হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা কলমে বখতিয়ার উদ্দিন

হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা
বখতিয়ার উদ্দিন

   ( উপন্যাস )

১.
চারদিকে সবুজ ঘেরা মাঠ আর মাঠ।সবুজের বুকে লুকিয়ে আছে কত নদী আর নালা।সবুজ ধান ক্ষেত আর বিল-ঝিলের মায়া জড়িয়ে এই সব নদী – নালা প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে এই সব নদী -নালা সহজে চোখে পড়ার নয়। অসীম নীল আকাশ পাহারা দিয়ে আছে এসব নদী-নালা। নদীর বুকে জলরাশীর উপর বয়ে চলে কত নৌকা আর ভেলা।সেখানে জীবনের তাগিদে দিন রাত বসবাস করে কত মানব- মানবী।বিশেষ করে জেলে ও জেলের বউ।নদীর বুকে ছুটে চলে কত হাজার মানুষ।এইসব মানুষের বুকে হাজার কষ্ট,হাজার ব্যাথা বেদনা। কত মানুষ প্রিয় জন হারিয়ে প্রকৃতির বুকে চির সঙ্গী হয়।
উপকূলীয় মানুষের চিন্তার শেষ নেই।গ্রীষ্ম বা বর্ষার আগমনে তাদের হৃদয়ে জাগে দিশেহারার নেশা।জীবনে চারদিকে সব হারিয়ে একা হলেও সাহসীকতার বীর সৈনিক রুপে আবার স্বপ্ন দেখে তারা। জীবনের মাঠে মাঠে ভরিয়ে তুলে সবুজ ক্ষেত আর ক্ষেত। সবুজে সবুজে ভরিয়ে তুলে মনোহর সমাহার। সবুজ রঙ্গের ধান চিরদিন সবুজ থাকে না, তা একদিন পাকা হয়ে সোনালী রং ধারণ করে।

ধানের গন্ধে চারদিকে মন যেন আকূল হয়।মানুষের মন খুশিতে ভরে উঠে। ধানের সাথে মানুষের জীবনে মিশে যায় আনন্দ – বেদনা, হাসি – কান্নার বন্যা।
মানুষ মনে মনে কত স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তব জীবনে স্বপ্ন পূরণ হয় না।জীবনে কত আশা করে তা বাস্তব জীবনে পায়না।অনেকে জীবনে পেয়ে সুখি, অনেক হারিয়ে খুশি। কত যে বিচিত্র মানব জীবন।
মানুষের পাওয়া – না পাওয়ার খেলা চির জীবন।সবাই পাওয়া- না পাওয়ার জীবনে হৃদয়ের হতাশায় শত দুঃখ ভোগ করে। আবার কেউ হারিয়ে একা হয়ে চির জীবন একা থেকে যাওয়ার চির প্রতিজ্ঞা করে।শত মানুষের জীবনে শত দুঃখের কাহিনী জম্ম হয়। সে দুঃখের ভাগী কেউ নয়।নিজে নিজে কিছুটা সময় প্রকৃতির নীরব অন্ধকারে দুঃখ দূর করার চেষ্টা করলেও তা দূর হয়না।বরং দুঃখ ভোগ করতে করতে জীবনের শেষ প্রহরে আরো জরা- জীর্ণ মলিন রঙ ধারণ করে।জীবনের শেষ বয়সে কষ্ট থেকে উঠে আসার শক্তি আর হয় না।তবে মানুষের জীবন মলিন হয়ে গেলেও – গ্রাম বাংলার প্রকৃতি সবুজ আর সবুজ, চিরদিন সবুজ। সবুজের মাঝে জরাজীর্ণ রং ধারণ করে না।যত দূর চোখ যায় তত দেখি সবুজ গ্রাম আর গ্রাম।গ্রামে মানুষের দু’চালা খড়ের ছাউনী ছোট ছোট ঘর।সেখানে বিচিত্র মানুষের বিচিত্র বসবাস।গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ।পথের দুই পাশে সবুজ ধান ক্ষেত।মাঝে মধ্যে কাঁদা মাখা পথখানি ভাঙ্গা। কিছু দূরে পথের ধারে ধান ক্ষেতের মাঝখানে একটি গিরিস্তীর বাড়ি।
দু’চালা ঘর। ছনের ছাউনি। সামনে বারান্দা নামানো হয়েছে। ঘরের সামনে একটি আঙ্গিনা। চারদিকে শিমের বীজ রোপন করা হয়েছে। চালার উপর লাউ গাছ জড়িয়ে আছে। পাশে ছোট একটি গোয়াল ঘর। চারদিকে কয়েকটি সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ,লেবু গাছ আর কয়েকটি ফলের গাছ আছে । এছাড়া আর তেমন গাছপালা নেই।নতুন ভিটা,পাঁচ ছয় বছর আগে এখানে নতুন ঘর করে বসবাস শুরু করেছে বাড়ির মালিক।

বাড়ির পাশে ভিটার ভিতরে একটি ছোট পুকুর।পুকুরে মাছ ধরার জন্য জাল হাতে নিয়ে নেমেছে এই বাড়ির ছেলে সাজু মিয়া। জাল নিয়ে অনেকক্ষণ মাছ ধরার পর শুধু কয়েকটি পুটি, চিংড়ি ছাড়া আর কিছু পায় না।অনেকক্ষণ চেষ্টা করে মাছ না আসায় কিছুক্ষণ পুকুর পাড়ে নীরবে বসে থাকে সাজু মিয়া ।তারপর আল্লাহ নাম নিয়ে আবার জলে জাল ফেলে।জাল টানতে কি অবাক কান্ড!জাল যেন পুকুরের জলের দিকে কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।প্রথমে ভয় পায় সাজু। কি আশ্চর্য ব্যাপার!সেই সাহস করে আস্তে আস্তে পুকুরে নেমে পড়ে।অনেক বড় কাতাল মাছ জালে ধরা পড়েছে। জাল জড়িয়ে মাছ তাড়াতাড়ি বাড়ির আঙ্গিনায় নিয়ে এসে মাকে ডাকতে থাকে, মা, মা,ও মা।
মা ছেলেকে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল গোয়াল ঘরে।মা তাড়াতাড়ি গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে এসে বড় মাছ দেখে অবাক হয়ে বলে,আমাগো পুইকুর থেইকা পাইলা?
অহ মা, আমাগো পুইকুর থেইকা পাইলাম।রাইখা দিমু?
রাইখা না দিয়া পুইকুরে ঢাইলা দিবা!এই মাছ ঢাইলা ভাসাইলে আর পাইবা?
অহ মা, তাইলে রাইখা দি।
রাইখা দাও।
মহা খুশিতে মা-ছেলে তাড়াতাড়ি মাছটি ঘরের ভিতর নিয়ে যায়।
বহুদিন হচ্ছে পুকুরে বড় মাছ পাইনা।প্রতি বছর পুকুর গুলো বন্যার জলে ডুবে যায়। মাছ চাষ করলে মাছগুলো বন্যার জলে ভাসিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়।তাই পুকুরে মাছ চাষ করতে ইচ্ছে করে না।কষ্ট করে মাছগুলো বড় করলে বন্যায় ভেসে যায়। আবার বন্যার জলে অন্য জায়গার মাছ ভাসিয়ে এই সব পুকুরে নিয়ে আসে। হয়তো এই মাছটি বন্যার জলে ভেসে এই পুকুরে এসেছিল।তা না হলে এখানে এতো বড় মাছ হওয়ার কথা নয়।বন্যার জল কমে যাওয়ার পর হয়তো এই মাছটি থেকে গেছে। আবার বন্যা হলে ভেসে একেবারে নদী কিংবা সাগরে চলে যাবে।এখান থেকে সাগর বেশি দূরে নয়। বঙ্গবসাগর। যার কূল গেসে অসংখ্য মানুষ বসত ভিটা করে জীবন যাপন করে যাচ্ছে। এই সাগর তাদের জন্য যেমন আশিদবাদ তেমনি মাঝে মধ্যে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তাই মাছটি সাগরের পেটে না দিয়ে এবার দিবে নিজেদের পেটে।সাগরের পেটে তো মাছের অভাব নেই।ভাগ্য ভালো হলে বন্যার জলে এই সব মাছ ভেসে পুকুরে চলে আসবে।

সাজু মাছটি ঘরের ভিতর রেখে বাহিরে এসে দেখে, চাচাতো বোন মনোয়ারা দুধ নেওয়ার জন্য এসেছে। সবাই মনোয়ারাকে মনু বলে ডাকে।তবে তার আসল নাম মনোয়ারা।
সাজু গোসল করার জন্য লুঙ্গিখানা হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছে। তখন পথে মনুর সাথে সামনা সামনি দেখা হয়।সাজুর গায়ে লুঙ্গি ছাড়া আর কোন জামা নেই। সেই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি পুকুরে এসে জলে নেমে পড়ে ।তা দেখে মনু একটু মৃদ স্বরে হাসতে থাকে।। সাজু বেশ লাজুক ছেলে।সেই কোন সময় ভালো করে কোন মানুষের সাথে কথা বলে না।এমন কি ঘরের মানুষের সাথেও না।পনের বছরের বালক সাজু হঠাৎ শরীরটা মস্ত হয়ে উঠেছে।মনটা যেন চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। হৃদয়ে অস্থিরতার ভাব উদয় হয়েছে। সাহসীকতার বীর সৈনিক রুপে পৃথিবীতে অনেক কিছু করতে চাই।
সাজু পুকুরের জলে নেমে সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।বিশাল আকাশের বুকে যেন পরশতার এক শিহরণ জেগে উঠেছে।দু’চোখে পৃথিবীর সব কিছু রঙিন রঙিন লাগে।যেটা দেখে পৃথিবীতে সেটা ভালো লাগে।

আরো পড়ুনঃ  উপন্যাস বেরঙিন পথে শুরু হলো কথা

মনু আর কোন দিকে খেয়াল না করে সোজা ঘরের ভিতর চাচি মায়ের কাছে চলে যায়। মনুকে দেখে সাজুর মা বলে, মনু মা আইছ!
অহ চাচি, আইলাম।
আইছ ভালা কইরছ।না হইলে দুধ সাজুর দিয়া পাঠাই দিতে চাইছিলাম।
চাচির কথায় মনু বলে, বিহান থেইকা আইতে চাইছিলাম। পাইরতাছি না।ঘরে মেলা কাম।
সাজুর মা তরকারি কাটতে কাটতে বলে,তোমার বাপের অসুখ ভালা হইয়াছে?
মনুও একটি তক্তায় বসে বলে,অহ চাচি, ভালা হইবার নাম নাই।বিছানায় রাইখা আইছি।মাও আর পাইরেন না।মাও, বাবার সেবা কইরতে কইরতে অসুস্থ হইয়া পইড়ছেন।
আমিও দেইখতে যাইতে পাইরি না।সংসারে মেলা কাম।একা মানুষ, ঘরে আর কেউ নাই।
যাইয়েন চাচি,যাইয়েন।
যাইব, সময় কইরা যাইব।ভালা কইরা সেবা করিও তোমার মা – বাপরে।ছেলে মায়ার জইন্য মা- বাপ এক নিয়ামত জিনিস।আমার মা-বাপ নাই তাই এখন বুইঝতাছি।
সাজু গোসল সেরে লুঙ্গিখানি বাহিরে শুকাতে দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে।সাজুকে দেখে মনু দুধ তাড়াতাড়ি নিয়ে চাচির সাথে কথা শেষ করে নিজ বাড়ির দিকে চলে যায়।
মনুও গ্রাম্য সাধারণ বালিকা। লম্বায় প্রায় সাজুর সমান হয়ে এসেছে। বয়সে মনু সাজুর চেয়ে দুই বছরের ছোট হবে।লম্বা হলেও শরীর পাতলা, গায়ের রঙ শ্যামলা।ঘন কালো চুল লম্বা হয়ে প্রায় পায়ের কাছে নেমে এসেছে। মনু দুধের কলসি খানি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলে যায়।

সাজুদের বাড়ি থেকে মনুদের বাড়ি একটু দূরে। তাদের পুরাতন ভিটায়।সেখানে তাদের রক্তের সম্পর্কের আরো বসত রয়েছে।আগে সেখানে সাজুদের বাড়ি ছিল। এখন সাজুরা নতুন ভিটা করে বিলের মাঝে গিরিস্তীর বাড়ি গড়ে তুলেছে।
মনু প্রতিদিন দুধ নেওয়ার জন্য আসে সাজুদের বাড়িতে। মনুর বাবা অসুস্থ।তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ আর দূর্বলতা কাটিয়ে তুলার জন্য প্রতিদিন দুধ পান করতে হচ্ছে।
এই ছাড়া মনু প্রায় সময় চাচি মায়ের কাছে এসে গল্প গুজব করে।রান্নার কাজে একটু সাহায্য করে।মাঝে মধ্যে সময় দেয়। কারণ সাজুর মা একা।সাজুর বাবা গনি মিয়া কাঠ মিস্ত্রি। প্রায় সময় ঘরে থাকে না।এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যায়। বড় বড় গিরিস্তীর বাড়িতে কাজ করে।পুরাতন ঘর মেরামত করে। আলমারি, দরজা, জানালা, চেয়ার, টেবিল মেরামত বা নতুন তৈরি করে।ভাল কাজ জানে।কোন বাড়িতে কাজ ধরলে প্রায় সপ্তাহ বা মাস লাগে। কাজ শেষ করে বাড়ি আসে আরো চার পাঁচটি কাজের বায়না নিয়ে।তিন চার দিন বাড়িতে থেকে আবার নতুন কাজে চলে যায়। ভাল রোজগার করে।সারা বছর বৈরাগীর মতো তার জীবন যাপন হলেও সংসারে অভাব নেই । সাথে থাকে সাজুর ছোট ভাই রাজু মিয়া।সেইও কাজ জানে।বাবাকে কাজে সাহায্য করে।
বাবা সাজুকেও কাঠ মেস্ত্রীর কাজ শিখতে বলে। কিন্তু সাজু কাজ শিখে না।তবে সেইও কিছু কাজ জানে।সাজু লাজুক ছেলে।তার কথা,সেই মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ করতে পারবে না।বাবাও আর জোর করে না।যদি বাড়ির বড় ছেলেও কাজে চলে যায়, তাহলে বাড়ি দেখা শুনা করবে কে?বাড়িতে আছে চাষাবাদ।আর মা ও ছোট বোন মিনা আছে।সবাই তাকে মিনু বলে ডাকে।মিনুর বয়স পাঁচ বছর। হাঁটতে পারে।কথা বলতে পারে।মা-বোনের দেখা শুনার দায়িত্ব সাজুর উপর।

সাজু ছোট বোনকে নিয়ে খেতে বসেছে।মা রান্নাঘরের এক পাশে বসে মাছ কাটছে আর তারা দুপুরের খাবার খাচ্ছে।সাথে ছোট বোন মিনু বক্ বক্ করে কত কথা বলে যাচ্ছে। সাজু তার কথার উত্তর দিচ্ছে আবার দিচ্ছে না, এই অবস্থা। বদ্দা, মাছ আমাগো পুইকুর থেইকা পাইলা?
বোনের কথায় সাজু কোন উত্তর দিচ্ছে না।চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে। মিনু আপন গতিতে আগুড়ুম বাগুড়ুম বলে যাচ্ছে, সব মাছ আমি এইকা খাইবো কিন্তু!
এবার সাজু বাদ্য ছেলের মতো বলে, খাইবে, সব মাছ তুমি এইকা খাইবে?
আদু আদু শব্দে মিনু বলে, নাহ, এইইকা খাইবো নাহ।মায়েরেও দিমু আর তোমারেও দিমু।
আমাগোও দিবা?
অহ! তোমাগোরেও দিমু।এত বড় মাছ আমি এইইকা খাইতে পাইরবো না।
ছোট মেয়ে আরো কত কথা বলে বলে বক্ বক্ করে যাচ্ছে। মেয়ের কথায় মা হাসে আর সাজু নিরুপায় হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
সাজু দুপুরের খাবার শেষ করে ঘরের বারান্দায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। শরীর যেন ঘুমের আলতো ভাব নিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।শরীরটা একটু বিশ্রাম খোঁজছে।তবুও সাজুর চোখ সোজা দরজা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আঙ্গিনায় ঝলমল রোদ খেলা করে যাচ্ছে। প্রখর রোদের মাঝে গরুর বাছুরটি শুয়ে আছে। একটু একটু শীতল বাতাস বইছে।দুপুরের খাবার খেয়ে নিত্য দিনের মতো মনটা আজ অন্য রকম।
হঠাৎ বাহিরে দেখে মনুর ভাই করিম তাদের বাড়ির দিকে আসছে। সাজুর চাচাতো ভাই করিম।দুই জনে বয়সে প্রায় সমান।তারা এক সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। গল্প গুজব করে,বাহিরে লবণের মাঠে কাজে যায়। প্রায় সময় বন্ধুর মতো সময় কাটায়।
করিম বাড়িতে ঢুকে।সাজু তাকে বসতে বলে।কিন্তু করিম বলে, বেটা, বইসবো না।চইল, আইজ একটু বাহির থেইকা ঘুইরা আইসি।
সাজু একটু অবাক হয়ে বলে, কই যাইবি?
এইক জায়গায় যামু।
সহজ সরল ছেলের মতো সাজু বলে, তুই যা বন্ধু। আইজ আমার থেইকা বেশি ঘুম পাইচ্ছে।
তুই শুধু ঘুম আর কাম লইয়া পইড়া থাকুস।একটু বেড়াতে যাইস না।আইজ যাইতে হইবে তোর থেইকা।
সাজু একটু বাদ্য হয়ে বলে,ঠিক আইছে। তাইলে মায়েরে একটু বইলা আইসি।তবে সন্ধ্যা হওয়ার আইগে ফিইরে আইতে হইব।
ঠিক আইছে বন্ধু। তাড়াতাড়ি ফিরে আইব।
সাজু শার্ট গায়ে পড়ে মাকে বাহিরে যাচ্ছে এই কথা বলে, সাজু আর করিম বাহিরে চলে আসে। যাওয়ার সময় মা রান্নাঘর থেকে ডাক ছেড়ে বলে, এক বার ধান ক্ষেতগুলো দেখে আসতে।সাজু মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দুই জনে বাড়ির পথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে।রাস্তার উপর নরম বিছানার মতো ছড়িয়ে আছে সবুজ ঘাস আর ঘাস।বর্ষাকালে এই সব রাস্তা গুলো হাঁটু সমান কাদায় পূর্ণ হয়ে যায়। বর্ষার পর শরৎ আর হেমন্ত কাল পার হয়ে শীতকালে রাস্তার কাঁদা শুকায়।মাটি শক্ত হয়ে গজায় লোনা ঘাস।অনেকে নরম ঘাসের উপর একা বসে অনন্ত স্বপ্ন দেখে এবং নিজেকে নিজে গল্প বলে বসে থেকে সকালে কিংবা বিকালে সময় কাটায়।স্বপ্নের ভেলা নিয়ে গল্পের সাগরে ভেসে যায় অসীম নীল আকাশে। বাঁশ ঝাড়ের নিচের রাস্তাগুলোতে কাঁদা থাকে সারা বছর।গ্রীষ্মতে একটু শুকায়।যে সময় উত্তাপ্ত রোদের মাঝে একটু শীতল হাওয়া বয়।

আরো পড়ুনঃ  পরিণতি বখতিয়ার উদ্দিন ( উপন্যাস)

সাজু আর করিম হেঁটে হেঁটে আসে তাদের পুরাতন ভিটার দিকে। করিমও একটু মাকে বলে যাবে বাহিরে যাচ্ছে। দুই জনেও তাদের পুরাতন ভিটার আঙ্গিনায় পা দেয়। সাজু এই বাড়ির দিকে আসছে না অনেক দিন হয়ে যাচ্ছে। তার মাঝে কিনা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে।বাড়ির আঙ্গিনায় যে আম গাছটি ছিল তা আর নেই।গাছ কেটে সামনের ঘরটা আরো বড় করা হয়েছে। করিমদের ঘর থেকে পাশের দুই ঘর বাদে সামনের ঘরটি একটু সামনে থেকে ভেঙ্গে পিছনে নিয়ে গেছে। এর মাঝে জীবনে অনেক পরিবর্তন হয়ে এসেছে।সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশের অনেক রুপের পরিবর্তন হয়ে আসে।

সাজু এই বাড়িতে বেশি আসে না।কারণ এখানে আঙ্গিনায় ঢুকতে এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত দুই পাশে প্রায় বিশটির অধিক পরিবার রয়েছে। করিমদের ঘরটা একদম শেষ প্রান্তে।তাই সব ঘরের উপর দিয়ে যেতে হয় করিমদের ঘরে।প্রায় ঘরের লোকেরা বসে থাকে ঘরের দাওয়ার উপর।সম্পর্কে সবাই বউ – ঝি, চাচা-চাচি,দাদা-দাদি, চাচাতো ভাই-বোন।সাজু আঙ্গিনার মতো গলির ভিতর দিয়ে হেঁটে আসার সময় সবাই জিজ্ঞেসা করে,কেমন আছো?ভালো আছো? ইত্যাদি। প্রশ্ন করে কেউ হাঁ করে চেয়ে থাকে। আবার কেউ জীবনের গভীর চিন্তায় নীরবে বসে থাকে।গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষ। সারা জীবন চির অপরাধীর মতো প্রকৃতির বুকে নীরব থাকে।তাদের কাছে অভাব নিত্য সঙ্গী।যত দিন বেঁচে থাকে তত দিন অভাব থেকে যায়। তাই তারা কোন স্বপ্নও দেখে না। অবার অনেকে কোন কথাও বলে না।একটু মলিন হাসে আর আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাই কিন্তু বলতে পারে না।হৃদয়ে থাকে অনেক দুঃখ আর জীবনের জরাজীর্ণ বেদনা।আবার অনেকে বিষাদময় জীবনে সব দুঃখ আড়াল করে হাঁসে, উদার মনে কথা বলে,সরল মনে স্বপ্ন দেখে। সহজে মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। মানুষ আর প্রকৃতির সাথে যত মিশে যায় তারা তত কষ্ট পায়।তবুও তারা বেঁচে থাকে।কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকে।
সাজু আর করিম অনেকের সাথে কথা বলতে বলতে শেষে করিমদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দাওয়ার এক পাশে করিমের অসুস্থ বাবা শুয়ে আছে।
মনু কলসি নিয়ে পানি আনতে গিয়েছিল পাশের নলকূপ থেকে।ফেরার পথে সাজুকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। সাজুকে দেখলে মনু অনেক লজ্জা পায়।কারণ সাজুর সাথে মনুর বিয়ের কথা চলছে।মনু কয়েকবার শুনেছে। সাজুর সাথে মনুর বিয়ে হতে পারে।
করিমের মাও বাহির থেকে এসে বলে,বাহিরে যাইবা? তবে আগামী কাইল তোমাগো নানা বাড়ি যাইতে হইবে।
করিম বলে, নানা বাড়ি আগামী কাইল কি?
ভুইল্লা গেইছ?কাইল তোমাগো মামাতো ভাইয়ের বিয়া।
কাইল?
অহ, অবশ্যই তোমাকে যাইতে হইবো। এইদের বড়টার বিয়ার সময় যাইতে পাইরি নাই।এইড়ার বিয়াতে না যাইলে খুব কষ্ট পাইব।আমি তো যাইতে পাইরছিনা, এই দিকে তোমার বাপের অসুখ। কাইল অবশ্যই তোমার যাওন লাগবো।
আমি এইকা যাইবো মা।আমার সাথে কেউ যাইবো না?
কে যাইবো আবার!
ক্যান! সাজু যাইব।
সাজু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ভেজা গলায় বলে, মা বাড়িতে এইকা থাইকেন, আমি কি কইরা যাইব!
করিমের মা বলে, ও কি কইরা যাইবো!বাড়িতে ওর মা এইকা থাইকেন।আবার বাড়ির আশে পাশে কোন ঘর বাড়ি নাই।
করিমের মা তা বলতে বলতে মনু তাদের সামনে এসে বলে,কাইল সাজু ভাই যাইব।আমি রাইতে গিয়া চাচির সাথে থাইকবো।
মনুর কথায় সাজু রাজি হয়।বেড়ানোর জন্য সবার মন চাই।বেড়ানোর সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করতে রাজি নয়।আগামী কাল তারা বিয়ে বাড়িতে যাবে, কথা পাকাপাকি করে রাস্তায় হাঁটা শুরু করে।দুইজনে আরো কত কথা বলতে বলতে অনেক দূরে চলে আসে।
রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে নরম ঘাস।দুই ধারে সবুজ ধান ক্ষেত। মাঝে মধ্যে রাস্তা ভাঙা। এই সব ভাঙ্গা রাস্তা পার হতে হয় সাঁকো কিংবা হাঁটু সমান পানির উপর দিয়ে। প্রতি বছর বন্যা এসে এই সব রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে দিয়ে যায়। শুধু ভাঙ্গতে থাকে।এতো ভাঙ্গার পরও সারা বছর কোন পক্ষ থেকে ভালো মেরামত করার কোন ভূমিকা পালন করে না।
দুই জনে তাদের পাড়া পশ্চাতে রেখে অন্য পাড়ায় চলে আসে। এসব পাড়ায় তারা অনেক বার এসেছে। এর ভিতরে কত পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামীণরুপ চির পরিবর্তনশীল।দু চোখে যত দেখে হৃদয়ে আরো বেশি দেখার স্বাদ জাগে।সবুজের সমারহ হৃদয়ের চোখে আরো বেশি সতেজ হয়ে আসে। বিচিত্র মানব মনে নানা কোলাহল ডাক দিয়ে যায়। এসব প্রকৃতির ভিতর দিয়ে তারা হাঁটতে হাঁটতে নদীর তীরে চলে আসে।
নদীর ধারে বিশাল বালুর চর।বালুর চরে মাথার উপর বিশাল নীল আকাশ, এই সব নদীকে ঘিরে রেখেছে। হঠাৎ হঠাৎ নীল আকাশের বুকে ধবল বক উড়ে যায়। নদীর চরে কৃষকের নানান সবজির ক্ষেত রয়েছে। বালির চরে মিষ্টি আলুর লতা আঁকড়ে আছে।
তারা আলু ক্ষেতের উপর হেঁটে নদীর ঘাটে আসে। দুই জনে খেয়াঘাট দিয়ে নদী পার হয়।নদীর বুকে ঢেউ দিয়ে চারদিকের সৌন্দর্যের পরশতা বাড়িয়ে তুলেছে। নদীর বুকে হালকা হালকা শীতল বাতাস বইছে। উত্তাপ্ত রৌদ্রের মাঝে হালকা শীতল বাতাস হৃদয়ে যেন স্বর্গের দোলা দিয়ে যাচ্ছে।
নদীর এই কূল পার হয়ে ঐ কূলে উঠে কিছুক্ষণ নদীর ধার দিয়ে সোজা হাঁটতে থাকে তারা।নদীর ধারে অনেক ছোট ছোট ঝোপযুক্ত গাছে আবৃত করে আছে। করিম ও সাজু এসবের পাশ ঘেঁষে আরো হাঁটতে থাকে।
কিছুক্ষণ হেঁটে দেখে একটি টিনের চালা ঘর।সাজু দেখে করিমের হাতে একটি মাটির ঢিল।কিছু দূর যেতে না যেতে করিম মাটির ঢিল টিনের চালার উপর ছুড়ে মারতে টিনে টং করে শব্দ উঠে।কান্ডটা দেখার সাথে সাথে সাজু ভীতু হয়ে জিজ্ঞেসা করে,এই কি কইরলে?মানুষ ধইরে পিঠাবে।
করিম মৃদ হেঁসে বলে, এখন বুইঝবে না।একটু পর দেইখবে।ভয় পাইয়ও না।
তারা কিছু দূর যেতে না যেতে একটি মেয়ে টিনের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মেয়েটি তাদের পিছু নিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছু দূরে গিয়ে সাজুকে এক পাশে বসিয়ে রেখে করিম ও মেয়েটি আড়ালে অনেকক্ষণ কথা বলে। নদীর তীরে রয়েছে গাছপালা আর একটি বাঁশ বাগান।বাঁশ বাগানে নদীর বুক থেকে ভেসে আসছে হালকা হালকা শীতল বাতাস।পাতার ফাঁকে ফাঁকে একটি দুইটি টুনটুনি নেচে এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে। সাথে রয়েছে দোয়েলসহ আরো অনেক পাখি।
নির্জন জায়গা। এখানে কোন প্রয়োজনেও মানুষ আসে না।সাধারণ মানুষের ধারণা এদিকে শুধু জ্বিন ভূত বসবাস করে।এই সব ভয়ের মাঝেও সাজুর থেকে এই নদীর তীর খুব ভালো লাগছে।নদীর বুক থেকে অনন্ত আদ্রতার জলরাশী সতেজ বাতাস হয়ে উড়ে বেড়ায়। পরশতায় সমস্ত শরীর শান্ত হয়ে আসে।নদীর বুকে রয়েছে অসীম জলরাশীর ধারা।যে জল অনন্ত কাল সজীব। জল স্রোতের কল কল সুর জীবন্ত, প্রাণবন্ত।এই সব দেখলে মনে শান্তির নিস্তব্ধতা বিরাজ করে।সারা রাত ধরে কলকল ধ্বনিতে ভেসে আসে জোয়ার – ভাটার শব্দ।
সাজু এই সব দেখে দেখে অনেকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকে।একটু এদিক ওদিক তাকায়। করিম আর মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে না।একটু দূরে ঝোপের আড়ালে তারা গল্প করছে।মাঝে মধ্যে হাসির শব্দ শুনা যাচ্ছে। সাজু সরল মনে ভাবে, মেয়েটির সাথে করিমের কি সম্পর্ক? আড়ালে গিয়ে তাদের এতো কিসের কথা। এতো সময় ধরে বসে আছে কেন?সাজুর সামনে তো সব কথা বলতে পারে। একটি অজানা ছেলে আর অজানা মেয়ের মাঝে এতো কিসের কথা!পৃথিবী কি ধ্বংসের মধ্যে চলে যাচ্ছে!বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। অনেক দূরের পথ।সন্ধ্যা হলে মা বকাবকি করবে। এই সব ভাবতে ভাবতে প্রকৃতির দৃশ্য দেখে সাজু। বাঁশ বনে সাঁ সাঁ করে বাতাস বয়ছে।গ্রীষ্মের উঞ্চ পরিবেশে এই বাতাস হৃদয় শীতল হয়ে আসে।
অনেকক্ষণ পর করিম আর মেয়েটি সাজুর সামনে আসে।মেয়েটি দেখতে আসলে সুন্দর আছে।করিম মেয়েটিকে সাজুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়,এই আমার চাচাতো ভাই।
মেয়েটি মৃদ হেসে বলে, আপনার নাম কি?
সাজু একটু রেগে চোখ বড় বড় করে বলে, সাজু!
নামটি বলে সাজু মেয়েটি থেকে আর কিছু জিজ্ঞেসা করছে না।সাজু রেগে আছে দেখে মেয়েটি হেসে বলে, তোমার চাচাতো ভাই সরল মানুষ।
এই কথা শেষে তারা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য পথ ধরে।মেয়েটি একা একা তার বাড়িতে চলে যায়।
ফিরে আসার পথে সাজু জিজ্ঞেসা করে, এতো দূর ক্যান আইছ?
এখনো বুইঝালে না?মেয়েটার জন্য আইছি।
সাজু বলে, আইজ কাইল তুমি যে কান্ড শুরু করেছ!
করিম কোন উত্তর দেয় না।তারা তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকে। আঁধার হয়ে যাওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে হবে। চারদিকে সাঁঝ হয়ে এসেছে। তাঁরা জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। পথে কেউ কারো সাথে আর কোন কথা বলছে না।শুধু গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে হাঁটতে থাকে।

আরো পড়ুনঃ  চলো না হারিয়ে যাই গল্পের ১ম পর্ব

 

3 thoughts on “হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা কলমে বখতিয়ার উদ্দিন”

  1. আবহমান গ্রাম বাংলার চিত্র, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা’য় ফুটে উঠেছে। প্রকৃতি ও মানুষের চমৎকার মেলবন্ধন। পরের পর্বের অপেক্ষায় ……………….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *