বিজয়ের নামে আত্মসমর্পণ

বিজয়ের নামে আত্মসমর্পণ

১৬-ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস।বিজয় মানে একটি ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করা, তার দায় বহন করা এবং সেই সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করা। কিন্তু আজকের এই বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে একটি প্রশ্ন খুবই জরুরি, “আমরা কি সত্যের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি?”

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্রকাশ্য বক্তৃতায় এমন কিছু বক্তব্য ও দৃশ্য সামনে এসেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন করে বিপন্ন করে তুলেছে। উদাহরণ হিসেবে একটি বক্তব্য ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের পতাকা নাকি আমাদের ‘প্রথম পতাকা’, এটি ‘ইসলামী পরিচয়ের প্রতীক’, এবং পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা নাকি ভারতের ষড়যন্ত্র। এই বক্তব্য শুধু ঐতিহাসিকভাবে ভুল নয়, বরং এটি ১৯৭১-এর রক্তাক্ত বাস্তবতাকে অস্বীকার করার স্পষ্ট চেষ্টা।

পাকিস্তানের পতাকা যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক ছিল, সেটি ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই পতাকার নিচেই গণহত্যা হয়েছে, নারী নির্যাতিত হয়েছে, গ্রাম জ্বলেছে, বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে হত্যা করা হয়েছে। এই ইতিহাস অস্বীকার করা মানে শুধু রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া নয়, এটি শহীদদের রক্তের সঙ্গে প্রতারণা।

এই ইতিহাস বিকৃতির চূড়ান্ত রূপটি আমরা দেখি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাম্প্রতিক narrative-এ। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার দিন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দেশীয় সহযোগী আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, একটি জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে মুছে ফেলার এই অপচেষ্টা ছিল সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

এই সত্য কোনো মতামত না, এটি গবেষণা, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের প্রতিবেদন এবং বহু ঐতিহাসিক গ্রন্থে প্রমাণিত। পাকিস্তানি বাহিনী হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, তালিকা তৈরি করেছে, অপহরণ ও নির্যাতনের অবকাঠামো গড়ে তুলেছে। দেশীয় সহযোগীরা ছিল সেই অপরাধযজ্ঞের সক্রিয় অংশ।

অথচ আজ একটি মহল নির্লজ্জভাবে এই হত্যাকাণ্ডের দায় ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। এটি ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে শক্তি সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তার ভূমিকা ছিল প্রকাশ্য ও নথিভুক্ত।

আরো পড়ুনঃ  ৩টি শুক্রবার নিয়ে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ ২০২৪

বরং সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় এমন এক সময়ে, যখন ঢাকা ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এবং আল-বদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে অপহরণ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল।

এই দায় স্থানান্তরের প্রচেষ্টা একটি সুবিধাবাদী রাজনৈতিক narrative, যার উদ্দেশ্য একাত্তরের ঘাতকদের দায় লঘু করা এবং পাকিস্তানি রাষ্ট্রের সংঘটিত অপরাধকে ধুয়ে-মুছে সাফ করা।

এই প্রেক্ষাপটে এবারের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস আর বিজয় দিবস আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে কি আগের মতো নৈতিক দৃঢ়তা দেখা গেছে? যখন একই সময়ে জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে দায়মুক্তি দেন, নিজেদের ভূমিকা নিয়ে কোনো অনুতাপ তো দূরের কথা, বরং ইতিহাস পুনর্লিখনের দুঃসাহস দেখান, তখন রাষ্ট্রের নীরবতাও স্পষ্ট।

আরও উদ্বেগজনক হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজাকারদের ছবি মুছে ফেলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের পাকিস্তানি বাহিনীকে দায়মুক্তির বক্তব্য, এসব কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! শিক্ষার সর্বোচ্চ মঞ্চ থেকে যখন ইতিহাস বিকৃতি ছড়ানো হয়, তখন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনার ওপর সরাসরি আঘাত।

তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, আমরা যে ‘নতুন স্বাধীনতা’র কথা শুনেছিলাম, সেটি কি কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ?

আবেগহীন ইতিহাসের নিরিখে সত্য একটাই: বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্রের পরিকল্পিত অপরাধ, যার বাস্তবায়নে দেশীয় সহযোগীরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল। এই দায় থেকে পাকিস্তান বা তাদের আদর্শিক উত্তরসূরিদের মুক্ত করার কোনো ঐতিহাসিক বা নৈতিক ভিত্তি নেই।

১৬ ডিসেম্বর আমাদের সেই কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় যে, আমরা কি ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়াব, নাকি সুবিধার পক্ষে?

বিজয়ের অর্থ এখানেই নির্ধারিত হয়।

 

  • চৈতি শাহানা
    শিক্ষার্থী, গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *