পানের রসে মায়ের নেশা
আজাদ বুলবুল
আমার মা খুব পান খেতেন। এ হাটে দুই বিড়া পান আনলে পরের হাটের আগেই শেষ। দাদীও খুব খেতেন। তাঁর অকাল বৈধব্যের শোক কী তবে পান চিবুনোর নেশায় ভুলে ছিলেন? দাদীই আমার মাকে দিয়েছিলেন পানের সবক। বউকে নেশা ধরাতে পারলে পুত্রকে দিয়ে পান কেনানো সহজ হবে- এই অভিসন্ধি ছিলো দাদীর মনে। নেশার জগতে সাঙাৎ অনিবার্য এই সাধারণ তত্ত্বটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার শিক্ষিত (মায়ের তুলনায়) দাদী রফিকুন্নেসার। বউ শাশুড়ির রসিয়ে রসিয়ে পান চিবুনোর মধুর ছবিটি আজও চোখে ভাসে।
বালকবেলায় দেখেছি পানের গুরুত্ব ও মাহত্ম। শলা-পরামর্শ, বিচার-সালিশ, মিলাদ, খতম; সব আয়োজন বাটা ভর্তি পান নিয়ে শুরু হতো। মুখে মুখে চালু ছিলো শ্লোক- ‘ পান এ মান’। অর্থাৎ পান আপ্যায়নে মান ( সম্মান) রক্ষিত হয়। আমরা মা বেসুরা সুরে আওড়াতো-
পান খাও পণ্ডিত ভাই কথা কও ঠারে
পান গুয়ার জন্ম হৈচে কোন অবতারে।
রাজশাহীর সতেজ সবুজ মিষ্টি মুড়মুড়ে পানের সাথে চিকন ও পাতলা করে কাটা সুপারী। সাথে একদলা পাথুরে চুন আর এক চিমটি ঝাঁঝালো সাদাপাতা। কখনো কখনো সুগন্ধি জর্দা। কয়েকটা চিবুনি দিতেই মুখ ভর্তি রঙিন রস। খানিকক্ষণেই রঙিন জিহ্বা, রঙিন ঠোঁট। মায়ের খুশিমাখা রসটম্বুর মুখে তৃপ্তির পরশ। আমি তখন দেখতে পাই আলাউলের পদ্মাবতী কাব্যের বহুল পঠিত চরণ –
‘তাম্বুল রাতুল হৈল অধর পরশে’।
বাবা বোধহয় চা বাগানের মালিকদের মতো বুঝতে পেরেছিলেন- হাড়িয়া দিয়ে যেমন শ্রমিকদের উদয়াস্ত খাটানো যায় তেমনি পান খাইয়ে আমার মা দাদীকে দিয়ে সংসারের সকল কাজ করিয়ে নেয়া যায়। সংসারের কাজের পাশাপাশি শস্য আহরণ ও তরকারি উৎপাদনের কাজটিও এ দুজনে করতেন। আমার মায়ের আসলেই কি কোন চাহিদা ছিলো? গহনা, দামী শাড়ি, দূরে বেড়াতে যাওয়া, ভালো মন্দ খাওয়া! মা তো খেতেই পারতো না। সারা বেলা পান খাওয়ার ফলে মুখে ঘা হয়ে গিয়েছিল। ভাত তরকারি মুখে রুচতো না। কবি নজরুলের মতোই ফ্লাক্স ভরতি চা আর বাটা ভরা পান নিয়ে মা আমার অপেক্ষায় থাকতো গল্প সঙ্গীর। গ্রামে তো নিষ্কর্মা পাড়া বেড়ানীর অভাব নেই। সে কারণে সঙ্গী জোটাতে বেগ পেতে হতো না। এই পান খাওয়ার আসরে যোগাড় করা গল্পগুলো মা আমকে শোনাতো ছুটিছাটায় বাড়ি এলে।
১৯৯৫ সালে আব্বার মৃত্যুর পর মায়ের নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। হাত পা জ্বালাপোড়া, কিডনি সমস্যা ও ইনসমনিয়া। ঢাকার এক নামকরা গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ বল্লেন- অতিরিক্ত পান খাওয়ার কারণে এসব অসুবিধা হচ্ছে। পান খাওয়া বন্ধ করলে অসুখ ভালো হবে। শুনে মা বলে- “আরে ধ্যাৎ! এইডা কেরুম ডাকতর? অসুক ওইচে, ওষুদ দিবো। হানের (পানের) উপ্রে দোষ হালাইবো কিল্লাই?”
এভাবে দিন যায়। রাত যায়। মা আমার মুখ ভর্তি পান খায়। দাদা আমেরিকা থেকে টেলিফোনে নিষেধ করে। আমিও রাগ দেখাই। মা সলজ্জ গলায় বলে-
‘ আর কৈইচ নাহ! এবার কমাই দিউম।’
কমানো আর হয় কই? রাতে ঘুমাবার সময় কয়েক খিলি মুখে পুরে নরম করে নেয়, তারপর ধীরে ধীরে চিবোয়। চিবুতে চিবুতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতর মুখ বেয়ে পানের রস গড়িয়ে বালিশ ভিজিয়ে দেয়।
মধ্যরাতে পানে চোবা ফেলে দিয়ে আবার নতুন খিলি মুখে পুরে। ছোটবোন মাকে কী বলবে! মায়ের দেখাদেখিতে সে এখন পাঁড় পানখোর।
অনেকদিন ধরে মা ভাতের সাথে তরকারি খায় না। মা’র কাছে ঝাল লাগে। এক টুকরা ইলিশ পানিতে ধুয়ে খেতে গেলেও তার কষ্ট হয়। মরিচ ছাড়া রান্না তরকারি নতুবা সেদ্ধ ডিম বা নূন মেখেই চলে মায়ের খাওয়া। তবে মিনিটে মিনিটে পান আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা পানে অনীহা দেখা যায় না। আমাদের সাবধানবানী নিষেধে বিরক্ত হয়ে ত্যাক্ত গলায় বলে-
“অসুখ বিসুখ কোয়ালে লেয়া থাকলে অইবো। হানের উপ্রে দোষ হালানোর দরকার কী?”
কয়েক বছর পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে মা বুঝতে পারলো আসলে পানের ই ছিলো সব দোষ। অনকোলোজিষ্টরা তখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। অপারারেশন, ক্যামো, শেঁক সব প্রচেষ্টা সম্পন্ন হলো। কিছুতেই মাড়ি থেকে কর্কট তাড়ানো গেল না। নানা ভাবে চেষ্টা চলছে। মা নিজেও দেখতে পাচ্ছেব সন্তানদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। একদিন হাসপাতালের কেবিনে সবার অগোচরে আমার হাত চেপে ধরে বলে-
বাবা তোরা কত্তো মানা কইচ্চৎ, আঁই হুনি ন। এবার হুইন্নুম। আআর হান খাইতাম ন। বাবা আঁর অসুখ বালা অইবো ত?
বাঁচিবার বড়ই সাধ জেগেছিল আমার মা রোকেয়া বেগমের। কিন্তু মানুষের সব সাধ কি পূর্ণ হয়? মাত্রাতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে মুখগহ্বরে (মাড়িতে) সৃষ্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত মা আমার ৬ অক্টোবর ২০১৬ সালে পরলোকে পাড়ি দেন।