শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগিং; অসহায় বাবা মা কলমে সাজেদা সুলতানা কলি

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগিং; অসহায় বাবা মা
সাজেদা সুলতানা কলি

সেদিন ছিল প্রাঞ্জলের কলেজের প্রথম দিন। ওদের নবীণ বরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবার বাবা মা অন্য একটা রুমে অপেক্ষা করছে। আমরাও অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমাদের অপেক্ষাটা অন্য রকম ছিল। ওর বাবা আর আমি অপেক্ষা করছি কখন ওর টিচারদের সাথে একটু দেখা করতে পারবো, কথা বলতে পারবো। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কজন স্যার ম্যাডামের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। তাদেরকে অনুরোধ করলাম আমাদের ছেলেটাকে একটু খেয়াল রাখতে। এতদিন খুব সুন্দরভাবে শিক্ষকদের সহযোগিতায় এতদূর এসেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তারা যেন সবসময় ভালো থাকেন।

আমি মনে করি অটিজমের সাথে লড়াই করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনের জোর। আমার ছেলের বয়স এখন আঠারো চলছে। এই পর্যন্ত আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। রাতের পর রাত জেগেছি। দিনের বেলায় তার পেছনে পেছনে ছুটেছি। একটা সময় সে শান্ত হলো আমারও ছোটাছুটি কমে এলো। কিন্তু তাকে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত করতে এখনও সেই জার্নি চলমান। আমি জানি এটা আমৃত্যু চালিয়ে যেতে হবে। কারণ অটিজম কোন অসুখ নয় যে ওষুধ খেলে সেরে যাবে। আমাদের অবর্তমানে কিভাবে সে জীবন যাপন করবে সেটা ভাবলে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

ছোট বেলায় সেলুনে নিয়ে তাকে চুল কাটানো সম্ভব হতো না। ঘুমের মধ্যে মাথা ন্যাড়া করে দিতাম। ঘুম ছিল খুব পাতলা। একবার তো অর্ধেক চুল কাটার পর ঘুম থেকে জেগে উঠলে বাকিটা পরদিন ঘুমের মধ্যে কেটে শেষ করি। জামা কাপড় নিয়ে যা করতো সেটা আরও বিরক্তিকর। একটা জামা দিনের পর দিন পরতেই থাকতো। ধুতে পারতাম না। ধুয়ে দিলে সেটা আয়রণ দিয়ে শুকিয়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতো। পরে একদিন সেই জামা খাটের নিচে ফেলে দিই। একসময় ভুলে যায়। এভাবে একটার পর একটা অভ্যাস রিপিট হতেই থাকতো। এখনও হচ্ছে তবে অন্য প্যাটার্নে।

আরো পড়ুনঃ  রংপুরের লেখিকা নিলুফার জাহান রুবাইয়া'র সেরা গল্প “দাদুর বঙ্গবন্ধু”

মুখে মুখে ছড়া, কবিতা, সংখ্যা গণনা সব খুব দ্রুত শিখে যায়। সংখ্যা গণনা করতে করতে একদম শেষের দিকে চলে গিয়েও যদি ভুল করতো আবার প্রথম থেকে শুরু করতো। দেখে দেখে পড়াও তাড়াতাড়ি শিখেছে। কিন্তু লেখার প্রতি ছিল প্রচণ্ড অনীহা। আমি প্রচুর বাচ্চা দেখেছি মুখে অনেক কিছু পারে কিন্তু লিখতে চায় না। যাই হোক ওর বাবা আমাদের বাসার দরজায় চক দিয়ে লিখে তাকে লেখা শিখিয়েছে। এক্ষেত্রে অনেকে বোর্ড ব্যবহার করে। আমরা দরজাকেই বোর্ড বানিয়ে নিয়েছিলাম।

হাই স্কুলে পড়াকালীন কয়েকটা ছাত্র (শারীরিক মানসিক) খুব কষ্ট দিয়েছে। বিশেষ করে নবম দশম শ্রেণীতে উঠার পর তাকে দিয়ে ছাত্রীদেরকে বাজে কথা বলিয়ে নিয়েছে।

এখন পূজার ছুটি চলছে। মাত্র এক সপ্তাহ কলেজে ক্লাস করেছে। এখন পর্যন্ত তেমন কোন সমস্যা হয়নি। তবে দ্বিতীয় দিন কোন এক ছাত্র এক ছাত্রীকে দেখিয়ে তাকে বলেছে, “ওকে গার্লফ্রেন্ড বানাও”। জানি না সামনের দিনগুলো কি রকম যাবে। বর্তমানে মূল্যবোধের যে অবক্ষয় দেখছি সেখানে নরমাল ছেলে মেয়েদের মা বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে না। তাছাড়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে যে অত্যাচার চলে সেটা যদি বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের উপর চলে তাহলে আমাদের যেটুকু আশার আলো আছে সেটাও নিভে যাবে। স্পেশাল চাইল্ডরা বুলিংটা হয়তো সেভাবে অনুভব করতে পারে না কিন্তু র‌্যাগিংটা তো সরাসরি শারীরিক অত্যাচার।

বেশিরভাগ অটিজম আক্রান্ত শিশু/মানুষ দেখতে খুব সুন্দর। এদেরকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে তাদের কোন সমস্যা আছে। পরিচিত একজন তরুণকে তার সমবয়সী কিছু ছেলে অহংকারী বলে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছে। পরে অবশ্য তারা জানতে পেরেছে ছেলেটা তাদের চেয়ে আলাদা। বড় ধরনের কোন সমস্যাও হতে পারতো।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুলিং বা র‌্যাগিং মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। সহানুভূতি বা করুণা পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমার এই লেখা নয়। এটা পড়ে অন্তত একজনও যদি নিজেদের ভুল বুঝতে পারে সেটাই অর্জন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হোক অটিজম বান্ধব। নিরাপদে থাকুক আমাদের ‘স্পেশাল চাইল্ডরা’। নিরাপদে থাকুক সকল শিক্ষার্থীরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *