
ভ্যানচালক মা
জেরিন জাহান দিশা
রাত দশটা ।শহরের ভ্যানগুলো একটানা ছুটে চলেছে।যেন
একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। রাস্তায় ল্যাম্পের আলোতে
কারো মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।তবে একটু দূরে ভ্যানের ওপর মাথাগুজে একজন বসে আছে।নাম জাহানারা।
জাহানারা শুধু একজন ভ্যানচালক নারী নয়,একজন সংগ্রামী মা। জাহানারা একমাত্র ছেলে রাশিদুল। খুব কষ্ট
করে জাহানারা তাঁর ছেলেকে বড় করেছে। ছেলের পড়াশুনার জন্য লোকের বাড়িতে কাজ করেছে। তবু
ছেলেকে সে মূর্খ করেনি।
ছেলেকে নিয়ে জাহানারার অনেক স্বপ্ন তাঁর ছেলে একদিন
মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। অনেক টাকা রোজগার করবে।
জাহানারার স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ করে। কিন্তু সুখ তাঁর বেশিদিন
থাকল না। রাশিদুল বিয়ে করে কোটিপতির একমাত্র মেয়ের
সাথে। রাশিদুল ও তাঁর স্ত্রী জাহানারা কে ঘাড় ধাক্কা
দিয়ে বের করে দেয়।
সেইথেকে জাহানারা ভ্যান চালিয়ে রোজগার করছে। তাঁর
ছেলে তাঁর একটিবারো খোঁজ নেই না।আজ ও রাত গভীর হলে ভ্যান চালিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ঘরে ফেরে জাহানারা, তখন তাঁর ঘরে শুধু নীরবতা। ছেলের শৈশবের খেলনা, পুরনো বইগুলো তাকের ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে। মাঝে মাঝে সেসব দেখে চোখ ভিজে ওঠে।
তবুও ভাঙা মন নিয়ে তিনি বাঁচেন। কারণ তিনি জানেন জীবন থেমে থাকে না। ছেলে যদি মায়ের কথা না-ও ভাবে, আল্লাহ আছেন। ভ্যানচালক হয়েও জাহানারা নিজেকে শক্ত রাখেন। নিজের অশ্রু লুকিয়ে রেখে অন্যদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন।
রাতের শহরের বাতাসে যখন তাঁর ভ্যানের ঘণ্টা বেজে ওঠে, তখন মনে হয় এটা শুধু এক ভ্যানচালক নারীর নয়, এক মায়ের জীবনের সংগ্রামের সুর।ক্লান্ত শরীরটা মেঝেতে নামিয়ে বসতেই চোখে পড়ে কোণায় রাখা ভাঙা খেলনা গাড়ি।
একসময় রাশিদুল এই গাড়ি নিয়ে কত খুশি হতো!
জাহানারা মুচকি হেসে বলত, একদিন তুই আসল গাড়ি
চালাবি আর আমি তোর পাশে বসে থাকব।
আজ সেই ছেলের আলমারিতে নতুন গাড়ির চাবি আছে, বিলাসী জীবন যাপন কাটাচ্ছে তাঁর দিন । কিন্তু নেই
মায়ের জন্য এক মুঠো সময়, একবিন্দু ভালোবাসা।
চোখ মুছতে মুছতে জাহানারা হঠাৎ খালি ঘরের দেয়ালে তাকায়। সেখানে টাঙানো রাশিদুলের পুরনো স্কুলের ছবি।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে তিনি ধীরে ধীরে হাত বাড়ান, আঙ্গুল
দিয়ে ছেলের মুখটা ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলেন।বাবা,
বাবা, আমি কি এতটাই ভার হয়ে গেলাম তোর জীবনে? কিন্তু
কোন উত্তর আসে না। শুধু নীরব দেয়াল,ধুলো জমা ফ্রেমে
বন্দি ছবি। চোখের পানি আটকাতে পারছেনা জাহানারা।
ভ্যানচালকের হাতদুটো আকাশের দিকে তুলে কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলেন আল্লাহ আমার ছেলেকে সুখী রেখ সে যেন কখনো আমার মতো নিঃসঙ্গ না হয়। বাতাসের হাহাকার,
ভ্যানের শব্দ আর মায়ের দোয়ার সঙ্গে মিলেমিশে ঘরজুড়ে কেবল কান্নার সুর বাজতে থাকে।