ভিজে মেঘের দুপুর | বৃষ্টির দিনে শৈশবের গল্প

ভিজে মেঘের দুপুর | বৃষ্টির দিনে শৈশবের গল্প

ভিজে মেঘের দুপুর
ইসরাত জাহান

মিনু, রিনা আর খোকন তিনজনই খুব ভালো বন্ধু। তারা তিনজনই এবার ষষ্ঠ শ্রেনীর শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে মিনু আর খোকনদের অবস্থা একটু ভালো হলেও রিনাদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।বছরের তখন মাঝামাঝি সময়।বাংলা মাস জেষ্ঠ্যের এই সময়টাতে প্রতিবছরই কালবৈশাখী ঝড় হওয়ার আশঙ্কা থাকে।স্কুলের রিতা আফার কাছে তারা শিখেছে কিভাবে সাবধান থেকে ঝড়ের সময় নিজেদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়।সেই বছর জৈষ্ঠ্যমাসে কালবৈশাখী ঝড় তেমন তান্ডব করে নি।

জৈষ্ঠ্যের পর এলো ভরা বৃষ্টির মাস আষাঢ়। আষাড়ের শুরু থেকেই মুষুলধারে বৃষ্টি হতে শুরু করেছিলো। বৃষ্টির মধ্যে মিনু, রিনা আর খোকনরা খুব কষ্টে স্কুলে গেলেও তারা আর আগের মতো দক্ষিণমোড়ের বড় মাঠটাতে খেলতে যেতে পারে না। স্কুল থেকে ফিরার পর তাই তিনজনেরই বাসায় অলস সময় কাটায় এর মধ্যে বেশি চিন্তায় থাকে রিনা। এতো তুমুল বৃষ্টিতে এবার বন্যা হওয়ার আশঙ্কায় মা বাবার সাথে তারও অনেক ভয় হয়। তাদের টিনের চৌচালা ঘরটা তেমন একটা মজবুত নয়, টিনের চালের বিভিন্ন জায়গা ছিদ্র থাকায় অল্প বৃষ্টিতেও ঘরের মধ্যে অনেক পানি পড়ে। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ঘরের উঠোন পর্যন্ত পানি চলে এসেছে। পুরা মাস ধরে এমন বৃষ্টি হতে থাকলে হয়তো তারা আর এই ঘরেই বসবাস করতে পারবে না। বৃষ্টি কিন্তু থামলো না,প্রায় প্রত্যেকদিন ই আগের চেয়ে আরো ভারি বৃষ্টিপাত হতে লাগলো। বাড়ির চর্তুদিকে পানি উঠে যাওয়ায় রিনার দায়িত্ব পড়লো ছোট দুই ভাইবোনকে দেখভাল করার। আর তার বাবা মা ঘর পর্যন্ত যেনো বন্যার পানি না আসে সেই জন্যে নানা ধরনের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। রিনাদের বাড়ির চারিদিকে বৃষ্টির পানি উঠে যাওয়ায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো রিনার। এইদিকে মিনু আর খোকনের আড্ডাটা যেনো রিনাকে ছাড়া জমেই না। তারা স্কুলে গেলেও সেখানে তাদের মন বসতো না। একদিন মিনু খোকনকে বললো
“আমরা সবাই মিলে চাইলেই কিন্তু রিনাদের সাহায্যে করতে পারি”। খোকন তখন বললো,” কিন্তু কিভাবে মিনু”?

আরো পড়ুনঃ  লাল বেনারসি

মিনু জবাব দিলো,”স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে কিছু কিছু করে টাকা উঠাবো,চাইলে স্যার ম্যাডামরাও আমাদের সাহায্যে করতে পারেন। “খোকন এই প্রস্তাব শুনে খুব খুশি হলো এবং বললো,”চমৎকার আইডিয়া মিনু।

তাছাড়া আমাদের নিজদেরও নিশ্চয়ই কিছু জমানো টাকা আছে সেইগুলোও আমরা রিনাদের ঘর মেরামতের কাজে দিয়ে দিতে পারি। “মিনু আর খোকন সেইদিন অনেক সময় পর্যন্ত পরামর্শ করলো। এবং তার পরদিনই তারা স্কুলে গিয়ে সব ক্লাসে বলে আসলো সামনের সোমবার দিন যেনো সবাই কিছু টাকা নিয়ে আসে। তাদের এই মহৎ উদ্যোগ শুনে স্কুলের স্যার ম্যামরা ভীষণ খুশী হলেন। যেটা তাদের ভাবার কথা ছিলো সেই ভাবনাটাই সফল করতে যাচ্ছে এই দুই কিশোর কিশোরী। পরের সপ্তাহে বৃষ্টি আরো বেড়ে গেলো এতে রিনারা খুব সমস্যায় পড়ে যায়। তাদের বাড়ির আশেপাশে তেমন আশ্রয়কেন্দ্রও ছিলো না যেখানে গিয়ে তারা আশ্রয় নিতে পারবে। এইভাবেই যখন উদ্বেগ -উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিলো রিনাদের পরিবারের সবার সেই সময়ই দেখা গেলো দুইজন কিশোর কিশোরী নৌকা দিয়ে তাদের বাড়িতে আসছে। রিনা দূর থেকে দেখেই তার বন্ধুদের চিনে ফেললো এই কয়দিনে রিনারও মিনু আর খোকনকে খুব মনে পড়েছিলো তাই তাদেরকে দেখেই সে ভীষণ খুশি হয়ে যায়। মিনু আর খোকনদের নৌকার পিছনেই ছিলো আরেকটি নৌকা যেটাতে ছিলো দুইজন মিস্ত্রি আর রিনাদের ঘর মেরামত করার কিছু সরঞ্জাম। রিনার বাবা মা ছোট এই দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ের এমন উদারতায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মন ভরে তাদেরকে দোয়া করতে লাগলেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই দক্ষ ওই দুই মিস্ত্রি রিনাদের টিনের চালগুলো মেরামত করে দিলেন আর বন্যার পানি যেনো ঘরের ভিতর না ডুকে সেইজন্যে ঘরের বিভিন্ন অংশ বেশ পক্তভাবে উঁচু করে দিলেন। মিনু আর খোকনের এমন মহৎ কাজে গ্রামের সবাই তাদের খুব প্রশংসা করতে লাগলো, মিনু খোকনের বাবা মাও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রিনাদের ঘর মেরামত হওয়ার পর রিনা প্রতিদিন খুশিমনে বাবার সাথে নৌকা দিয়ে স্কুলে যেতো। আর স্কুল ছুটির পরেই মিনু, খোকন আর রিনা তিনজন মিলে স্কুলের পাশের বটগাছটার উঁচু শিখড়ের উপর বসে গল্প করতো। আষাঢ়ের এই ভিজে মেঘের দুপুরে তিন কিশোর কিশোরীর এমন উচ্ছ্বাসপূর্ণ হাসিখুশিতে আকাশের কালো মেঘগুলোও যেনো মিটমিট করে হাসতে লাগলো।

আরো পড়ুনঃ  পরিবর্তন কলমে ফারহানা মরিয়ম

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *