লাল বেনারসি
নিলুফার জাহান রুবাইয়া
❝মাইয়াটার বিয়াটা না দিলেই কি নয়! মাইয়াটার বয়স যে অনেক কম। তাছাড়া ও এখনও পড়তে চায়। ❞ ❝তুমি তো জানোই আমাদের অবস্থা। একটা মাত্র ঘর সেখানে পাঁচটা মানুষ থাকা কি মুখের কথা!অনেক কষ্ট করে মাইয়াটার জন্য একটা ভালো সমন্ধ পাইছি। বাঁধা দিও না আর। মাইয়াটা আমাদের সাথে থাকলেই কষ্ট পাবে।শ্বশুর বাড়িতে গেলে অন্তত দু-বেলা ঠিক মতো খেয়ে পড়ে থাকতে পারবো।❞ ❝বলছিলাম কি ঘরের চালাটা মেরামত করতে হতো। বৃষ্টি হলে ঘরে যে পানি ঢুকে। এখন বৃষ্টিটাও কমছে এই সুযোগে কি করা যায় না? ❞ ❝দুই সপ্তাহ পরে মাইয়াটার বিয়া। ওর বেনারসি কেনার জন্য যে টাকাটা রাখছিলাম। সেই টাকা দিয়ে ঘরের চালাটা ঠিক করি।❞ ❝তাহলে মাইয়ার লাল বেনারসির কি হবে?❞ ❝এমনই ভাগ্য আমার যে মাইয়াটা জীবনে প্রথম কিছু একটা চাইছে সেটাও দিতে পারবো কি না সন্দেহ। হোক সমস্যা নাই। আমি যেমনে পারি দিবো৷ কালকে একটা কাজে ডাকছে দেখি ওখানে যদি কিছু পাই। আমি তো মাইয়াটার বাপ। আমারও তো কিছু দায়িত্ব আছে।❞ ❝ তুমি চিন্তা করিও না।আমি যে বাড়িতে কাজ করি। ওনারা যদি একটু সাহায্য করে কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে।❞ ❝তুমি যে বাড়িতে কাজ করো তার মাইয়ার যে বিয়ের কথা শুনছিলাম। হইছে?❞ ❝ না গো, মাইয়াটার জন্য পাত্রই পাওয়া যাচ্ছে না তেমন।❞ ❝ হায় খোদা! মাইয়াটার একটা গতি করে দাও।❞
এতক্ষণ কথা হচ্ছিলো মাইশার বিয়ে নিয়ে। সে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। নদীর পাড়ে তাদের ছোট একটা বাড়ি।পাঁচ সদস্যের অভাবের সংসারের কোনো ভাবে চলে যায় তাদের। মাইশার বাবা কাজ করতে শহরে যায়। দিন -দু’য়েক পরে বাড়িতে একটা লাশবাহী গাড়ি আর কিছু মানুষ এসে মাইশার মায়ের হাতে একটা লাল বেনারসি আর কিছু টাকা তুলে দিয়ে বললেন, ❝আপনার স্বামী কাজ করতে গিয়ে আট-তালা বিল্ডিং থেকে পড়ে গিয়েছে। আমরা জানি এই ক্ষতিপূরণ কোনো ভাবেই দেয়া সম্ভব নয়। তবুও আমাদের মালিক আপনার মেয়ের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছেন। এখানে কিছু টাকা আর মেয়ের বিয়ের বেনারসি আছে। মেয়ের বিয়েটা দিয়ে দিয়েন। আপনার স্বামীর শেষ ইচ্ছা ছিলো আপনার মেয়ের বিয়ে যেন না আটকায়।❞
মাইশার বাবার লাশটা তাদের ঘরের পাশেই দেয়া হলো। মাইশা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি নয়। যে বেনারসির জন্য তার বাবার প্রাণ গেলো সেই বেনারসি পড়ে সে কিভাবে বিয়ে করবে? সে কিছুতেই এই বিয়ে করতে পারবে না। তবুও মাইশার মায়ের কথায় সে বিয়ে করবে৷ কারণ হাজার কষ্ট হলেও তার বাবার শেষ ইচ্ছাপূরণ করেই ছাড়বে।
বিয়ের দিন আগের রাতে বৃষ্টি। খুব জোরেও না। সবাই ঘুমের ঘোরে। মাইশার ঘুম ভাঙ্গলেও ভাঙ্গেনি তার পরিবারের আর বাকি চারজন সদস্যের। নদীভাঙ্গনের কারণে রাতেই তারা চিরনিদ্রায় চলে যায়। ঘরের মধ্যে একটা মোটা কাঠ তার মায়ের ও ছোট ভাইয়ের মাথার উপরে পরে সেখানেই মারা গেছে। তার বাবার লাশটা নদীর স্রোতের সাথেই ভেসে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে তার শখের লাল বেনারসিটাও ভেসে যাচ্ছে। মাইশার রুক্ষ চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, তার মার্বেল আকৃতির চোখগুলো চেয়ে চেয়ে সবকিছু দেখছে।কিভাবে তার সবটা স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। শুধু তাদের ঘরটাই ভেসে গেলো। আশে পাশের ঘরগুলো ঠিকই রইল। এমনটা হবার কথা ছিলো না। নদীর পানি নিদিষ্ট সীমানার মধ্যেই আছে এর থেকেও কত ভয়ংকর ঝড় হয়েছে তখনও কিছুই হয়নি। অথচ গতরাতের সামান্য বৃষ্টিতে সবটা ভেঙ্গে-চুড়ে একা-কার হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে কেউ যে ইচ্ছাকৃত পাকা ধানে মই দিয়ে গেলো।
দশবছর পরে মাইশা ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আজ। সবকিছুই আগের মতোই আছে শুধু নেই তার বাবার কবরটা। নেই তার মায়ের সাজানো সংসার। মাইশারও নিজের সংসারটা সাজানো হয়ে উঠেনি আর। মাইশার মতো যেন কোনো নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানের আর কারো সংসার সাজানোর স্বপ্ন ভেঙ্গে না যায় তাই সে প্রতিবছর হাজারো ছেলে মেয়ের নিজ দায়িত্বে বিয়ে দিয়ে থাকে।যেটাকে আমরা গণবিবাহ বলে থাকি। তার কথা একটাই যে সেটার ভুগতো ভুগি সেটা যেন আর কেউ না হয়। এমন সময় তার পাশের বাসার চাচি আসে…..
আরো পড়ুনঃ অল্প কিছু শব্দে জানুন ফারাজ করিম চৌধুরী’র বিশদ জীবনী
❝তুমি কে মা?❞ ❝চাচি,তুমি আমায় চিনতে পারছো না? আমি মাইশা। ওই যে নদীভাঙ্গনে আমাদের ঘর ভেঙ্গে গেলো।❞ এই কথাটা শুনে চাচি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বললেন,❝মা, তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।❞ ❝তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো কেন চাচি?❞ ❝সেদিন যে নদীভাঙ্গনে তোদের ঘর ভাঙ্গেনি রে মা। তোর মা যে বাড়িতে কাজ করতো। তার মেয়ের বিয়ে না ঠিক হয়ে তোর বিয়ে ঠিক হওয়ায় সেই হিংসায় ওরা তোদের ঘরের সামনের বাঁধটা ভেঙ্গে দিয়েছিলো। সেই কাজে যে আমি সাহাস্য করছি রে মা। আমি যে তোর পরিবারের খুনি।❞ ❝কিহ! তুমি কেন এমনটা করলে চাচি? মায়ের সাথে তোমার কত ভালো সম্পর্ক ছিলো। নুনভাত যা খেয়েছি সব তো তোমাদের সাথে ভাগাভাগি করে খেয়েছি। তোমার কি লাভ হলো চাচি?❞ ❝আমি অর্থের লোভে এমন কাজ করছি রে মা। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না রে মা। পরের বছর নদীভাঙ্গনে যে আমারও সাজানো সংসারটা ভেসে গেছে রে মা।❞ ❝আর ওনার মেয়ের কি বিয়ে হয়েছে?❞ ❝হইছিলো ঠিকই রে মা। সে ঘরও যে তার কপালে জোটেনি। তার স্বামী তাকে তালাক দিছে।❞
❝জানো চাচি, কারো ক্ষতি চাইলে কখনোও নিজের ভালো হয় না। আমার সাথে যা করার করছো। দয়া করে আর কারো সাথে এমনটা করো না। আমার মা বাবা মূর্খ ছিলো৷ কিন্তু তবুও তারা কোনোদিনও কারো ক্ষতি চায়নি। অথচ কিছু মানুষ শিক্ষিত হয়েও অন্যদের ভালো দেখতে পারে না। আসলে প্রকৃত শিক্ষা তো আমাদের নিজের মন থেকে তৈরী হয়।❞
আরো পড়ুনঃ ফেসিয়াল প্যারালাইসিস কি ও ঘরোয়া চিকিৎসা