তেলতেলে কালো।মাথার চুলগুলো লম্বা লম্বা। একবার চুল কাটার পর আবার অনেক মাস পর চুল কাটে।মাঝে মধ্যে কখন চুল কেটেছে তা পর্যন্ত ভুলে যায়। চুল লম্বা হতে হতে মেয়ে মানুষের চুলের মতো লম্বা হয়ে যায়। কালুর গায়ের রং কালো হলেও চেহারের মাঝে একটি মায়া আছে। মুখের দাঁতগুলো ধবধবে সাদা।মাঝে মধ্যে এমন ভাবে হাসে যেন মুখের ভিতর দাঁত থেকে আলো বের হচ্ছে। কালু এতো কালু যে রাতের আঁধারে বসে থাকলেও দেখা যায় না। শুধু মুখখানি খোলা রাখলে দাঁতগুলো বাতির মতো দেখায়।
কালু প্রায় সময় উদাস মনে বাগানে বসে থাকে। বাগানে বসে প্রায় সময় পাটক্ষেত পাহারা দেয়। যদি কোন দস্যু এসে পাট কেটে বা বিনিষ্ট করে দেয়। এই বিলে নূর আলীর পাট খুব ভালো হয়।ভালো পাট হয় বিধায় বাজারে সহজে বিক্রিয় করতে পারে। তাই কেউ যদি প্রতিহিংসা করে পাটের কচি চারাগুলো নষ্ট করে তাহলে নূর আলীর অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। পাটের দেশের মানুষের হিংসার অভাব নেই। মানুষ হিংসায় জ্বলে পুড়ে সাধারণ মানুষের অনেক ক্ষতি করতে পারে। তাই জীবনে সব সময় সতর্ক থাকা প্রয়োজন।জীবনে চলতে গেলে কত দিকে যে খেয়াল রাখতে হয়।
কালু দেখতে কালো তাই অনেকে তাকে জ্বিন-ভূত মনে করে।ভর দুপুরে কালু যখন একলা বাগানে বসে থাকে তখন অনেকে তাকে ভূত ভেবে ভয় পায়। তার কাছে অনেকে এলেও কথা না বলে ভয়ে চলে যায়। কিন্তু একজন ভয় পায় না।সে প্রায় সময় নানান কাজে কালুর কাছে আসে।কালুর সাথে কথা বলে।সেই হলো আবিদা।তার ডাক নাম আবি বা আবিদা।তবে পুরো নাম হলো আবিদা খানম।
আবিদা নূর আলীর মেয়ে। প্রায় সময় দুপুর বেলা আবিদা কালুর জন্য বাগানে খাবার নিয়ে আসে।নির্জন বাগানে আসতে আবিদার কোন ঢর – ভয় থাকে না।কারণ আবিদা নিশ্চিত জানে যে, এখানে কালু আছে। তাই তার মনে কোন ভয় থাকে না।
কালু বাগানের এক পাশে বসে আছে। আবিদা খাবার হাতে নিয়ে ঝুপড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, কালু ভাই,খাবার আইনছি।আইসা খাইয়া নাও।
কালু আবিদার কন্ঠ শুনে একটু স্বস্তি নিয়ে দাঁড়ায়। কালুর মনে জানা হয়েছিল , এই সময় আবিদা খাবার নিয়ে আসবে।কারো জীবনে কিছু ঘটতে যাবে তা আগে থেকে জানা হয়ে যায় বুঝি?এই রকম কালুর মনে কত বিষয়ে জানা হয়ে যায়।
কালু খাবার পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধোয়ে খাবার খেতে বসে যায়। এতোক্ষণ বাগানে বসে থাকতে থাকতে ক্ষিধায় পেট যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল।একা একা কারো সাথে কোন কথা বলতে পারছিল না।এখন কাকে কি বলবে?খাবার পেয়েছে তাই শান্তি মনে খেতে বসে গেছে। কালু কোন বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে চায় না।অক্ত হলে খাবার খেয়ে পেটকে শান্তি দিতে চায়। কালুর মনের ধারণা, যদি খেতে না পেয়ে তার বাবার মতো মারা যায়। সবার মনে জীবনে বেঁচে থাকার মায়া আছে। সবাই ভালো করে খেয়ে দেয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। অনাহারে মারা যাওয়ার কষ্ট কালু বুঝি বেশি বুঝতে পারে। কালুর মতো হয়তো সবাই জানে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। এই অঞ্চলের অনেকের ঘরে এই রকম অবস্থা আছে। পাটের দেশে পাট জম্মে তবে ভাত বেশি জম্মে না।পাট খেয়ে তো পেট শান্তি করা যায় না।তাই সবার মনে ভাতের চিন্তা বেশি। হঠাৎ খেতে পেলে পাগলের মতো খায়।
কালু অস্বাভাবিক ভাবে ভাত খাচ্ছে আর আবিদা কালুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কালু ভাত খাচ্ছে যেন এর আগে জীবনেও আর কোন দিন ভাত খায়নি।মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম ভাত খাচ্ছে। কালুর এই অবস্থা দেখে আবিদা চোখ বড় বড় করে বলে, এইভাবে খাও ক্যান?ধীরে ধীরে খাইতে পাইরো না?এই ভাবে খাইলে যে ভাত গলাই বাইজ্জা মাইরা যাইবা।
আবিদার কথার প্রতি কালুর কোন খেয়াল নেই।কালুর কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আবিদা নীরব মনে কালুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবিদার অবস্থা দেখে কালু একটু খাওয়া বন্ধ করে বলে,এইভাবে চাইয়া আইছ ক্যান?
বইলছি না!এই ভাবে খাইলে গলায় বাইজ্জা মাইরা যাইবা।

আরো পড়ুনঃ  উপন্যাস বেরঙিন পথে শুরু হলো কথা ২য় পর্ব

প১গ
আবিদার কথা শুনে কালু খেতে খেতে বলে,আমি মারা গেইলে তোমার কি?
কালুর কথা শুনে আবিদা বোবার মতো নীরব হয়ে যায়। আবিদা আর কোন কথা বলতে পারছে না। আবিদা এখন প্রায় সময় অন্য রকম অন্য রকম কথা বলে। তখন কালুও উল্টাপাল্টা কথা বলে দেয়। তবে তাদের মাঝে তেমন ঝগড়া হয়না।কালু ছোটকাল থেকে আবিদাদের বাড়িতে বড় হচ্ছে। আবিদাও ছোটকাল থেকে কালুকে দেখে আসছে।তাই ছোট বেলা থেকে এদের দেখা হলে এক জন আরেক জনের সাথে ছোট বাচ্চার মতো দুষ্টুমি করে। আবিদাকে দেখলে কালু অস্বাভাবিক ভাবে খাবার খায়।তা দেখলে আবিদাও রেগে যায়। মৃদ রেগে কালুকে নানান উপদেশ দিতে থাকে।এই ভাবে খাবে না,যদি এভাবে খাও তাহলে গলায় বেজে যাবে।খাওয়ার আগে একটু পানি খাবে তারপর জিবে একটু লবণ দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে মুখে খাবার দিবে।আব্বু প্রতিদিন এইভাবে খাবার খায়। আবিদা একটানা আরো কত কি বলতে থাকে।কালু মাঝে মধ্যে এই সব শুনে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। আবার শুনেও না শুনার ভাব ধরে বসে থাকে। কালু যখন আবিদার কথা শুনে না তখন আবিদা মৃদ রেগে যায়।
খাওয়ার মধ্যে খানে হঠাৎ কালুর গলায় ভাত বেজে যায়। কালু চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। আবিদা তা দেখে অস্থির হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি খাওয়ার পানি দিয়ে কোন রকম রক্ষা হয়।কালু পানি পান করে স্বাভাবিক হলে আবার খেতে থাকে।খেতে খেতে খেতে বলে, তুমি খাইছ?
আবিদা অনেক ক্ষণ এই দিক ও দিক তাকিয়ে মৃদ রাগী গলায় বলে, আমি খাইলে কি আর না খাইলে কি?আমি খাইছি কি না একবারও জিগাইছ?
আবিদার কথা শুনে কালু বলে, আমি যে সব খাইয়া ফেলাইছি।আগে জাইনলে তো তুমি খাইতে পাইরতে।
আমার থেইকা খাইতে হইবো না।শুধু তুমি খাইলে হইবো।
কালু হা করে বোকার মতো বলে, রাগ কইরছো বুইঝি?
আবিদা আবার বলে, রাগ কইরলে কি আর না কইরলে কি?
আমার ভুল হইয়া গেইছে।ক্ষমা কইরে দাও।
কালুর ছোট বাচ্চার মতো কথা শুনে আবিদা মৃদ মৃদ হাসতে থাকে। আবিদা হাসলে বড়ই সুন্দর দেখায়।মৃদ হাসিতে কালুকে বলে, ঢং কইরতে হইবো না। আমি ঘরে গিয়া খাইবো।আমার জইন্য ঘরে খাবার আইছে। আমি এখানে খাইলে তোমার থেইকা খাবারের কমতি হইবো না!আবার ক্ষিধা লাইগা গেইলে কি কইরবা?তখন বড়ই কষ্ট পাইবা।
আবিদার কথা গুলো শুনে কালু আবিদার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। কালুর এমন অবস্থা দেখে আবিদা বলে, হা কইরা থাইকলে মুখে মশা ঢুইকা যাইবো।আমি চইলা যাই, থালা-বাসান গুলা দাও।
আবিদা থালা-বাসান নিয়ে ঘরে চলে যায়। কালু বাগানে আবার একলা বসে থাকে। একা বসে বসে আবিদার কথা ভাবে।ছোটকাল থেকে আবিদা আর কালু এক সাথে বড় হচ্ছে। আবিদার মেজাজটা একটু রাগের।মাঝে মধ্যে উল্টা – পাল্টা কথা বললেও এখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা শিখেছে। আবিদা দেখতে আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছে।
কালু খাবার খেয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুম পাচ্ছে।ঝাপসা চোখে সামনে শুধু পাট ক্ষেত দেখছে।পাটগাছ অনেক লম্বা হয়েছে। পাট যেমন লম্বা হয়েছে তেমনি হয়েছে মোটা।পাট কাটার উপযোগী হয়ে উঠেছে। যখন পাট কাটবে তখন কালু আর পাখির বাপের ব্যস্ততা বেড়ে যাবে।পাট কাটা,পাট শুকিয়ে জাগ দেওয়া। জাগ থেকে তুলে আঁশ নিয়ে আবার রোদে শুকাতে দেওয়া। আরো কত কাজ।।

আরো পড়ুনঃ  উপন্যাস বেরঙিন পথে শুরু হলো কথা, পর্ব ৪

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *