বাবাই
নিলুফার জাহান রুবাইয়া
কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। সাথে ঠান্ডা বাতাস তবুও চাদর গায়ে দিয়ে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছেন এডভোকেট জহির। তিনি একজন ডির্ভোস লইয়ার। ডির্ভোস লইয়ার হয়ে লাভই হয়েছে ইনকাম ভালোই হয়। চারিদিকে এত বিচ্ছেদ! তবুও ইনকাম ভালো হলেও একজন মানুষ হিসেবে তিনি কখনোই চান না বিচ্ছেদ হোক। মানুষের মনে এত ক্ষোপ, এত রাগ, এত অভিমান কেন? মূলত মানুষ রাগের মাথায় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় তারপর সে অপরপ্রান্তের মানুষটার সব দোষের কথাই ভাবতে থাকে। যদিও যে ফিরে আসতে চায় কিন্তু আসতে পারে না। তার “ইগো” নামক রোগের কারণে। এজভাকেট জহিরও একা। তবে তার বিচ্ছেদ হয়নি। তিনি সঙ্গীহীন হয়েছেন তার সঙ্গীর মৃত্যুতে। তাই তো তিনি বুঝেন ও জানেন, একজন সঙ্গী কতটা প্রয়োজন জীবনে। মানুষ বলে, ❝অর্থ নেই তো ভালোবাসাও নেই। অর্থহীন সংসারে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।❞ অথচ আজ পর্যন্ত এডভোকেট জহিরের কাছে যতজন এসেছেন সবাই উচ্চবিত্ত ও অর্থবিত্তের মালিক। আসলে পর্যাপ্ত অর্থ ও মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা থাকলেই জীবন সুন্দর। তবে আমরা মানুষেরা যে লোভী। বড্ড লোভী! কেউ বা অর্থের লোভী। কেউ বা ক্ষমতা আর কেউ বা ভালোবাসার। অর্থ ও ক্ষমতার পিছনে ফুটতে গিয়ে মানুষ আর ভালোবাসার পিছনে ছোটার সময় পায় না। আর তখনই বিচ্ছেদটা হয়। এসব ভাবতে ভাবতে মিঃ জহিরের মাথা ঝিম ঝিম করছে। মারজিয়ার কাছে এক কাপ চা চাইলেন তিনি। মারজিয়া মিঃ জহিরের বাড়ির কাজের লোক। কাজের লোক বললে ভুল হবে কারণ তিনি মারজিয়াকে মেয়ের মতোই দেখেন। ❝বাবাই, চা পাতা শেষ হয়েছে। আপনি একটু দাঁড়ান আমি নিয়ে আসি।❞ ❝তোকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না। আমি বাহিরে যাবো তখন খেয়ে নিবো। শোন, তোকে আর আজকে আসতে হবে না। তোর নতুন বছরের ছুটি।❞ মারজিয়া একটু মুচকি হাসলো। কিন্তু একটু পরেই ভ্রু কুচকে বলে, ❝তবে আপনি খাবেন কি?❞ ❝আমায় নিয়ে ভাবিস না। আমি না হয় বাহিরে খাবো ।❞ ❝তবে কি আমি এখন চলে যাবো, বাবাই!❞ ❝হুম যা।❞
এডভোকেট জহির আজ বহুদিন পরে তার মৃতস্ত্রীর পছন্দের শার্টটা পড়েছেন। তিনি একটু মানসিক শান্তির জন্য আজ পুরো শহর ঘুরবেন। আর এই মানসিক শান্তিটা একা পাওয়া যাবে না। তাই তিনি স্ত্রীর পছন্দের শার্টটা পড়েছেন। যাতে তার মনে হয় তার স্ত্রী তাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। বিল্ডিং থেকে নামতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো! পাঁচ টাকা কমানোর জন্য একজন সবজি বিক্রেতার সাথে ঝারা তর্ক করছেন। এতটাও মেজাজ খারাপ হতো না যদি না লোকটা আমার পিছন দিয়ে যাওয়ার সময় তার পাশে থাকা লোকটা না বলতো, “❝এই বাকি টাকাগুলো দিয়ে বারবিকিউ পার্টি করবে আজ রাতে।❞ লোকটার কথা কানে আস্তেই আমি সবজি বিক্রেতার দিকে তাকাই। দেখলাম লোকটা কেমন নিস্তেজ অবস্থায় সবজিগুলো গুছিয়ে রাখছেন। আমরা মানুষের কতই অদ্ভুত তাই না! অন্যের হক মেরে নিজেরা ফুরতি করতে চাই। আমরা এটা ভুলে যাই সৃষ্টিকর্তা কারো হক নষ্ট করেন না। যার তকদিরে যা আছে তা আমরা পাবোই।
সব ভাবতে ভাবতে পাশ থেকে এক রিকশাওয়ালা বলে উঠলো, ❝স্যার, যাবেন?❞ আমি রিকশাতে উঠে পুরো শহর ঘুরলাম। রিকশাওয়ালাটার সাথে কথা বলে বেশ ভাব জমানো গেছে। তাই আর অন্য রিকশা নেওয়ার ইচ্ছা নেই। এতো দিন পরে মন খুলে কথা বলার একটা মানুষ পাওয়া গেছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে তাই কাছের একটা মসজিদের কাছে দাঁড়াতে বলালাম। ❝কত ভাড়া হয়েছেন?❞ তার উত্তর শুনে আমি রীতিমতো ভ্রুু কুজকে তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম কি বলে এসব? সে নাকি কোনো টাকা নিবে না।
“❝কেন? কোনো টাকা নিবেনা।❞ ❝ আজ বছরের শেষ দিন তাই মন চাইলো। আজকে সবাইকে ফ্রিতে ঘুরাবো।❞ ❝তোমার লস হবে না?❞ ❝না স্যার, আর হইলে হবে। স্যার বছরের প্রতিট দিনই তো আল্লাহর রহমতে টাকা কামাই। আজকে না হয় নাই কামাইলাম।❞ আমি অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু সে কিছুতেই টাকা নিবে না। এদিকে নামাজের ওয়াক্ত ও যাচ্ছে। ❝স্যার, চলেন একসাথে নামাজ পড়ি। সমস্যা নাই স্যার, আমার মতো গরিবের সাথে আপনার না বাসলেও হবে।❞ ❝তোমার নামটা কি যেন?❞ ❝মুহিব❞ ❝বুঝলে মুহিব, তুমি মানুষটা গরিব হতে পারো তবে তোমার মনটা খাসা। সেটা একজন কোটিপতিরও নাই। চলো আজ তোমার সাথেই নামাজ পড়ি।❞
নামাজ শেষে মুহিব চলে যায়। মিঃ জহির হেঁটে হেঁটে সামনের এক রেস্তোঁরাতেই যাচ্ছিলেন। তার মনটা আজ বেশ ভালো। বহুদিন পরে আজ তার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। রেস্তোঁরাতে ঢুকার আগে পথে কিছু পথশিশুকে দেখলেন ।দেখে তার খুব মায়া হয়। এক একজনের মুখ কেমন শুকিয়ে আছে। তাই তিনি খাওয়া শেষে ওদের জন্য কিছু খাবার প্যাকেটে করে ওদেরকে দেয়। দিনশেষে বাড়ি ফিরে একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে যান। আজ অবশ্য ঘুমের ঔষধের প্রয়োজন ছিলো না।কারণ তার মনে আজ শান্তি আছে। আর ঘুমের জন্য একটু শান্তি হলেই চলে। তবুও খেয়েছেন কারণ আজ আতোশবাজি ফুটানো হবে। শব্দে মাথাটা আবার ঝিমঝিম করবো।৷ আনন্দের নামে একপ্রকার অত্যাচার চলে এসময়।
ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছে। ঘুম থেকে উঠে ফোনে সবার নতুন বছরের শুভেচ্ছা পাঠানো ম্যাসেজ দেখছিলেন। হট করে ঘড়িতে দেখলেন নয়’টা বাজে অথচ মারজিয়া এখনও নেই। মারজিয়া কখনোই এত দেড়ি করে না। সে সকাল ৭ টার মধ্যেই চলে আসে। মিঃ জহির ভাবলেন, ❝হয়তো রাতে জেগে সবাই মজা করেছে। তাই আর কল দিলেন না।❞ কিন্তু দশটা বাজতেই তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন। এদিকে মারজিয়ার ফোনও বন্ধ। তিনি অনেকটা আস্তে আস্তে নিচে গিয়ে দেখেন মারজিয়ার বাড়ি অনেকটা পোড়া। সেখানে মুহিবও ছিলো। হ্যাঁ, গতকালের রিকশাওয়ালা মুহিব ছিলো মারজিয়ার বর। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানায়, ❝এসব ফানুসের আগুনে এমন হয়েছে।❞ তবুও তারা হাসি-মুখে কথা বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,❝মুহিব, তুমি এতো নিশ্চিতে আছো কীভাবে?❞ ❝স্যার, আপনি না বলছেন, আমি খাস মনের মানুষ। খাস মনের মানুষেরা ভয় পায় না। কারণ আল্লাহ আমাকে পরীক্ষা করছেন। আবার তিনিই আমার রিজিকের ব্যবস্থা করবেন।❞ মুহিবের এই কথা শুনে আমি মুগ্ধ হই। কত সুন্দর এই পৃথিবীটা মনে হচ্ছে! আমি সিদ্ধান্ত নেই মারজিয়াও আর মুহিবের নতুন ঘর করার সব দায়িত্ব নিবো। মারজিয়া তো একবার বলেই উঠে, ❝আপনি আজ সত্যি আমার বাবার দায়িত্ব পালন করছেন। আজ আবারও মনে হচ্ছে, আপনি আমার সত্যিকারের বাবাই।❞
“কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। সাথে ঠান্ডা বাতাস তবুও চাদর গায়ে দিয়ে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছেন এডভোকেট জহির।….” এই সময় তো ঠান্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চাদর গায়ে দিবে, এটাই তো স্বাভাবিক তাই না। এইখানে “তবুও” কথাটা কেমন মনে হলো যে!