অপূর্ণতা কলমে ফাহিয়া হক ইন্নি

 অপূর্ণতা
কলমে ফাহিয়া হক ইন্নি

“আকাশের দিকে তাকিয়ে নিলয় বলে ভাবছ ভুলে গেছি আর ভালোই আছি, জানো না হয়তো কেউ কখনোই তার সবচেয়ে ভালো আর সবচেয়ে খারাপ স্মৃতিগুলোকে ভুলতে পারে না। সত্যি বলতে কোনো স্মৃতিই মানুষ ভুলে না, জানি না তুমি আমার সবচেয়ে ভালো স্মৃতি নাকি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো। যাই হোক তোমাকে ভুলি নি আমি আর হয়তো সম্ভবই না ভুলা, তোমাকে নিয়েই ছিলো আমার প্রথম পথচলা। ক্ষমা তোমাকে কখনোই করবো না এটা জেনে নাও”। আসলেই মানব জীবন বড়ই অদ্ভুত কারো মুখ দেখে কখনোই বোঝা যায় না সে কতটা সুখী বা দুঃখী।নিলয় খুবই সাধারণ ঘরের ছেলে, আর পাঁচটা ছেলের মতোই সেও ছিলো একটু চঞ্চল, তারা পাঁচ ভাই, ভাইদের মধ্যে সে চতুর্থ। নিলয় আর তার ছোটভাই বাহের ছিলো পিঠেপিঠি। বড় দুইজন ভাই প্রবাসে থাকেন ইতিমধ্যে তাদের বিয়েও হয়ে গেছে। নিলয়ের পড়াশোনায় মন বসতো না। আজ এর গাছ থেকে ডাব চুরি ওর গাছ থেকে পেয়ারা, মাছ ধরা, খেলাধুলো আর সিনেমা দেখেই অলস সময় পার করতো স্কুল পালিয়ে। বাবা মায়ের কাছে বিচার আসলে তারা নিলয়কে জিজ্ঞেস করে সে পড়াশুনা করবে কি না?নিলয় তখন ক্লাস সিক্স-এ পড়তো। সে তার বাবা-মাকে পরিষ্কার ভাবে জানায় সে তাঁর পড়াশোনা ভালো লাগে না। তার এই কথায় বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেয় প্রবাসে পাঠিয়ে দেবে। আর কিছু দিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দিলো প্রবাসে। খুব ভালো কাজ করতে পারতো সে। যেকোনো গাড়ির সব ধরনের সমস্যার সমাধান ছিলো এই ছোট্ট ছেলেটার হাতে। সময়ের সাথে সাথে বড় হয়ে উঠলো প্রবীসেই ।এতো ভালো মিস্ত্রির বেতনও খুবই ভালো ছিলো। কয়েক বছর পর ছয় মাসের ছুটিতে দেশে ফিরল নিলয়। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে চলে যায় বড় ভাবীকে আনতে তার বাবার বাড়ি। তার বড় ভাবীরা তিন বোন এক ভাই। নিলয়ের ভাবী সবার বড়। নিলয় দেশে আসার পর তার মেঝো বোন যারও বিয়ে হয়ে যায়। এক ভাই এবং সবচেয়ে ছোট বোন ময়ূরী যে তখন দশম শ্রেণিতে পড়ত।ময়ূরী দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি উচ্চতা আর গায়ের রং ফর্সা। ময়ূরীর রূপের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তার এই রূপ সৌন্দর্য্যকে ময়ূরের সাথে তুলনা করলেও সেই বেশি সুন্দরী হবে। একবার দেখাতেই যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে এমন। ময়ূরী স্কুল থেকে এসে ঘরে ঢুকতেই দেখে বসার ঘরে নিলয় বসে আছে। এত বছর পর ময়ূরী তো আর সেই বাচ্চা মেয়েটা নেই তাই নিলয় চিনতে পারে না কিন্তু বুঝতে পেরেছিলো এটা ই সেই ছোট্ট মেয়েটা যে তার ভাবীর সাথে তাদের বাড়িতে যেতো। সুন্দরী ময়ূরীর দিক থেকে নিলয় চোখ ফেরাতেই পারছিলো না। আর বেয়াই বেয়ানদের দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক তো আছেই। ময়ূরীকে দেখার পর থেকে নিলয়ের কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করতেছিলো, ময়ূরীকে ছাড়া যেন সবকিছু খালি খালি মনে হচ্ছে। নিলয় তার ভাবিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেও ময়ূরীর মায়াবি মুখ ভুলতে পারে না। তার বড় ভাই আর ভাবীকে সবটা বলে, তাঁরা এতে সম্মতি দেয়। ময়ূরীর পরিবারও কোনো বাঁধা দেয় না। কেননা নিলয় তো ছিল সোনার ডিম পারা হাঁসের মতো। টাকা পয়সা কোনো কিছুর অভাব ছিল না।

অনেকটা এ কারণেই ময়ূরীর বাবা-মা বোন রাজি হয়। আর অল্প অল্প করে ময়ূরী ও নিলয়ের প্রেমে গিয়েছিলো। নিলয়কে যদিও অন্যান্য মেয়ে দেখানো হয় কিন্তু তার মনে হৃদয়ে সবকিছুতেই যেন ময়ূরীর বস-বাস। নীলয়ের হৃদয় তৈরিই হয়েছিল যেন ময়ূরীকে রাখবার জন্য ,সবকিছুতে কে জড়িয়ে পড়ে ছিলো ময়ূরী। তাকে ছাড়া কোনো কিছু কল্পনাও করতে পারতো না নিলয়। হঠাৎ করেই, তার ইচ্ছে করছিলো ময়ূরীর সাথে দেখা করতে মেঝো ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে চললো। তাঁর ভাবির বাড়িতে ময়ূরীর সাথে দেখা করতে। কিন্তু বাড়িতে কিছুই বলেনি। দিনটা ছিল রবিবার ময়ূরীদের গ্রামে রবিবার ও বুধবারে হাট বসে।

নিলয় তাদের বাসায় অনেক ফল, মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে যায়। তাকে দেখে ময়ূরীর মা অনেক রান্নাও করে। ময়ূরীর পরিবার থেকে নিলয়কে বেশ পছন্দ করতো তাই তার প্রতি সবার একটা আলাদাই ভালোবাসা ফুটে ওঠে। নিলয় খাওয়া দাওয়া করে, সন্ধ্যা হয়ে গেলে ছোট্ট ইয়াসকে নিয়ে নিলয় চলে আসে তাদের বাড়িতে। তার বাবা-মা জানতে চাইলে তাদেরকে বলে, বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু ছোট্ট ইয়াস সবাইকে সত্যিটা বলে দিতে দেরী করল না। এতে সবাই বুঝতে পারলো ও নিলয়ের মনের অবস্থা।

তার বড় ভাই সাবের সাথে নিলয়ের একটু বেশিই মিশুক সম্পর্ক ছিলো। যার ফলে সে তার ভাইকে একটু বেশিই ভালোবাসে আর যেহেতু নিলয় সাবেরের শালীকেই বিয়ে করতে চাইছে তাইতো তার একটু হলেও জোর বেশি কারণ সে ময়ূরীদের বাড়ির বড় জামাই। ময়ূরীর বড় বোন নিলয় আর ময়ূরীর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। সাবের তার শশুড়ের কাছে নিলয় আর ময়ূরীর বিষয়ে আলাপ করে। সাবের তো জানত না তারা তার বলার আগে থেকেই রাজি। সাবের, নিলয় আর তাদের বাবা-মা সবাই চলল ময়ূরীদের বাড়ি। সাবেরের বউ এবং বাচ্চারা সেখানেই ছিল ময়ূরীকে দেখে বিয়ের দিন ঠিক করার জন্য। আর দেরী করতে চায় না কেউ। সেলোয়ার কামিজ পড়া ময়ূরীকে শাড়িতে এতোটা সুন্দরী লাগছিল যে নিলয় চোখ ফেরাতেই পারছিল না। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। নিলয় ময়ূরীকে তার হাতের মোবাইলটা দিয়ে এসেছিলো কথা বলার জন্য। বিয়ের দিন ঠিক করা হলো সামনে শুক্রবারই। হাতে মাত্র ৩ দিন সময়, দুই পরিবারেই রাজী থাকায় খুব অল্প সময়ে সবকিছু ব্যবস্থা হয়ে যায়। সবাই কেনা-কাটা, দাওয়াত দেয়া এবং সকল আয়োজন শুরু করে। নিলয় বিয়ের জন্য বিদেশ থেকে গহনা নিয়ে আসে প্রায় ১০ ভুড়ি, তিনটা গলার চেন, একটা মোটা কারুকাজ করা গলার হার, বালা, কানের দুল, আংটি টিকলি সহ সব। জাক-জমক আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হলো। নিলয়ের স্বপ্ন যেন পূরণ হলো।

আরো পড়ুনঃ  ভিজে মেঘের দুপুর | বৃষ্টির দিনে শৈশবের গল্প

বিয়ের সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর তারা বেড়াতে চলে যায় রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার সহ দেশের বেশ জনপ্রিয় পর্যটন স্থান গুলো। ময়ূরী ও নিলয়ের মাঝে অনেক সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে এতো দিনে। একে অপরকে মেনে চলা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা যত্ন কোনো কিছুরই কমতি ছিল না। তাদের একে অপরের মধ্যে ভালো বোঝাপরা ছিল কেউ কাউকে চোখে হারাতো না, এক মুহূর্তের জন্যও। ময়ূরী ছিলো সবার আদরের, যেহেতু তাকে সবাই ছোট থেকেই চেনে। ঘুরাঘুরি শেষে তারা বাড়িতে ফিরে আসে ময়ূরী নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। সে ছিল ঘরের লক্ষী বউ কারো মুখের উপর কখনোই কথা বলতো না। প্রয়োজনের বাইরে অপ্রয়োজনে যেন একটা কথাও বলতো না।

নিলয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো কিছুই করতো না। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি আর ঘুরে বেড়িয়ে নিলয় ও ময়ূরীর সময় খুব ভালো কাটছিলো। যতদিন যাচ্ছে নিলয়ের দিনও শেষ হয়ে আসছিলো আর নতুন একটা ভালো খবরও রয়েছে নিলয় বাবা হতে চলছে এবং ময়ূরী’র মা বাড়িতে নতুন সদস্য আসবে জেনে খুব খুশি। সবাই তাছাড়া নিলয় ময়ূরী ছিল সবার খুবই প্রিয়।

নিলয়ে বড় ভাবি ময়ূরীর বোনের দুটি ছেলে রয়েছে যাদের বয়স চার ও এক বছর। একজনের নাম সামী ও জামী। সাবের আর ময়ূরীর বোনের বিয়ের দশ বছর পর হয়েছিল সামী, সামীর দুই বছর নয় মাস পরই হয় জামী।

নিলয়ের মেঝো ভাই ফাহিমেরও ছিল একটা ছেলে, ইয়াশ। ফাহিমের বিয়ের এগারো বছর পর হয়, যদিও ফাহিমের আগে একটা মেয়ে হয়েছিলো ছয় মাস বয়সে মারা যায়। যেহুতু তার বড় দুই ভাইয়ের তুলনায় নিলয় আর ময়ূরী এত দ্রুত একটা সুসংবাদ দেয় এজন্য পুরো পরিবার একটু বেশিই খুশি হয়েছিল যা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আর নিলয় তো খুশিতে আত্মহারা। নিলয় সবকিছুতে ময়ূরীকে অনেক প্রাধান্য দিতো। সে এতোটাই ভালোবাসতো তাকে যে, তার জন্য জীবন ও দিয়ে দিতে দ্বিধা করতো না।

ছুটির দিন প্রায় শেষ আর মাত্র ৭ দিন। ময়ূরীর বাবা-মা তাদের বাড়িতে আসবে খুবই ভালো আয়োজন করা হয় অনেক রান্না বান্না শেষ হলে, এক সাথে দুপুরে খাবার খায়। খাবার খাওয়া শেষ হলে ময়ূরীর মা নিলয়ের সাথে একান্ত ভাবে কথা বলতে চায় এবং তিনি নিলয়কে বলে ময়ূরীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে বলে। নিলয় বলে আমি এখন চলে যাবো আর ময়ূরীকে এই অবস্থায় একা রেখে কিভাবে যাবো?

অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলল,
-না ,আমি কখনোই আমার পরিবার থেকে আলাদা হতে পারবো না।
ময়ূরীর মা এই কথা শুনে অনেক রেগে যান। বিকেলে তারা চলে যাওয়ার সময় ময়ূরীকেও তাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে, অনিচ্ছা শর্তেও নিলয় রাজি হয়।

সে ময়ূরীকে বলে,
-আমি চলে যাওয়ার আগের দিন ই তোমাকে নিয়ে আসবো। তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট যাবো। আমি জানি আমি চলে গেলে তোমার অনেক কষ্ট হবে। এটাও জানি তুমি সবকিছু সামলাতে পারবে না।সমস্যা নেই বড় ভাই আর ভাবীতো আছেই।

ময়ূরী পাহাড় পরিমাণ দুঃখ চেপে রেখে ঘাড় নাড়িয়ে বুঝালো তার কোনো কষ্ট হবে না।
নিলয়েরও কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই, বিনা বাধায় ময়ূরীকে যেতে দিলো তার বাবা মায়ের সাথে।

আরো পড়ুনঃ  বর্ষাকালের ভালো-মন্দ

ময়ূরীর মা যাবার পূর্বেও নিলেয়কে বললো
-আমার কথাটা ভেবে দেখো, নিলয়।
নিলয় মুখে হাসি নিয়ে বললো,
-মা আপনার মেয়েকে আমি ভালো রাখতে পারলেই তো চলবে!,
ময়ূরী মা একটু রাগী চোখে তাকালে ও নিলয় কিছুই মনে করলো না।

হঠাৎ করে ময়ূরীর কথা মনে পড়লো আর সেই মুহূর্তে ফোন আসলো ময়ূরীর। কান্না মাখা কণ্ঠে বললো নিলয়,
-ঠিক আছো তুমি?
কান্নাকাটি করছো নাকি?
ময়ূরী বললো
-না তো ,কান্না করছিনা।
-তাহলে কী শরীর খারাপ ?
হঠাৎ ময়ূরী চিৎকার বললো –
আপনাকে মনে পরছে খুব।
নিলয় বললো
-আরেহ ,পাগলী আমি তো তোমাকে বলি নি যেতে। মা এমন ভাবে বললো, এজন্য আর না করি নি। সমস্যা কোথায় ,আমি তো তোমাকে নিয়ে আসবো।
-একসাথে এয়ারপোট পর্যন্ত যাবো আর তোমাকে একা তো থাকতে হবে না আমাদের বাবুতো আসছেই তাই না?
কি হলো কিছু বলছো না কেন?
ময়ূরী ওপাশ থেকে বললো
-হুম, শুনছি বলুন আপনি।
-এখনো কী কষ্ট হচ্ছে তোমার ?
ময়ূরী বললো
-না, আম্মা খেতে ডাকছে।

নিলয়
-যাও ,ভালোভাবে খাবার খাবে। এখন কিন্তু তোমাকে দুই জনের খাবার খেতে হবে ।
ময়ূরী শুধু বললো,
-আচ্ছা।
তারপর কলটা কেটে গেলো। নিলয় বুক ভরা কষ্ট চেপে রেখে হেঁসে, মনে মনে বললো পাগলী আমার, জানিনা তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো? রাতের খাবার খেয়ে দুজনেই নিলয় ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ময়ূরীকে ফোন করলে, ফোন বন্ধ। নিলয় কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করলে, তখনও ফোন বন্ধ। নিলয় ময়ূরীর ভাইয়ের কাছে ফোন করলে, তাঁর ভাউ বলে সে বাজারে, ময়ূরী ঠিক আছে। ফোনে চার্জ নাই, এজন্যই বন্ধ দেখাচ্ছে বাড়িতে গিয়ে সে ফোন করবে নিলয়ের কাছে।

নিলয় আজ তার মেঝো ভাবীকে আনতে তাদের বাড়িতে যাচ্ছে একারণে খানিকটা ব্যস্ত তারপরও ময়ূরীর কথা বারবার মনে পড়ছিলো নিলয়ের।অনেকবার কল করলেও ফোন বন্ধ। নিলয় ভাবে একটা দিন থাকুক নিজের মতো, এই ভেবে সে আর কল করে না।

ভাবীকে বাড়িতে নিয়ে এসে নিলয় রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পরে। রাত তখন দশটা বা বারোটা।
কলের শব্দে নিলয়ের ঘুম ভাঙ্গলে কল রিসিভ করে ময়ূরীর কন্ঠস্বর শুনে।

ওই প্রান্ত থেকে ময়ূরী কান্না-মাখা ভীত ইতস্তত কন্ঠে বলে,
-আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন তো? আমি অনেক বড় ভুল করেছি।
নিলয় অনেক চিন্তিত হয়ে পরে ময়ূরীর কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছিলো ময়ূরীর কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার কথা গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসছে।

নিলয় বলে,
-কি করছো আগে বলো তুমি? কি হয়েছে তোমার?
ময়ূরী হাজারো কষ্ট নিয়ে বলবো আগে বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন কি না? নিলয় রেগে গিয়ে বললো, তুমি আগে বলো তো তোমার কি হয়েছে? ময়ূরী বললো দয়া করে ক্ষমা করুন। আর কখনোই দেখা হচ্ছে না আমাদের। নিলয় কিছু বলতে যাবে তখনই কলটা কেটে গেল। নিলয় অনেক বার কল করলেও ওপাশ থেকে কেউ আর কল রিসিভ করে না। চিন্তায় চিন্তায় রাতটা জেগেই কাটিয়েছে। সকালে ময়ূরীর কাকাতো বোন মিলি নিলয়কে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে ‘তুমি আমার বোনকে কী বলেছিলে, যে সে সুইসাইড করেছে; ময়ূরী আর নেই।

মিলির কথা শুনে যেন নিলয়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল। কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরি চুপ হয়ে পরে নিলয়। তখনই ময়ূরীর ভাই মইনুল নিলয়কে কল করে বলে ময়ূরী মারা গেছে। রাত থেকে ময়ূরীর অনেক বমি হচ্ছিলো ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সময় মারা গেছে। মইনুল আর মিলির কথার মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছিলো না নিলয়। তাড়াতাড়ি তার বাবা-মা, ভাই ভাবীকে ডেকে ময়ূরীর মৃত্যুর সংবাদ দিলে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। নিলয়ের মা তো শুনে কান্না করতে করতে অজ্ঞান প্রায়। বারবার এক কথা বলছিলেন, গত পরশু আমার সুস্থ বৌমা ওই বাড়িতে গিয়েছে আজ শুনছি ও নেই। আমি বিশ্বাস করি না এটা।
কেউ ই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তখন
তারা সবাই ময়ূরীদের বাড়িতে যাবে ঠিক করলে।

হঠাৎ, ময়ূরীর বড় বোন নিলয়ের ভাবী পুরাতন শাড়ি পড়ে শাড়ির আঁচলে ময়ূরীর আর তার যত গহনা ছিলো তা নিয়ে হাতে নিয়ে নিলয়কে বলে
-তোমার জন্য আজ আমার বোনের এ অবস্থা। আমি তোমার ভাইয়ের সংসার করবো না। তোমার জন্য আমার বোন মারা গেছে। এই বলে একাই তাদের বাড়ির জন্য বের হয়ে যায়।

আরো পড়ুনঃ  অপূর্ণতা কলমে তাহমিনা আক্তার

সাবের তার বৌয়ের এই অদ্ভুত আচরণে রেগে যায় এবং সবাই ময়ূরীদের বাড়িতে যায় নিলয় ছাড়া।ময়ূরীর মুখ দেখবে না নিলয়। অনেক রাগ জমে গিয়েছে ওর প্রতি। নিলয় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় একাই। সবাই ময়ূরীদের বাড়িতে গিয়ে দেখলো ময়ূরীকে কাফনের কাপড় পরিয়ে রেখেছে। কেউ বিশ্বাস করতেই পারছিলো না ময়ূরী আর বেঁচে নেই। নিলয়ের মা আবার অজ্ঞান হয়ে যায়।নিলয়ের বড় ভাই পুলিশ স্টেশনে যায় ময়ুরীর মা-বাবা বোন-ভাই সবার নামে মামলা করে। কারণ, ময়ূরীর মৃত্যুর আসল কারণ কেউই বলছিল না। বাধ্য হয়ে পুলিশ ময়ূরীর শরীরকে মর্গে পাঠায় পোস্টমডেম করার জন্য। ওই দিন বিকেলে ময়ূরীর চাচাতো ভাইয়ের বৌ নিলয়কে কল করে আর ময়ূরীর মৃত্যুর কারণ বলে, তিনি নিলয়কে বলে ময়ূরীর কবরে তার ছোয়া মাটি দিয়ে যেতে, কিন্তু সবটা শুনে নিলয়ের অভিমান আরো বেড়ে গেলো।

ওই ভাবী বললেন ময়ূরীর মা চাইতেন ময়ূরী যাতে পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে কিছু করতে পারে।ময়ূরীর বাবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা আছে তাই পড়াশোনা করলে খুব সহজেই সরকারী চাকরী পেতে পারবে। ময়ূরীর মা উনার বড় মেয়ে কেউ সাবেরের বাঁধার পরও উনি বাড়িতে এনে উন্মুক্ত থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ায়, সাবের জানেন না এসব।

কবিতাঃ ছোট্ট রাসেল কলমে ফাহিয়া হক ইন্নি

তিনি চেয়েছিলেন নিজের কাছে রেখে ময়ূরীকে এভাবে লেখাপড়া করাতে। কিন্তু নিলয় তাতে রাজি হয় না। তার উপর যদি ময়ূরীর বাচ্চা হয় এটা অনেক বেশি ঝামেলা হয়ে যাবে, তিনি চাইছিলেন না ময়ূরীর সন্তান নিক এত তাড়াতাড়ি। এজন্যই তিনি ময়ূরীকে ওইদিন উনার সাথে নিয়ে আসেন এবং রাতে ময়ূরী নিলয়ের সাথে কথা বলার পর মা ময়ূরীর ফোন কেড়ে নেয় এবং বন্ধ করে রেখে দেয় । তিনি চেয়েছিলেন বাচ্চাটা অ্যাভোরেশন করিয়ে নষ্ট করে দিতে। পরের দিন দুপুরে ময়ূরীকে ঔষধ এনে দিলে ময়ূরী তা খায়। তখন থেকেই ময়ূরীর শরীর খারাপ হতে থাকে। বিকাল থেকে রক্তপাত হচ্ছে রক্ত কোনোভাবে বন্ধ হচ্ছে না, রাত হতে থাকে আর শরীরের সব রক্ত ময়ূরীর প্রায় বের হয়ে গিয়েছে। ঘর পুরো রক্তে ভরা এবং জামাকাপড় রক্ত ভিজে একাকার পাঁচ ঘন্টা হয়ে গেল ময়ুরীর পুরো শরীর সাদা হয়ে গিয়েছে, দুপুর থেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো আর তার মা তাকে ব্যাথা সহ্য করতে বলছিলো। দেখতে দেখতে পাঁচ ঘন্টা মেয়েটা মরণ যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও বুঝতে পেরেছিলো ও কত বড় ভুল করেছে ওর মায়ের কথা শুনে আর মনে মনে বলছিলো আমি কেন খেলাম? আমি কেন উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম না উনার অনুমতি ছাড়া কেন এটা করলাম? এ অনুভব করতে পারছিলো ওর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। ওর এবার সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে সাথে সাথে তার মায়ের কাছে বার বার অনুরোধ করে ওর ফোনটা দেওয়ার জন্য ‘ও একবার ওর স্বামীর সাথে কথা বলতে চায়। এতোক্ষণে ময়ূরীর মায়ের মনেও মেয়েকে হারানোর ভয় ঢুকে গিরেছিলো। এজন্যই হয়তো উনি ময়ূরীর ফোন আলমারি থেকে বের করে দেয় এবং তখন ময়ূরী নিলয়ের সাথে শেষ বারের মতো কথা বলে, এবং এই ক্ষমা চাওয়া এবং কথা বলাই ময়ূরীর জীবনের শেষ কথা ছিলো। শরীরে মৃত্যু যন্ত্রনা নিয়ে কাতরাতে কাতরাতে ভাঙ্গা নরম কন্ঠে বলা কয়েকটা অক্ষরই তার জীবনের শেষ কথা বলা, নিলয় তার পর চোখের পানি ধরে রাখতে পারে নি এসব কথা শুনে। বুক ভরা রাগ ও অভিমান নিয়ে কবরস্থান থেকে অনেক দূরে থাকা ব্রিজের উপর থেকে দেখছিলো, তার প্রিয়তমাকে সাদা কাফন পরিয়ে কবরে রেখে আসতে যাচ্ছে, সবাই দূর থেকেই দেখছিলো নিলয় কাঁদছিল।

আজ আঠারো বছর পরও নিলয় ময়ূরীকে ভুলে নি আর ক্ষমাও করে নি। নিলয়ের অভিমান শুধু একটা ই ময়ূরী চাইলেই তাকে জানাতে পারতো সবটা। কেন জানায় নি? সাবেরও তার বৌ কে আনে নি। সবার জোরাজোরিতে নিলয় বিয়ে করে তার আপন ফুপাতো বোনকে। সাবেরও সামী জামীকে দেখাশোনা করার জন্য আবার বিয়ে করেন। সবকিছু ভালো ভাবেই চলছে, তারপরও কিছুই ঠিক নেই।

অপূর্ণতা কলমে ফাহিয়া হক ইন্নি

লেখিকা’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ  ফাহিয়া হক ইন্নি। জন্ম ১৫ই অক্টোবর ২০০৬। মাতা রাবেয়া খাতুন এবং পিতা মো.তুহিন। বর্তমান ঠিকানাঃ মেরাজনগর ,কদমতলী ,ঢাকা। বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি(২০২৩) পরীক্ষা দিয়েছেন। কবিতা পড়তে পছন্দ করেন। রোমান্টিক কবি/লেখিকা হিসেবেই পরিচিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *