বাবাকে নিয়ে গল্প | লেখেছেন সানজিদা সাবিহা

বাবাকে নিয়ে গল্প
 অমিত আমাদের ভার্সিটির ফাস্ট বয়। সেই কলেজ লাইফ থেকে তার সাথে আমার পথ চলা। প্রখর মেধার অধিকারী সে। একের পর এক জয় ছিনিয়ে আনছে, তার মেধার জোরে।
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। অমিত আমাদের ভার্সিটি থেকে গোল্ড মেডেলের এওয়ার্ড পেয়েছে। সবাই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আমরা সব বন্ধুরা মিলেই এই ট্রিট চাইলাম। অমিতও রাজি হয়ে গেল। সাথে এ-ও বলল, আজ নাকি সে তার বাবাকেও নিয়ে আসবে।
ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হওয়া তীব্র ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নানা কারণে আর তা হয়ে উঠেনি।
অমিতের মুখে তার বাবার গুণগান বহু শুনেছি। অমিত তার বাবাকে নিজের আদর্শ মনে করে। সে ভাবে আজকের এই স্থানে সে আসতে পেরেছে একমাত্র তার বাবার জন্য। বেশ পরিপাটি হয়ে আমি, সৌভিক আর নিশাত রেস্টুরেন্টে আসলাম। সবার গায়েই অভিজাতীয় পোশাক। তৃষ্ণার্থ চোখে আমরা তাকিয়ে আছি, রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে।
আমরা আসার মিনিট পাঁচেক পর অমিত রেস্টুরেন্টে আসে। তার সাথে একজন বয়োবৃদ্ধ লোক। অমিত লোকটির একটা হাত ধরে রেখেছে। লোকটাকে ভালোভাবে আমরা পরখ করতে লাগলাম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে। চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে। পরনে অতি সাধারণ কাপড়ের সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনো অজপাড়াগাঁয়ের কুঁজো বুড়ো। অমিত এসে তার বাবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল।
ভদ্রতার খাতিরে আমরাও দুটু কথা বললাম।
কিন্তু সেই উৎফুল্ল মন নিয়ে এখানে এসেছিলাম, তা আর আমাদের মাঝে বিরাজমান নেই। বিরক্তিরা এসে জমা হয়েছে, আমাদের তিনজনের মাঝেই।
এই আধা মরা লোকটাকে নিয়ে অমিত এতো গর্ব করত! এটা যেন আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমরা ভেবে ছিলাম, অমিত কোনো অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু আজ তো দেখছি, সে গ্রামের কৃষকের সন্তান। অমিতকে দেখে তা বুঝার কোনো উপায় ছিল না, সে একজন দরিদ্র ঘরের সন্তান।
অমিত তার বাবাকে একটা চেয়ার টেনে বসাল। ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করল।
আমি অমিতকে একটু সাইডে ডাকলাম।
বাবাকে বসিয়ে রেখে অমিত একটু দূরে আমাদের কাছে আসল।
—এখানে ডেকে আনলি কেন? কিছু বলার থাকলে তো বাবার সামনেই বলতে পারতি।
আমি একটু আমতা আমতা করতে করতে এক সময় বলেই ফেললাম।
—উনি তোর বাবা? এই বাবাকে নিয়ে এতো গর্ব তোর?
তোর মুখে উনার গল্প শুনে মনে করেছিলাম, উনি হয়তো কোনো বড় শিল্পপতি। কিন্তু এখন তো দেখছি…
আমার কথা শেষ হতে না হতেই নিশাত বলে উঠে, ‘এই বুড়োটাকে এখানে নিয়ে আসার কি খুব দরকার ছিল? কোথায় ভাবলাম, আজ সবাই মিলে অনেক আমোদ ফূর্তি করব, সবটাই মাটি করে দিলি।
অমিত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাদের কথা হজম করছে। এর মাঝে সৌভিক ‘ধ্যাত’ বলে শার্টের দু-একটা বোতাম খুলে ফেলে।
অমিত এবার মুখ খুলে।
আরো পড়ুনঃ বাবাকে নিয়ে বাছাই করা সেরা কবিতা গুলো
আরো পড়ুনঃ  আধুনিকতার আবরণ কলমে মালুফা ইসলাম
—হ্যাঁ উনিই আমার বাবা। উনিই আমার আদর্শ। উনি গরিব না ধনী, তা আমার জানার প্রয়োজন নেই। আমি যেটা জানি সেটা হলো উনি আমার বাবা। উনি না থাকলে আমি এই পৃথিবীতে, আজ তোদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।
এই যে আজ আমি, তুই, আমরা এত বড় ভার্সিটিতে পড়ছি, শহরে ভালো পজিশন তৈরি করেছি, সমাজে সম্মান লাভ করেছি একমাত্র এই বয়োবৃদ্ধ বাবাদের উছিলায়। তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার ফল ভোগ করছি আমরা।
আমাদের বাবা গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বলে আমরা তাদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে, ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে অনীহা দেখাই। আমরা ভাবি বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বাবাকে কোথাও নিয়ে গেলে আমাদের ব্যক্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। অথচ আমরা যখন ছোট ছিলাম, কারণে-অকারণে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তাম, নানা বায়না ধরতাম তখন এই বাবাই আমাদের নিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে বা খাওয়াতে অনীহা দেখাতেন না। একবার নিজের ব্যক্তিত্ব সংকটের কথা চিন্তা করতেন না।
কি বিচিত্র আচরণ আমরা করে থাকি একে অন্যের সাথে তাই না।
অমিত কিছুক্ষণ চুপ দম নিয়ে নিল। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,
—বাবার মর্যাদা তুই কি করে বুঝবি সজীব? তোর কাছে তো তোর বাবা রাস্তার ভিখারি। সেদিন তো তোর বাবাকে এই বলেই পরিচয় দিয়েছিলি তাই না?
বাবাকে নিয়ে গল্প , বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস পিক
অমিত আবারও বলতে শুরু করে, ‘বাবা যেন অন্য একটা পৃথিবীর নাম। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের সদা কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। টিকে থাকার লাড়াইটা সু-প্রভাত থেকে শুরু করে, সন্ধ্যা অবদ্ধি করতে হয়৷ কিন্তু বাবা নামক পৃথিবীতে থাকে না কোনো গ্লানি, ক্লান্তি, বেঁচে থাকার লড়াই। মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই তা পূর্ণতায় রূপ পায়।
আমাদের প্রতি মাসে বাবা নতুন নতুন জামা জুতা কি দেন। নতুন কাপড় পেয়ে আমরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। কিন্তু একটাবার দেখার চেষ্টা করি না বাবা জোগাড় করতে সেই কবেই তিনি বিদায় জানিয়েছেন, তার জীবনের শখ আরাম আয়েশকে। রোজ তিনি ভিড়ের মাঝে বাসে ঝুলে ঝুলে বাড়ি ফিরেন। ক্লান্ত শরীরটা বিছানার ছোঁয়া পেতে আকুপাকু করতে থাকে। কিন্তু তখনো ক্লান্তি উনাকে বশ করতে পারে না। হাঁটু ভাজ করে বসে আমাদের পিঠের উপর বসিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলেন। আমাদের ফোঁকলা দাঁতের খলখলানিতে বাবার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
বাবার দেয়া সেই কবের একশো টাকার নোটটা এখনো নাকের কাছে নিলে ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা যখন বসুন্ধরার দামি দামি পোশাক পড়ার বায়না ধরতে ব্যস্ত তখন বাবা ফুটপাতে কম দামে নিজের জন্য কিছু কেনা যায় কি-না তা দেখতে ব্যস্ত। বাবা এমন একটা বটবৃক্ষ যা আমাদের আজীবন নিঃস্বার্থভাবে ছায়া দিয়ে যাবে। যতই আমরা তার সাথে খারাপ আচরণ করি বাবা কখনো আমাদের খারাপ দোয়া দেন না। কারণ উনি জানেন পিতা-মাতার খারাপ দোয়া সন্তানকে মুহূর্তের মাঝেই নিঃশেষ করে দিতে পারে।
তাই উনি হাসি মুখে সবসময় বলেন, ‘ছোট তো তাই বুঝতে পারে না, কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল।’
আমরা ফুলের সৌন্দর্য দেখে মাটির ভুমিকার কথা যেমন ভুলে যাই তেমনি সমাজের উঁচু পদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এতোদূর আসার জন্য যে মই (বাবা) ব্যবহার করছি তাকেই লাথি মেরে ফেলে দেই।
বিরক্তি আর শত তিরষ্কারের সাথে তাকে আমরা বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসি।
কিন্তু আমরা ভুলে যায় যে, আমরাও ধীরে ধীরে বাবা হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজ আমরা আমাদের বাবার সাথে যে আচরণ করব কাল আমাদের সন্তান তেমন আচরণ করবে।
অমিত আর কিছু না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করে। ততক্ষণে খাবারও চলে এসেছে। বৃদ্ধলোক (অমিতের বাবা) কাঁপা কাঁপা হাতে খাবার মুখে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুখে দেয়ার আগেই তা ঝরে পড়ে যাচ্ছে। অমিত আরেকটা চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসে পরম যত্নে লোকমা তৈরি করে বাবার মুখে তুলে দেয়। আমাদের মতো রেষ্টুরেন্টের সবাই অবাক হয়ে বাবা ছেলের প্রেমময় মুহূর্ত উপভোগ করছে। বৃদ্ধ লোকটির বয়োবৃদ্ধ শুষ্ক চোখের গণ্ডি বেয়ে দু’ফোটা অশ্রু বেয়ে পড়ল। এই অশ্রু দুঃখের নয়, সুখের। এক পরম তৃপ্তির।
আমার চোখের কোণাও ভিজে এসেছে। মনে মাঝে কাজ করছে অপরাধবোধ। ইশ! আমি যদি আমার বাবাকে অবহেলা না করে বুকে আগলে রাখতাম, তাহলে হয় আমার বাবার মুখের হাসির কারণ হতে পারতাম। কিন্তু আমি সে সুযোগ হারিয়ে ফেলেছি। না না হারায়নি বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। অহংকারের অতল গহ্বরে এমনভাবে ডুবে গেছিলাম যে, বাবার কবরটা দেখার প্রয়োজন মনে করিনি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে বাবা ফিরে এসো এই অধমের কাছে। একটা! জাস্ট একটা সুযোগ দাও সব পাপ ধুয়ে মুছে তোমার বুকে মাথা গুঁজার। কিন্তু আফসোস আমার আজকের এই আকুতি আর্তচিৎকারে বাবার আর সাড়া দেবে না।
নিয়মিত পড়ুন এবং লেখুনঃ- চিরকুটে সাহিত্য 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *