নিয়তি কলমে সাদিকা তানজিম

নিয়তি
সাদিকা তানজিম

 

—মাই গড! তারপর? তারপর কী হলো?

নুজহাত এতক্ষণ জ্বীনের গল্প করছিল। রাহার কথায় থেমে গিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল—
তোকে আমি গল্প শোনাবোই না! একটু পর পর তারপর কি হলো? তারপর কী হলো? বলতে বলতে কানের মাথাটা খেয়ে নিচ্ছিস!

রাহা সরি বলার ভান করে বলল— আচ্ছা আর বলব না।

নুজহাত ভয়ার্ত কণ্ঠে ও গম্ভীর মুডে গলার স্বর উঁচু-নিচু করতে করতে বলা শুরু করল— তখন মাদ্রাসা বন্ধ ছিল! দ্বিতীয় সাময়িক পরিক্ষার বন্ধ। সবাই চলে গেছিল, শুধু ওই আপুটা বাদে।

আজ ওদের মাদ্রাসার ছুটি শেষ হয়েছে। তাই আজ মাগরিবের পর হিফযখানার বাচ্চারা ক্লাসে বসেনি। ওদের ম্যাম আসেনি এখনও। ম্যাম না আসলেই ওরা বাঁচে। যা ব্যবহার না ম্যামের!
একজন আদর্শ শিক্ষক-শিক্ষিকা কী করে হতে হয় (?) এটা বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকারাই জানেন না। এই জন্যই আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে বাচ্চারা খুশি হয়।

ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজতে চলেছে। এরই মধ্যে বাকি মেয়েরাও তাদের গল্পের আসরে যোগ দিয়েছে।

নুজহাত বলা শুরু করল— তারপর আপুটা ওয়াশরুমে গিয়েছিল। গিয়ে দেখে একটা ব্যান্ডেজ করা কাটা হাত পড়ে আছে। হাতটা থেকে রক্ত ঝরছে। আপুটা দৌঁড়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। একটু আগেও মাদ্রাসায় কেউ ছিল না।
আপুটা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে— রাঁধুনী খালাম্মা বসে ডাল রান্না করছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল— খালাম্মা! ওয়াশরুমে একটা হাত…

রাঁধুনী খালাম্মা ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত দেখিয়ে বলল— এই হাত?!

—এ কী! এটাই তো!
এটা বলেই আপুটা বেহুঁশ হয়ে যায়!

রাহা বলল— এই দাঁড়া দাঁড়া! তুই এটা বানিয়ে বানিয়ে বলছিস না?

নুজহাত চোখ বাঁকিয়ে বলল— জি না! এটা সত্যি ঘটনা। প্রথম সাময়িক পরিক্ষার সময় ঘটেছিল।

—তোকে কি বলেছে ওই আপুটা?

আরো পড়ুনঃ  এক চিলতে আবেগ

—না। আমায় মারিয়া বলেছে।

নুজহাত রাহাকে জ্বীনের গল্প শুনিয়েছে আজ এক মাস! অথচ রাহা এখনও ভয়ে কাঁপে!

— কী রাহা! এখানে কী করছিস? তোকে সায়মা আপা ডাকছে।

সায়মা নূরানী জামাতের শিক্ষিকা। মাদ্রাসার সব ছাত্রীরা ওনাকে যেমন ভয় পায় তেমন ভালোবাসে! আসলে এটা অর্জন করে নিতে হয়!

ক’দিন পর রাহাদের বিদায় অনুষ্ঠান। অথচ আজ সায়মা বাসায় চলে যাবে। ওনার ডেলিভারি ডেট ঠিক হয়ে গেছে। কয়েক দিনের ভেতরেই অপারেশান করতে হবে। তাই সবাইকে ডেকেছিল।

—নুজহাত! এ্যাই নুজহাত!
—কী! এত রাতে ডাকছিস কেন?
—উঠ না। আমি একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি। খুব ভয় হচ্ছে রে!
—ঘুমা তো। জ্বীন আসবে না। ঢং! এসব বাদ দে।

সকালে নুজহাত রাহাকে বলল— কী রে! মুখ ভোতা করে আছিস কেন?

—ভালো লাগছে না!
—কাল রাতে ঘুম টা ভেঙ্গেছিলিস কেন? কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম আমি!

রাহা কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে তখন নুজহাত বলল— কী দেখেছি জানতে চাইবি না?

—মনটা ভালো নেই!
—আমি দেখলাম, সায়মা আপার খুব কিউট একটা বেবি হয়েছে। মেয়ে! আমি আর তুই তাকে নিয়ে খেলা করছি।

রাহা ক্লান্ত কণ্ঠে বলল— আপা আজ হসপিটালে যাবে। তাই না?

—হ্যাঁ, আপা তো ওইদিন বলেছিলো দশ দিন পর অপারেশান। আজ দশদিন পুরো হলো!
বল তো দোস্ত! তোর মনটা এমন খারাপ কেন? কাল কী এমন দেখলি স্বপ্নে?

—স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে হয় না। তাছাড়া আমি স্বপ্নটা দেখে বাম দিকে তিনবার থুথু ফেলে তা’আউজ পড়ে পাশ ফিরে শুয়েছি। এমনটা করলে খারাপ স্বপ্নের প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

শেষ বিকেল! রাহাদের ক্লাস অনেক আগেই শেষ হয়েছে। রাহা অনেক্ষণ ধরেই নুজহাতকে খোঁজছে। নুজহাতের কোনো খবরই নেই! অবশেষে নুজহাতকে খুঁজতে খুঁজতে নিচ তলায় গেল রাহা।

আরো পড়ুনঃ  বন্যা কলমে: নারগিস খাতুন

নুজহাত দেয়ালের দিকে মুখ করে কাঁদছে। শুধু নুজহাত না। বাকি মেয়েদের চোখেও একটু আধটু পানি উঁকি দিচ্ছে। নুজহাত বেশিই কাঁদছে। রাহা নুজহাতের কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল— কাঁদছিস কেন দোস্ত! বাড়ির জন্য মন খারাপ?

নুজহাত কিছু বলতে পারছিল না। পাশে থাকা একটা মেয়ে বলল— সায়মা আপা হসপিটালে মারা গেছেন কিছুক্ষণ আগে।

—কীহ! ইন্না লিল্লাহ! এসব কী বলছ তুমি?

রাহা অনেকটা শক খেলো।
সামনে বিদায় অনুষ্ঠান! এর আগেই আপা সারাজীবনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেল!

কেউ কি ভেবেছিল যে,সায়মা আপা এভাবে চলে যাবে! সবাই দুনিয়াতে আসতে চাওয়া নতুন মানু্ষটাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে! সবার ভাবনাকে ফাঁকি দিয়ে সায়মা আপা রবের ডাকে সাড়া দিলেন! হতে পারে এই সন্তানই তার মুক্তির উসিলা!

রাহা শুধু বলল— জান্নাতুল ফেরদাউসের সু’উচ্চ মাকামে আপনার স্থান হোক সায়মা আপা!

 

নিয়মিত পড়ুন এবং লেখুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *