কুহেলী
উম্মি হুরায়েরা বিলু
হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর দিয়ে, হিমেল হাওয়া কে সঙ্গী করে,কুয়াশার চাদর আবৃত করে ধরায় আগমন ঘটেছে শীতকালের।
সোনার বাংলার এই পাতা ঝরার মরশুমে বৃক্ষরাজী তাদের সকল শুকনো পাতা ঝরিয়ে নতুন রূপে সেজে ওঠার প্রস্তুতি নেয়।
মৃদু রোদের তাপ ও শিশির ঝরা রাত নিয়ে শীত আসে উদাসী সন্ন্যাসীর বেশে।
শীতের কোনো প্রাণোচ্ছল রূপমাধুরী নেই, সে রিক্ত, ধ্যানমগ্ন মহাতাপস।
শীত যেনো পথশিশুদের কাছে এক ভয়ংকর দানবের নাম।
শীতের এই রিক্ততা তাদের মনকে বিষাদের কালো মেঘে ছেয়ে দেয়।
জীর্ণ শীর্ণ নিঃস্ব মানুষ গুলোর কাছে শীত এক মহা প্রলয়ের নাম।
তাদের মনে ধরা দেয় না শীতের মৃদু রৌদ্র তাপের সৌন্দর্য কিংবা শিশির ঝরা রাত অথবা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরবেলা।
তাদের মনকে আকুল করতে পারে না ধোঁয়ার মতন বাষ্পকণা উড্ডীন নদী ও পুকুরের জল।
আমাদের চোখে শীতের সকালের শোভা অতি অনুপম,
ভোরের আলো যখন স্পর্শ করে পৃথিবীতে ঘন কুয়াশার আবরণে গাছপালা অস্পষ্ট,মনে হয় গোটা পৃথিবীটা যেন এক রূপকথার মায়াপুরী।
কিন্তু পথশিশুদের কাছে শীতের সকালে গোটা পৃথিবীকে মায়াপুরী নয় বরং মৃত্যুপুরী মনে হয়।
কুহেলী সেও একজন পথশিশু, সে পথশিশু হয়ে জন্ম নেয়নি।
পরিস্থিতি আজ তাকে পথশিশু হতে বাধ্য করেছে।
সেও তার বাবা মায়ের রাজকন্যা হয়েই জন্ম নিয়েছিল।তবে ভাগ্য আজ তাকে পথশিশু হতে বাধ্য করেছে।
তার বয়স যখন চার তখন হঠাৎ বাবা স্ট্রোক করে মারা যায়।
বিধবা মায়ের তখন আর ঠাই হয় না বাবার বাড়ি,ছোট কুহেলীকে নিয়ে পাড়ি জমাতে হয় মামার বাড়ি।
মামাদের সংসারেই চাল আনতে ডাল ফুরিয়ে যায়,সেখানে দুটো মানুষের খাওয়া দাওয়া অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাড়ায়।
বাধ্য হয়ে ছোট কুহেলীকে সাথে করে নিয়ে কাজের জন্য পাড়ি জমায় ঢাকাতে,
একজন প্রতিবেশী তার এক আত্মীয়র বাসায় দুই জনের থাকা খাওয়া আর চার হাজার টাকা বেতনে চাকরিটা জোগাড় করে দেয়।
কে জানতো এই ঢাকার শহর তার কাছ থেকে সব কেঁড়ে নিবে,
কে জানতো বাবা মায়ের আদরের রাজকন্যা কুহেলী থেকে পথশিশু কুহেলী বানিয়ে দিবে তাকে।
ঢাকায় আসার পথে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মারা যায় কুহেলীর মা।
ছোট কুহেলী একা হয়ে পড়ে,মায়ের কাছে একটা বাটন ফোন ছিল তাও ভেঙে যায়,
কি করে করবে মামার সাথে যোগাযোগ? কোথায় যাবে ছোট কুহেলী?
তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এক বৃদ্ধ,
ফোন থেকে সিমটা খুলে তার ফোনে সেট করে ফোন করা হয় মামাকে,
তখন মামা মায়ের লাশ এবং তাকে নিতে অশিকার করে।
তখন পুলিশ এসে বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে নিয়ে যায় লাশটা।
কিন্তু ভিড়ের মাঝে মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যায় কুহেলী, শেষ দেখাও হয় না মায়ের সাথে।
আস্তে আস্তে ভিড় কমে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়,
শুধু একা পড়ে থাকে কুহেলী হয়ে ওঠে রাজকন্যা কুহেলী থেকে পথশিশু কুহেলী।
শীতের হিমেল হাওয়া তাকে আনন্দ দেয় না বরং কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়,
না আছে ভালো থাকার জায়গা, না আছে শীতের সোয়েটার, না আছে ঘুমানোর মতো জায়গা।
শীতের সকালে আমাদের চোখ গরম লেপের আবেশে বন্ধ হয়ে আসে,
আর কুহেলীদের মতো শিশুর ঘুম কেঁড়ে নেয়।
কে জানতো তার নামের মতো তার জীবনটাও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যাবে,
এতোটাই আচ্ছন্ন হয়ে গেলো জীবন নামক আলোর প্রদীপ আর হয় তো কোনো দিন আলো ছড়াবে না।
আজ মনে হচ্ছে তার নাম সার্থকতা পেলো,কুহেলী হারিয়ে গেলো কুহেলীরই ভিড়ে।
এমন হাজারো কুহেলী রয়েছে এই দেশে আমাদের সকলের উচিত নিজের সাধ্য মতো তাদেরকে একটু ভালো রাখার চেষ্টা করা,কুহেলীর ভিড়ে তাদের জীবন নামক প্রদীপকে হারিয়ে যেতে না দেওয়া,
তাই তো ছন্দ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—
তারাও মানুষ আছে তাদের
বাঁচার অধিকার,
সুন্দর একটা জীবন দানে
এগিয়ে আসো সরকার।
হারাতে দিও না তাদেরকে
কুহেলীর ভিড়ে,
পৌঁছে দেও পথশিশুদের
সুন্দর এক নীড়ে।
শীতের দিনে গরম কাপড়
সকলের গায়ে উঠুক,
পথশিশু নয় সকল কুহেলী
ফুল হয়ে আজ ফুটুক।