সামাজিক সংগঠন
বখতিয়ার উদ্দিন
কিশোর বয়সে অনেকে সংগঠন করে থাকে।তখন মনের আবেগে সব সময় সামাজ ও মানুষের জন্য কাজ করতে ইচ্ছে করে। চার পাঁচজন কিশোর জড়ো হয়ে ভালো কিছু করার উদ্দেশ্যে সংকল্প করে।
বয়স যখন তের-চৌদ্দ বছর তখন ডানা মেলে আকাশে উড়তে ইচ্ছে হয়। সাহসীকতায় শরীরে অনেক শক্তি আসে।পৃথিবীর সব বিষয়ে আস্তে আস্তে দেখতে শুরু করে।চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে। অনেক বিষয়ে শিখে।অনেক সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে।অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস আসে।
তখন সংগঠন করে এই সব কাজ করা যায়। তের চৌদ্দ বছর বয়সে বেশির ভাগ মানুষ সংগঠন করলেও কিন্তু সব বয়সের মানুষের কাছে সংগঠন করার নজির দেখা যায়। যারা সংগঠন করে তাদের মনটা সরল।যত বয়স হোক না কেন তাদের ভিতরে কিশোর বয়সের মনটা বেশি কাজ করে।
পৃথিবীতে যত মনিষী এসেছিলেন বা আছেন তারা কম বেশি সংগঠন করে গেছেন।আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ষোল বছর বয়সে হিলফুল ফুজুল( শান্তি সংঘ) নামে একটি সংগঠন করেছিলেন।তৎকালীন আরব সমাজের অরাজকতা দূর করার জন্য কিছু কিশোর নিয়ে সংগঠনটি করেছিলেন। সংগঠনের উপকারও হয়েছিল অনেক।বর্তমান পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বড় সংগঠন হলো জাতি সংঘ।যা আমাদের নবীর হিলফুল ফুজুল এর উৎস থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । এই ছাড়া আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সংগঠন রয়েছে। তবে এখানে আলোচনা করবো শুধু সামাজিক সংগঠনের কথা। যার পরিধি একটি পাড়ায়, সামাজে বা গ্রামে সীমাবদ্ধ থাকে ।যেকোন সচেতন সমাজে এই সব সংগঠন বেশি দেখা যায়।দেশে এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে সামাজিক সংগঠন নেই। এই সব সংগঠনের নেতৃত্ব দেন কিশোর থেকে শুরু করে যুবক,বৃদ্ধ এবং সমাজের সচেতন নাগরিকেরা। তবে বেশিরভাগ উদ্যোগী থাকেন কিশোরেরা।
কিশোর বয়সে কেউ একা থাকতে ভালোবাসে আবার অনেকে মনে মনে সঙ্গী খোঁজে।তখন চারপাঁচ জন ভালো উদ্যোগী মেধাবী সঙ্গী পেলে জড়ো হয়ে কোন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় ।ভালো সঙ্গী হলে ভালো আর খারাপ সঙ্গী হলে খারাপ পথে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
চারপাঁচ জনের দল থেকে কাউকে নেতা মেনে কমিটি গঠন করা হয়।তারা কমিটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক করে।সেই অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করে।
কিশোর বয়সে সমাজের অবহেলা, অনুন্নত ব্যবস্থা দেখে তার সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য মন আকুপাকু করে।সবাই জড়ো হয়ে কোন ভাঙ্গা রাস্তা মেরামোত বা কোন ছোট নদীর উপর পারাপারের জন্য সাঁকো তৈরি করতে পারে।
কিশোর বয়সে পড়ালেখার পাশাপাশি প্রচুর সময় পড়ে থাকে।সময় টুকু ভালো কাজে ব্যায় করতে ইচ্ছে হয়।আর আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অসাধু শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সারাদিন প্রাইভেট মুখী করে রাখে তাই তারা সমাজের আলো বাতাস দেখতে পায়না।বর্তমান সমাজে ভালো রেজাল্ট সাময়িক কাজে এলেও বাস্তবতায় পুঁথিগত বিদ্যা কাজে লাগানো কষ্ট।যারা সামাজিক সংগঠন করে তারা সমাজের বাস্তবতা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। মানুষের দুঃখ কষ্ট বুঝে।মানুষের সাথে কথা বলতে শিখে।যেকোন কষ্ট বা অভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।তাই প্রতিটি শিক্ষার্থীদের সমাজ জীবনের ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য সামাজিক সংগঠন করা প্রয়োজন।তারা সামাজিক সংগঠন থেকে সমাজের বাস্তবতা বিষয়ে প্রকৃতিগত ভাবে শিক্ষা অর্জন করে।
কোন কাজ করার জন্য একটি ভালো প্লাট ফরম থাকলে কাজটি যথাযথ ভাবে শেষ হয়।এই প্লাট ফরমটি যেকোন একটি সংগঠন হিসাবে ধরে নিতে পারি।সংগঠনের জন্য লাগে, ভালো এক জন নেতা বা সভাপতি,কয়েকজন সদস্য আর যথাযথ সুন্দর একটি সংগঠনের নাম।কার্যলয় বা অফিস না হলে চলে।একটি দুইটি কাজ করলে সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। একটি ভালো কাজ করলে আরো ভালো কাজ করতে ইচ্ছে করে। কিছু সংগঠন একটি দুইটি কাজ করার পর মরে যায়। সংগঠন ঠিকে থাকে কায্যক্রমের উপর।তবে নামের উপর সমাজে অনেক দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
সংগঠন যেকোন প্রকার হতে পারে।রাষ্ট্রও একটি সংগঠন। রাষ্ট্রেরও চারটি উপাদান থাকে।তেমনি সংগঠনের প্রয়োজনে কয়েকটি উপদান থাকে।এই সংগঠন থেকে এক সময় সরকার পর্যন্ত গঠন করতে পারে। যেমন, রাজনৈতিক দল কিন্তু একেকটা সংগঠন।
আমরা যদি সময় পায়, প্রথমে পরিবারের জন্য সময় ব্যয় করবো।মা-বাবা কি চাই তা দেখার চেষ্টা করবো। আর বাকি নিদিষ্ট একটা সময় সংগঠনের বা সমাজের জন্য ব্যয় করবো।সংগঠনের কাজ হবে,ব্যক্তিক,পারিবারিক, সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় কল্যাণ ও উন্নায়নমুখী।যেমন সংগঠনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময় সদস্যদের বুঝাতে গিয়ে বক্তব্য দিতে হয়। তখন নিজ থেকে বাকপটুতা চলে আসে।নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি ফোঁটে উঠে।
শৈশবে সংগঠন করতে গিয়ে কি কাজ করবে তা খোঁজে পায়না সদস্যরা। সেই ক্ষেত্রে আমরা কিছু কাজ করার জন্য একটি সুন্দর তালিকা তৈরি করতে পারি।যেমন:-
১.পাঠাগার
২.কুইজ প্রতিযোগীতা
৩.কোন রোগী দেখতে যাওয়া
৪.রাস্তা মেরামোত
৫.ক্রীড়ার আয়োজন
৬.বই পাঠ প্রতিযোগীতা
৭.ধর্মীয় কাজে আগ্রহ, শিক্ষা ও ধর্মীয় সভা করা
৮.ক্ষুদ্র পাঠশালা
৯.রাস্তা ঘাট পরিষ্কার
১০.রাস্তায় বাতির ব্যবস্থা
১১.শিশুদের ভালো কাজের উৎসাহের জন্য পুরস্কার
১২.মাদকের বিরুদ্ধে জন সচেতনতা
১৩.স্বাস্থ্য সচেতনতা
১৪.অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানব বন্ধন
১৫.কোন ভালো কাজে সম্মাননা
১৬.পথে ঘাটে জঙ্গল ও নালা পরিষ্কার
১৭.ভ্রমণ ও বনভোজন
১৮.বৃত্তি পরীক্ষা
এই ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী আরো অনেক বিষয় তালিকায় যুক্ত করতে পারি । এই সব তালিকা থেকে অর্থ আর সময় হিসাব করে যেকোন একটি বিষয় পছন্দ করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা যায়।
অর্থের উৎসের জন্য প্রাথমিক ভাবে সদস্যেদের সামান্য ফি ব্যবস্থা করলে অর্থের উৎস তৈরি হবে।তবে প্রয়োজনের বাহিরে বেশি ব্যয় করা যাবে না।কম ব্যয় আর কম শ্রমের মাধ্যমে বেশি কাজ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।তালিকায় অনেক বিষয় আছে যে,কোন অর্থ ছাড়া শুধু শ্রম ও মেধা দিয়ে বাস্তবায়ন করা যায়। কাজের মধ্যে আনন্দ উপভোগ করতে জানতে হবে।সংগঠনের আয়ের উৎস হিসাবে সমাজের অর্থশালীর কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়া যায়। তবে কাজটা সৎ ও সুন্দর ভাবে করতে হবে।
অনেক সংগঠনের সদস্যরা টাকা আয় করার মন মানসিকতা নিয়ে কোন একটি বিষয় আয়োজন করবে দেখিয়ে পোষ্টার, চিঠি,আর চাঁদার রসিদ তৈরি করে সমাজের মানুষ কাছ থেকে টাকা আদায় করে অপচয় করে।এটা কিন্তু ভালো না।খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কখনো সামাজিক কাজ করা যায় না।আবার অনেকে নিজেদের জাহির করার জন্য সংগঠন করে থাকে।যাই হোক মানুষ ঠকানো বা স্বার্থের জন্য নয়।সংগঠন করতে হবে নিঃস্বার্থ ভাবে।
কিশোর বয়সে সামাজিক সংগঠন করা নিছক খেলা মাত্র। খেলার ছলে সমাজ জীবনে অনেক কিছু হয়ে যায়। সামাজিক উন্নায়ন হয়।মন মানসিকতার বিকাশ ঘটে।মনে আনন্দ পাওয়া যায়। তবে জীবনে একটি নিদিষ্ট বয়স হলে অনেকে আর সংগঠন করে না।
সংগঠন করতে গেলে নেশা লাগে। এটা হবে ভালো নেশা।নেশা ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নয়। যিনি নেতৃত্ব দিবেন বা সামাজিক উন্নায়নের বাঁশি বাজাবেন তার যথাযথ মানুষের মনে ঢুকে যাওয়ার যোগ্যতা থাকতে হয়।সেই বাঁশি বাজিয়ে সদস্যদের কাজে উৎসাহ যোগাবে।আর সদস্যদের উচিত তাকে যথাযথ সহযোগিতা করা।নেতা কাজটি যথাযথ সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করবে।
সামাজিক সংগঠন করা সব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। সংগঠন করতে গেলে ভালো মন মানসিকতা লাগে। সৎ উদ্দেশ্য লাগে। যারা এই কাজ করে তারা একদিন ভালো ফল পায়।সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের,মানুষের সেবা করলে আল্লাহ খুশি হয়।সওয়াব পাওয়া যায়।পৃথিবীতে মানুষের আসার সাথর্কতা তৈরি হয়।সাংগঠনিক কাজ করতে করতে একদিন সমাজের বড় ধরণের কাজে নেতৃত্ব দিতে পারবে।এই ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে যেকোন কাজে দক্ষতা দেখানো যায়। তবে বার বার মনে রাখতে হবে,সংগঠন হবে নিঃস্বার্থ ভাবে। যাতে সমাজের, মানুষের এবং নিজের কল্যাণ সাধন হয়।মনে রাখতে হবে,একটি সুন্দর সংগঠন একটি সমাজের চেহেরা পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।সমাজ উন্নয়ন হবে।মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।সমাজে চুরি, ডাকাতি আর রাহাজানি কমে যাবে।