বাস্তবতার মুখোমুখি
আমাতুল্লাহ খাদিজা খুশি
নিজ হাতে বাবার কবরে মাটি দিয়ে নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ, হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার। মুখে কোন কথা নেই, কথা বলার ভঙ্গি যেন তার হাড়িয়ে গেছে। মাথার উপর থেকে বিশাল ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে। খুঁটিহীন এক আকাশের নিচে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলছে আনোয়ার।
_কি করবো আমি?
_কিভাবে পথ চলবো?
বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন।
বাবাকে হাড়িয়ে আজ বুকের ভিতর বিশাল শূন্যতা কাজ করছে। যে বাবা কখনো বুঝতে দেয়নি অভাব জিনিসটা কি, আজ সেই বাবার অভাব খুব করে অনূভব করছি।
আজ আমি সর্বশান্ত।
_কোনদিকে যাবো?
কিভাবে পথ চলবো, কোন কূল খুঁজে পাচ্ছিনা।
বাবা তোমার কি এখনি চলে যাওয়া খুব দরকার ছিলো?
আর ক’টা দিন কেন থেকে গেলে না? আজ যে আমি বড়ই অসহায়।
চোখের পানি ফেলছিলো আর কথাগুলো বলছিল আনোয়ার। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না, কিন্তু সে নিজেকে কোন ভাবেই সামলে রাখতে পারছেনা যেন। সদ্য বাবার মৃত্যুতে খুবই ভেঙ্গে পড়েছে আনোয়ার। গত কিছুদিন আগেই নিজ হাতে নিজের ছোট্ট বোনের কবরে মাটি দিয়েছে,, আজ তার বাবার মৃত্যু যেন কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেনা সে। এখন তার আপনজন বলতে পৃথিবীতে একমাত্র তার মা ছাড়া যেন আর কেউ রইল না।
একটা জিনিস আনোয়ারকে খুব করে ভাবাচ্ছে, আর তা হলো
_কিভাবে এই জীবনের পথ চলতে শুরু করবো?
_কিভাবে আমার বাবার রেখে যাওয়া সংসারকে চালাবো?
এতদিন বাবা বেঁচে ছিলো, যেভাবে ইচ্ছা নিজের খেয়াল খুশিমত চলেছি। যখন যেখানে ইচ্ছা গিয়েছি। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতেছি,, তাদের পিছনে অনেক টাকা নষ্ট করেছি। কিন্তু আজ কি তাদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাবো?
_হয়তো না।
কারন বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এই পৃথিবীতে যার টাকা পয়সা আছে তাকে সবাই চেনে। তার কদর সবাই করতে চায়। কিন্তু একবার হাত শূন্য হয়ে গেলে, সবাই দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়। আজ আমি ঠিক সেই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এতদিন বুঝিনি বাস্তবতা কিরকম হতে পারে, আজ কেন আমায় এত ভাবাচ্ছে এই বিষয়?
সবশেষে কান্না বিজড়িত চেহারায়, বাকরুদ্ধ হয়ে, বাসায় ফিরলো আনোয়ার। আনোয়ারের মা নিজের ছেলেকে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। কারন সদ্য স্বামীর মৃত্যুকে উনি নিজেই অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। মেয়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই স্বামীর মৃত্যু।
_আহ! কত হৃদয়বিদায়ক দৃশ্য।
মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে আনোয়ার। কিন্তু এদেশে শিক্ষিত হয়েও তো কোন লাভ নেই, শিক্ষার কোন মূল্য নেই এদেশে। কত শিক্ষিত ছেলেরাও আজ বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে,, দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের খোঁজে কেউবা একটা টিউশন করিয়ে যা টাকা পায়, তা দিয়ে কোনমত চলে,,
কেউবা চায়ের দোকানে কাজ করে, কেউ রিক্সা চালায়, উপায়ন্তর না পেয়ে কেউবা কৃষকদের সাথেই যোগ দেয় কাজে।
উদ্দেশ্য একটাই….
দু’বেলা খেতে হবে।
সংসার চালাতে হবে।
শিক্ষিত আনোয়ার ও আজ সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
_নাহ এভাবে বসে থাকলে চলবেনা,, কোন একটা কাজ করতে হবে,, বাবার রেখে যাওয়া সংসার চালাতে হবে যে।
আমার মা কে কখনো কষ্ট দিবো না।
কিছুদিন পর….
আনোয়ার একটা চাকরির খোঁজ করছে, কিন্তু দিনশেষে বাসায় এসে ভাবে, বাহিরে চাকরি করতে গেলে তার মা যে একা হয়ে থাকবেন।
তার মাকে কে দেখাশোনা করবে?
সবশেষে, আনোয়ার ডিশিসন নেয়, তার বাবার রেখে যাওয়া গাড়ি চালিয়ে অর্থ উপার্জন করে, তার মাকে দেখাশোনা করবে। তাদের ছোট্ট সংসার চালাবে।
সবশেষে বাস্তবতার পর্দা ঠেলে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরলো আনোয়ার।
এভাবেই গাড়ি চালিয়ে যা উপার্জন হয়, তা দিয়েই চলছে আনোয়ারের বাস্তবিক জীবনে চলার পথ। কিন্তু এই কাজ করার পর থেকে, আনোয়ার হাড়িয়েছে তার স্বার্থপর কিছু প্রিয় মানুষকে। হাড়িয়েছে বন্ধুত্ব নামে স্বার্থপর মানুষদেরকে। আনোয়ার এখন তাদের খাওয়াতে পারেনা,, তাদের সঙ্গ দিতে পারেনা,, তাদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যে পারেনা। তাই তারা এখন আনোয়ারকে চিনে না। কিন্তু সত্যিকারের বন্ধুত্বগুলো কখনোই এরুপ হয়না। সত্যিকারের বন্ধুত্বের মানুষগুলো সব সময় সুখে-দুঃখে পাশে থাকে। তাদেরকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে না গেলেও, কখনো মন খারাপ করেনা।
এভাবেই চলে যাচ্ছে দিন, মাস, তারপর বছর।
আনোয়ার এখন বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে পেরেছে, বুঝতে শিখেছে। জীবনে চলার পথে কোন মানুষগুলো স্বার্থের পিছনে ছোটে, আর কোন মানুষগুলো ভালোবাসার পিছনে ছুটে, তাদেরকে চিনতে পেরেছে।
মাঝে মধ্যে বাবার কথা খুব করে মনে হয়,, বাবা বেঁচে থাকলে আজ হয়তো আমাকে এতটা কষ্ট করতে হতো না,, কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে আমি বাস্তবতা চিনতে পারতাম না।
বাবার স্মৃতির কথা মনে হলে আনোয়ার চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ইচ্ছা হয় ছোট বাচ্চাদের মত ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলতে,,
“বাবা তোমাকে ছাড়া আজ আমি একটুও ভালো নেই”।
মাঝে মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। কিন্তু কাউকে কিছু বলার থাকেনা যেন। আনোয়ারের মা ছেলের কষ্ট বুঝতে পারেন, কিন্তু তারও কিছু বলার থাকেনা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাদেরকে আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে। জীবনে যাই ঘটুক না কেন, আনোয়ার বিশ্বাস করে প্রত্যেক কাজের মধ্যেই কল্যান নিহিত। আল্লাহ যা করেন, বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। আনোয়ার প্রান খুলে কাউকে কিছু বলতে পারেনা। না পারে সইতে, না পারে কইতে।
কারন সে আজ “বাস্তবতার মুখোমুখী”।
“সমাপ্ত”
আরো পড়ুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য