বৈশাখী বাফেট

বৈশাখী বাফেট
মোঃ আজমাইন ইয়াক্বীন সৃজন

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এইবার হৃদয়ের অফিস থেকে ছয় হাজার টাকা বোনাস দিয়েছে। অথচ এর আগেরবার দিয়েছিলো দশ হাজার টাকা। এ নিয়ে হৃদয়ের দারুণ মন খারাপ। কত ইচ্ছা ছিল যে বোনাসের টাকা দিয়ে সে একটা পাঞ্জাবি কিনবে। দুপুরে কলিগদের সাথে পান্থা-ইলিশ খাবে। বিকালে নদীর ধারে ঘুরবে, ফুচকা খাবে। আর রাতে বাফেট ডিনার। অথচ এখন কিছুই হচ্ছে না।

বোনাসের পরিমাণ কম হওয়ায় হৃদয়ের কলিগরা একই পাঞ্জাবি কিনার প্ল্যান স্থগিত করেছে। হচ্ছে না রাতের বাফেট ডিনারও। দুটা প্ল্যান-ই বাতিল হওয়ায় দুপুর আর বিকালেও আসতে চাচ্ছে না অনেকেই। অর্থাৎ পুরো প্ল্যানটা নষ্ট। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হৃদয় ভাবলো, নাহ, পহেলা বৈশাখে এভাবে বাড়িতে বসে থাকা চলে না। অফিস কলিগদের প্ল্যান বাতিল হয়েছে তো কি হইসে? তার এক কলেজ বন্ধু তুষার পাশের পাড়াতেই থাকে। এবারের পহেলা বৈশাখ ওর সাথে ইঞ্জয় করবে বলে ঠিক করে হৃদয়।

তুষারকে ফোন দিতেই সে ফোন ধরলো,
– কিরে হৃদয়! এতোদিন পর! কি খবর তোর।
– এইতো ভালো রে। মন খারাপ একটু।
– কেন রে?
– আর বলিস না। বৈশাখী ভাতা ভাবসিলাম দিবে ১০ হাজার, দিসে ৬ হাজার মাত্র। ঘুরাঘুরি, বাফেট খাওয়াসহ সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে।
– হা হা হা। বলিস কি! আমিতো সাড়ে ৩ হাজার পাইসি বোনাস। তাতেই তো রাজা রাজা ফিল হচ্ছে। আচ্ছা, তুই আছিস কই?
– বাড়িতেই আছি তো।
– কাজ না থাকলে রতনের দোকানে চলে আয়। বাফেটের আয়োজন করেছি।
– বলিস কি রে! আচ্ছা আসছি থাম।

হৃদয় হাঁটা দিলো রতনের দোকানের দিকে। রতনের দোকানে কলেজ লাইফে প্রায়ই আড্ডা দিতো ওরা। টুকটাক খাবার আর চা পাওয়া যেত এই দোকানটায়। বহুদিন যাওয়া হয় নাই ওখানে। কি অবস্থা দোকানটার কে জানে। দোকানের সামনে যেয়ে হৃদয় আবিষ্কার করলো দোকানের তেমন কোন চেঞ্জ হয় নাই। কিন্তু আজ দোকানে প্রচুর ভিড়। আর সবথেকে বড় কথা প্রায় সবাই-ই ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা।

আরো পড়ুনঃ  চলো প্রতিদিন ডিম খাই, প্রোটিনের অভাব তাড়ায়

হৃদয়কে দেখে রতন ফোকলা হাসি দিয়ে বললো, “আরে, হৃদয় বাই যে! আহো আহো! দ্যাহো, তুষার বাই কি করসে! আমার দুকানে বাপেট দিসে।” হৃদয় ভেতরে গেলো। দেখলো ভেতরে প্রায় ৫০ খানেক ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা। পরনের অপরিষ্কার জামা-কাপড় দেখে বুঝলো যে তারা সকলেই সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চা। এদের অনেককেই হৃদয় অফিসে যাওয়ার সময় ফুল, পানি, চকলেট, রুমাল ইত্যাদি বিক্রি করতে দেখেছে। অদূরে তুষারকে দেখা যাচ্ছে। সে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে রান্না করছে।

হৃদয়কে দেখে তুষার দৌড়ে আসলো, “কিরে এসেছিস?” হৃদয় জিজ্ঞাসা করলো, “এইতো আসলাম। এসব কি করতেসিস এখানে?” তুষার হেসে বললো, “আরে বোকা, বছরের প্রথম দিন আজকে। একটু খাওয়া দাওয়া না করলে কি হয়? প্রতিদিনের মতো এক লোকমা খেয়ে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমালে হবে কি করে? তাই আজকে বাফেটের আয়োজন করেছি। আনলিমিটেড ভাত, ডাল আর সবজি। আমার মনে হলো তোর মন খারাপ, তাই ভাবলাম তোকে ডেকে নেই। হয়তো মন ভালো হবে। মনে আছে তোর? কলেজে থাকাকালীন আমরা কত প্ল্যান করতাম যে একদিন এইভাবে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের খাওয়াবো?”

হৃদয়ের কাছে বিষয়টা খুব ভাল লেগেছে। সে বললো, “বাহ! দারুণ তো! খুব ভাল কাজ করেছিস! আমাদের করা প্ল্যান যে তুই একা-ই নামিয়ে ফেলবি আমিতো ভাবি-ই নাই রে! আচ্ছা, দোস্ত, সব-ই বুঝলাম। কিন্তু মাংস দেস নাই? মুরগি দিতিস অন্তত।” তুষার হালকা হেসে বললো, “কি করবো বল দোস্ত। আমার বাজেট তো ঐ সাড়ে তিন হাজার। তোর কোম্পানির মতো যদি আমাকে ছয় হাজার বোনাস দিতো তাহলে অন্তত ট্রাই করা যাইতো। হা হা হা।”

তুষারের হাসির মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। এটা মনখোলা হাসি। এটা অল্পেই সন্তুষ্ট থাকার হাসি। কিন্তু এই হাসিটা হৃদয়ের মন ছাড়খাড় করে দিচ্ছে। তার এখন নিজেকে খুব বোকা আর স্বার্থপর মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে সে তুষারকে বললো,
– আচ্ছা, শোন না। আমি ছয় হাজার টাকা দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে এখন-ই নিয়ে আসছি। তুই মুরগির অর্ডার দে। রতন ভাইকে দিলে দেড় দুই ঘন্টার মধ্যেই পাকিয়ে ফেলবে। দুপুরের আগেই হয়ে যাবে।
– আরে দরকার নেই। ওরা যতটুকু আছে এতেই বেজায় খুশি। তুই না হয় আরেকদিন খাওয়া।
– তুই অফ যাতো। যা বললাম কর।
– ভাই, তুই অনেক জেদি। কিন্তু তোর এই জেদগুলা খুব ভালো। আমি ব্যবস্থা করতেসি।

আরো পড়ুনঃ  পরিবর্তন কলমে ফারহানা মরিয়ম

এমন সময় হৃদয়ের ফোনে অফিসের এক কলিগ ফোন দিলো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, “হৃদয়, আজকের প্ল্যান ইজ অন। চলে এসো। দুপুরে পান্থা-ইলিশ হবে, বিকালে ঘুরাঘুরি হবে, রাতে বাফেটও হবে। শুধু সেইম পাঞ্জাবি কিনার প্ল্যান বাতিল।” হৃদয় একবার রতনের দোকানের চারপাশে তাকালো এবং বললো, “রফিক ভাই, আজকে তো আমি আসতে পারছি না। আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডের বৈশাখী বাফেটের দাওয়াতে এসেছি। অন্য কোনদিন জয়েন করবো।”

হৃদয় ফোন রেখে দিলো। এখন তার ভাল লাগছে। অফিসের বসের উপরে অভিমানটাও কেন যেন আর নেই। এখন মনে হচ্ছে ছয় হাজার অনেক টাকা।

 

সহকারী অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *