৫ টি সেরা ঈদের গল্প

ঈদের গল্প রয়েছে অনেক, অনেক গুলো প্রকাশিত আবার অনেক গুলো অপ্রকাশিত। গল্পগুলো ঈদের নয়, জীবনের। নিচের ৫টি গল্পের পড়ুন,  ভালো লাগবে ইন শা আল্লাহ 

 

মিতুর ঈদের লাল জামা

কলমেঃ মারিয়া ইসলাম

মিতু বারবার তার মার কাছে জিজ্ঞেস করছে বাবা কখন আসবে, এখনো তেন বাবা আসছে না৷ কখনো তো এতো রাত করে না তার বাবা। রাত দশটার পরেই চলে আসে, সেখানে আজ মধ্যে রাত হয়ে গেছে। মিতু অবশ্য এতো রাত জেগে থাকে না, আজকে রাত জেগে অপেক্ষা করছে একটা বিশেষ কারণে। আর ৩ দিন পরেই ঈদ৷ মিতু তার বাবাকে বলছে তার জন্য একটা লাল জামা নিয়ে আসতে। আজকে তার বাবার সেই জমা নিয়ে আসার কথা, তার জন্য মিতুর অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। বাবাটাও আজকে কেন জানি এতো দেরি করছে? সেই নিয়েই মাকে জ্বালিয়ে মারছে মিতু।

মিতুর বয়স ছয় বছর। এলাকার প্রাইমারি স্কুলেই পড়াশোনার হাতেখড়ি হচ্ছে তার। পরিবারে আছে বাবা, মা আর ৮ মাসের ছোট একটা ভাই ৷ বাড়ি বলতে ছোট একটা ঘুপচির মতো ঘর। বাবা মঈনুল একজন হকার। বাসে, ট্রেনে গামছা বিক্রি করেন তিনি। তাদের অবস্থা একবারে নিম্নস্তরের মধ্যেবিত্ত বলা চলে। তাই ঈদ চলে আসলেও এখনো ঈদের জামাটা কেনা হয় নি তার। আজকে কখন বাবা নিয়ে আসবে মিতুর ঈদের লাল জামা..?

অথচ মিতু জানতেই পারলো না, তাদের বাসা থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে তার অজানা কোনো এক ট্রেন স্টেশনের রেলপাতে নিষ্পেষিত হয়েছে তার বাবার শরীরটা। তার বাবা এখন আর শুধু মিতুর বাবা নয়, সে এখন পরিচিত বেওয়ারিশ হিসেবে।

 

 

 

আদিলের ঈদের জামা

কলমেঃ খুরশিদ আলম

আজ ঈদের দিন। মানে খুশির দিন। আজ যে খুশির দিন এটা লেখার অপেক্ষায় রাখে না লেখক; আর জানার বাকি রাখে না পাঠক। ছোট বড় সবার মুখের ঝিলিক-ই খুশির বার্তা বহন করে।

ঈদের সালাত আদায় করে ফিরছে সবাই। একটি মাস রোজা রাখার পর আজ তাদের খাওয়া আর ফুর্তির দিন।এ যে স্বয়ং রবের পক্ষ থেকেই তাদের দাওয়াত।

হাজারো মানুষের ভিড়ে আদিল ও বাসায় ফিরছে। সেও ঈদের সালাত আদায় করেই ফিরছে। তবে তার মুখাবয়বে ফুটে ওঠেনি খুশির আমেজ। অন্য সবার মত।পাহাড় সম অভিযোগের ভারে হাড়ি মুখ হয়ে আছে সে। কিন্তু কেন বা তার অভিযোগ ঈদের দিনে? আর কিবা অভিযোগ?
আচ্ছা চলেন! একটু নজর বুলিয়ে আসি তার অভিযোগের ফিহরিস্তে।

ফজরের সালাত পড়ে যখন সে বাসায় আসল। অভিলাষী চিত্তে ছুটে গেল বাবার কাছে। তার আব্বু গতরাতে তার জন্যে ঈদের নতুন জামা এনেছেন বুঝি। আশা আর অনুরাগে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ মুখ।
আদিল বললো, আব্বু!
আমার ঈদের নতুন জামা কোথায়? আমি পরবো। দাও জলদি দাও!এক শ্বাসে বলে ফেলল আদিল।

তার বাবা এনাম সাহেব তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। কি জবাব দিবেন তিনি তাকে। তিনি তো তার জন্য এবারও নতুন জামা আনতে পারেননি।
কয়েক পয়সার রোজগারে দৈনন্দিনের খরচ পোহাতেই হিমশিম অবস্থা। নতুন জামা আনবেন তার টাকা আর কোথায়? কিন্তু তিনি যে গত ঈদে তার নতুন জামা আনার কথা দিয়েছিলেন। যে আগামী ঈদে তাকে নতুন জামা কিনে দিবেন।

মা সহিফা খাতুন পাশেই দাঁড়ানো ছিলেন। ছেলের এমন অভিলাষী চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনিও বেশ বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনিও বা কি উত্তর দিবেন ছেলেটাকে।

এনাম সাহেব বললেন, আব্বুরে!
খামারের মহাজন সাহেব আমার বকেয়া বেতন এখনো দেননি তো। তাই তোর জন্য ঈদের জামা আনতে পারিনি। মহাজন সাহেব যেদিন আমার বেতন পরিশোধ করে দিবেন। সেদিন ঠিকই তোর জন্য নতুন জামা নিয়ে আসব, দেখিস!

কিন্তু আজ এ কথা শোনার জন্য তো আসেনি আদিল। সে এসেছে নতুন জামা নেওয়ার জন্য। যার স্বপ্ন সে দেখছে গত ঈদের পর থেকেই।

জামা কিনে কাকে কাকে দেখাবে। পরে কোথায় ঘুরতে যাবে। জামাটা সুন্দর করে তা করে কোথায় রাখবে। আবার কখন বের করে পরবে। এতো সব পরিকল্পনা করে রেখেছে সে অনেক আগেই।

কিন্তু সে কিনা আজ শুনছে আব্বু তার জন্য নতুন জামা নিয়ে আসেনি।আব্বুর মুখে একথা শোনার পর কলিজাটা ফেটে যেন কান্না আসতে লাগলো তার।
একটা চিৎকার করে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আদিল।বলল মা আব্বু এসব কি বলছে? আমার জন্য নাকি নতুন জামা নিয়ে আসেনি? না! আমার ঈদের নতুন জামা লাগবেই!
_বাবা-মা ঈদের দিনেও ছেলেটার চোখে মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ। যেদিন সবাই মন খুলে হাসছে সেদিনও কাঁদতে হলো আদিলকে। সবশেষে আগের যে পুরাতন জামাটা ছিল সেটাই পরে ঈদের নামাজ পড়তে গেল আদিল।

 

 

 

 

 

স্বাদ থাকলে, সাধ্য হবেই

 

কলমেঃ আজমল কবির

এখনো নামায ফরজ হয়নি আব্দুল্লার উপর। নিষ্পাপ, কোমল মন তার। রোযা কিংবা ইবাদত কি তা বোঝার সাধ্য নেই। তবুও বোনের কাছে বায়না ধরেছে রোযা রেখে সাহরী-ইফতার করবে। ইফতারির দোকানে দেখে, মানুষজন কত বাহারি ধরণের খাবার কিনে নিয়ে যায় ইফতার করার জন্য। কত্ত মজার মজার খাবার। কোমল মনে কিঞ্চিৎ লোভ জন্মানোই স্বাভাবিক। আব্দুল্লার ইচ্ছে ইফতারিতে যেন শরবত, বুট মুড়ি, বেগুনী, আলুরচপ, পেঁয়াজু, জিলাপি থাকে। বায়না শুনে বোনের মন খারাপ। তাদের আবার রোযা-রমযান কি! সারা বছরই তো রোযা রাখে। কোনোদিন খেতে পারে কোনোদিন পারে না। ঠাই নেয়ার মত জায়গাও নেই। রেলস্টেশনের ফুটওভারের এক কোণে কোনোমতো দু’ভাইবোন ঘুমায়। ছোট্ট আব্দুলার মায়া মাখানো মুখের দিকে তাকালে আয়েশার চোখে পানি চলে আসে। কিভাবে তার বায়না মেটাবে! ভাইয়ের আবদার না পূরণ করতে পারলে তো শান্তি পাবে না সে। রেলস্টেশনের প্লাস্টিক জাতীয় ময়লা-আবর্জনা কুঁড়িয়ে তার দিন চলে। বেশি টাকা তো পায়না, যে আয়েস করে কিছু খাবে। তাদের মত অন্য পথশিশুরা খিদে ভুলে থাকার জন্য এক জাতীয় নেশা (ডেন্ডি) সেবন করে। কিন্তু আয়েশা তাদের মতো না। ভালো মন্দের বিচার তার মধ্যে আছে। অনেক কাজ খুজেছে কিন্তু সব জাগায় লালসার কুদৃষ্টি দেখে আর সাহস পায়না কাজে যাওয়ার। তার বয়স তো বেশি নয়। কিশোরী মন সব সময়ই ভয়ে কোণঠাসা হয়ে থাকে।

আরো পড়ুনঃ  বর্ষাকালের ভালো-মন্দ

প্ল্যাটফর্মের কাঠের বেঞ্ছে মন খারাপ করে বসে আছে আয়েশা। পাশে এসে বসলেন মিজান সাহেব।

– কি হয়েছে মা তোমার? অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি মন খারাপ করে বসে আছো।

অপরিচিত লোক দেখে আয়েশা কথা বলছে না। মিজান সাহেব বুঝলেন এভাবে হবে না। মেয়েটির ভয় কাটাতে হবে।

– ভয় পেয়না মা। আমি তোমার বাবার মতো। কি হয়েছে তোমার? তোমার মন খারাপ কেন আমায় বলো।

আয়েশা একটু ভরসা পেল। তাকে কেও কখনো এমন ভাবে মা বলে ডাক দেয়নি।

– আপনে কেডা? আমার মনের খবর দিয়ে আপনে কি করবেন? 

– ওই যে বললাম, তুমি আমার মেয়ের মতো। আর মেয়ের যদি মন খারাপ থাকে তাহলে কি বাবার চিন্তা হবে না। তাই জিজ্ঞেস করেছি। এবার বলতো কি হয়েছে তোমার?

আয়েশা হতবাক। একজন পথশিশু বাচলো কি মরলো সে খোঁজ কেউ রাখে না। সেখানে উনি তার মন খারাপ কেন তা জিজ্ঞেস করছেন। মিজান সাহেবকে সে সব বলল কেন তার মন খারাপ। ভাইকে ইফতার করানোর স্বাদ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই তার। সব শুনলেন মিজান সাহেব। তিনি একটি কর্পোরেট অফিসে চাকরি করেন। মাঝে মাঝেই তিনি পথশিশুদের সঙ্গে গল্প করেন। এতে উনি সুখ খুজে পান। সে কারনেই আয়েশার সঙ্গে কথা বলছেন। মিজান সাহেব ইফতারের খাবার কেনার জন্য আয়েশাকে টাকা দিতে চাইলেন। কিন্তু আয়েশা আত্মমর্যাদা সম্পন্না মেয়ে। তাই সে টাকা নিল না। মিজান সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন নিবে না কেন?

– আমার ভাই আমার কাছে আবদার করসে, তাই আমিই তার আবদার পূরণ করমু স্যার। স্বাদ যেহেতু হইসেই, সাধ্যও হইবো। আল্লাহ ভরসা।

– আচ্ছা তোমার বাবা-মা কোথায়?

– জন্মের আগেই বাপ মইরা গেসে। আর মায় আবার বিয়া করসে। মায়ের ওই জামাই আমারে অত্যাচার করে তাই চইলা আইসি।

– আচ্ছা তোমার ভাই…!!

– ভাইরে ময়লার ভাগাড়ে পাইসি। কেডায় জানি তারে ফালাইয়া রাইখা গেছে। এত সুন্দর পুলাডা। আমার মায়া লাগসে তাই আমি নিয়া আইসি। এত বছর ধইরা আমিই পালসি তারে।

মিজান সাহেব অবাক। এ বয়সেই অন্যের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে মেয়েটি। উনার খুব মায়া হয় আয়েশার জন্য। তিনি বুঝলেন তাকে টাকা দিলে বা অন্যকোনো ভাবে সাহায্য করলে সে তা গ্রহণ করবে না। একমাত্র একটা কাজের ব্যবস্তা করে দিতে পারলেই হয়তো সে তা গ্রহণ করবে। তিনি আয়েশাকে বললেন 

– আচ্ছা মা, আমি যদি তোমাকে কাজের ব্যবস্থা করে দেই তুমি কি কাজ করবে?

– অবশ্যই স্যার। ভালো কাজ পাইলে অবশ্যই করমু।

তিনি পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন আয়েশাকে।

– শোন। আমি কালকে তোমার সাথে আবার দেখা করবো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে। আপাতত তুমি টাকাটা নাও। তোমার ভাইয়ের আবদার পূরণ কর। পরে তুমি কামাই করে দিয়ে দিয়ো।
আয়েশা নিতে চাচ্ছে না। ইতস্তত বোধ করছে।
– আরে নেউ নেউ। বললাম তো ধার হিসেবেই দিচ্ছি।
অনেক জোরাজুরির পর সে নিতে রাজি হলো। এরপর সে তার ভাইয়ের জন্য ইফতারের খাবার কিনে আনে। আব্দুল্লাহ তো মহাখুশি। সে তার বোনকে জিজ্ঞেস করে 
– আপা তুমি এত খাউন কেমনে আনলা? তোমার কাছে তো টেকা নাই?
– আল্লায় ব্যবস্থা করসে। তুই খা।
আয়েশা মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। আর ভাবে “স্বাদ থাকলে, সাধ্য হবেই”।

 

 

 

 

সাজিদের নতুন জামা 

কলমেঃ মীযান মুহাম্মদ হাসান (লেখক, গল্পকার ও সাংবাদিক) 

গেল ঈদের জামা এখনো পায় নি সাজিদ। এবারও কটা দিন বাকি আছে ঈদের। রোজা শুরু হতেই ও দাবি করেছে- এবার তাকে একটা নতুন জামা কিনে দিতেই হবে। কিন্তু দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারে ওর বাবার এ সাধ্য নেই যে তাকে নতুন জামা কিনে দিবে। তবুও সে নতুন জামার স্বপ্ন দেখে। 

রোজ বিকেলে বাহির থেকে বিলি করা ইফতারি আনে তার বাবা। এভাবেই তিনি ছেলে মেয়ে নিয়ে খেয়ে পরে চলছেন। কোনোরকম কেটে যাচ্ছে তাদের দিন। প্রতিদিন লম্বা সারিতে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকেন সামান্য কিছু ইফতার পাওয়ার আশায়। কখনো খালি হাতেও ফিরতে হয়। সে রাতে না খেয়েই কোনোমতে রাত কাটে তাদের। কোনো দিন হয়ত সাহরিও জোটে না। তবুও কষ্টে রোজা রাখেন তারা।

কষ্টের সংসার। অভাব কখনো পিছু ছাড়ছে না তাদের। জমানো কটা পয়সা ছিল। তাও অভাবের সংসারে খেয়ে ফুরিয়ে গেছে। 

সাজিদের মা এক সাহেবের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। তাও করোনায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর পর থেকে সংসারে অভাব যেন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে তাদের। আর কোনো কাজ পায় নি, যা দিয়ে সংসারটা একটু ভালো করে চলে।

আরো পড়ুনঃ  ৩টি শুক্রবার নিয়ে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ ২০২৪

রাজধানীর ব্যস্ত শহরে অর্থহীন জীবন নরকের সমান। পকেটে টাকা নেই। পেটে খাবার নেই।গায়ে ভালো পোশাক নেই। মনে সুখ শান্তি নেই। এভাবেই দিন চলে যায়। 

দিন এনে দিন খাওয়া পরিবারে সাজিদের বাবাই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইফতার নিয়ে ফিরলেও; এক দিন খালি হাতে ফিরেন তিনি। বাবার খালি হাতে ফিরে আসায়, সাজিদের মন খারাপ। 

সে বুঝে গেছে এবারও তার নতুন জামায় ঈদ করা হবে না। পড়ালেখার পাশাপাশি কটা টাকা ফুল বেঁচে জমিয়েছিল সাজিদ। কিন্তু তাও ওর বাবার চিকিৎসার পেছনে শেষ হয়ে গেছে।   

সহায় সম্বল ভিটে মাটি কিছুই নেই তাদের। যাও ছিল যমুনার বুকে বিলীন হয়ে গেছে সব। ধুধু মরুভূমির মধ্যে চর জেগেছে। সেখানে আছে তাদের স্বপ্নের ভিটেমাটি। সাজিদেরও একটু স্বপ্ন ছিল জীবনে কিছু একটা করবে। তারা একদিন বাড়ি করে নিজ বাড়িতে ওদের নিয়ে একসাথে থাকবে।

তাই সাজিদের বাবা এই ইট পাথরের শহরে এসেছেন একটু ভালো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার আশায়। কিন্তু এখানে পয়সা কামানোও এখন অনেক কঠিন। সবসময় কাজ না থাকলে কীভাবে পয়সা আসবে? আর প্রতিদিন তো তেমন কাজও থাকে না। 

দুদিন যাবৎ কাজ নেই। মলীন মুখে বসে আছে ওর বাবা। ওরা  সবাই না খেয়ে দিন পার করছে। 

এ অবস্থা দেখে, সাজিদ ওর বাবাকে বলল- “বাজান, ঘরে খাওয়ন নাই যহন, তহন নতুন জামা কাপড় দিয়া কি অইব? আমার নতুন জামা কাপড় লাগব না। 

আমি ঈদের দিন কোনোহানে যামু না। বন্ধুদের লগেও মিশমু না। আমার নতুন জামার দরকার নাই”।

ছেলের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালেন, সাজিদকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পিতা পুত্র। আর দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,  হ রে বাজান, আমগো গরীবের কপালে ঈদ নাই মনে হয়। তবে তুই এট্টুও কান্দিস না বাজান। কাইলকা কাম কইরা যেই টেকা পামু। তা দিয়া তরে নতুন জামা কিনা দিমু। তুই বন্ধুগো লগে ঈদের দিন নতুন জামা পইরা আনন্দ করবি। 

সাজিদ : হাচা কইছো বাজান? 
হ হ,  হাচা কইছি। তুই একটুও কান্দিস না বাপ। আমি তরে নতুন জামা কিনা দিমু!

 

 

শহর আলীর রোজা থাকা

কলমেঃ সাঈদুর রহমান লিটন 

শহর আলী রোজা আছে। কয়েক বছর ধরে সব কয়টিই রোজা থাকে। রোজা থাকলে ওর ভালো লাগে।

নিজেকে আর দশজন মানুষের মতই মনে হয়। রোজা থাকলে সবাই মূল্যায়ন করে।  কেউ কিছু বলে না।একটু আধটু সন্মান পাওয়া যায়। এই জন্যই রোজার মাসটি শহর আলীর কাছে এত প্রিয়।শহর আলীর জীবন রোজা থাকলেও যেমন রোজা না থাকলেও তেমন। পেট ভরে খুব একটা খাওয়া হয় না। পেট পুরে খাওয়ার মত পরিবেশ, পরিস্থিতি বা সামর্থ্য তার নাই। শহর আলী মধুখালী রেল স্টেশনে থাকে।রেলস্টেশনের যাত্রী ছাউনিই তার বাস। ঘর বাড়ি সব কিছু। ওখানেই ও থাকে, খায় দায়, ঘুমায়। খাওয়া বলতে চেয়ে চিনতে যায় পায় তাই।রেলস্টেশনের পাশে পুরাতন একটা ঘর আছে। অনেক আগে স্টেশন মাস্টারের কামরা ছিল। এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে।ওখানেই একটা রেললাইনের পরিত্যক্ত জিনিস পত্রের উপর একটা কম্বল বিছিয়ে রাতে ঘুমায়।ওখানেই খায়। সারাদিন রেলস্টেশনের আশপাশে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষে করে আর মানুষের ফেলা দেওয়া জিনিস পত্র কুড়িয়ে জমা করে।

যেখানে থাকে ওখানেই স্তুপ করে রাখে। এক বস্তা হলে পুরানো ভাঙ্গারি দোকানে বিক্রি করে দেয়। যেদিন বিক্রি করে সেদিন মোটামুটি খাওয়া ভাল হয়। দুইশ দেড়শ টাকা পায়। কোন দিন একটু বেশি ও পায়। সেদিন তার রান্না হয়। মানে নিজে রান্না করে। অল্প কিছু তরকারি, অল্প কিছু মাছ, সামান্য টাকায় যা হয় তা নিয়ে এসে থাকার যায়গায় রাতে বসে বসে রান্না করে, মজা করে খায়। ওর কাছে সেদিন ঈদের আনন্দ মনে হয়।সেদিন ঘুম ও ভালো হয়। শহর আলীর খুব একটা বেশি  কোন চিন্তা নেই।খাওয়ার চিন্তাটাই ওর বড় চিন্তা। তাছাড়া কোন চিন্তা নাই। মা নেই, বাবা নেই।

ও কিভাবে, কোথা থেকে এসেছে তা নিজেও জানে না।প্রকৃতির নিয়মে বড় হচ্ছে শুধু এটা জানে। অন্যান্য প্রাণী ও যেমন বাঁচে শহর আলী ও তেমন বাঁচে। বেঁচে থাকে। শহর আলী যেখানে ঘুমায়, তার পাশে একটা কুকুর ও থাকে। সারাদিন যখন অবসর পায় বা ভালো লাগে তখন কুকুরটি আসে। কিছুক্ষণ বড় একটা জিহবা বের করে হাঁপায়,তারপর একবার ঘুমিয়ে পড়ে।

দারুণ মিল শহর আলীর জীবনের সাথে। কুকুরটির ও কেউ নাই। শহর আলীর ও কেউ নাই। একই জায়গায় বসবাস করে। চিন্তামুক্ত দুই প্রাণী। এমনই বা কয়জন আছে। তবে কুকুরটির সাথে শহর আলীর সখ্যতা নেই।তেমন দুইজনের কেউ কাছাকাছি আসে না। বা ভাবের বিনিময় হয় না। কে কোথায় কি করে খোঁজ খবর রাখে না। তবে প্রতিরাতে তাদের দেখা হয়ে যায়। চোখাচোখি হয় কখন ও।  দুই জনই পরিচিত। স্টেশনে কখনো দেখা হলে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে কুকুর টি। শহর আলী তেমন টি করে না। ভাব বিনিময় করে না। পানে পাত্তা দেয় না। শহর আলীর  নামটি কে রেখেছে তা শহর আলী জানে না। তবে নামটি ওর ভালো লাগে। অন্তত মনে হয় শহরে আছি এমন ভাবে। মধুখালী তো একটা উপজেলা শহর ই। এখানেই থাকে এখানেই বাস। সে হিসেবেই হয়ত কেউ তার নামটি রেখে দিয়েছে। নামটি রাখার জন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায়। মাঝে মাঝে বাবা মায়ের কথা ভাবে। কারা তার মা-বাবা?  পরে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় যা নাই তা নিয়ে ভেবে লাভ কি?

আরো পড়ুনঃ  বান্ধবীকে নিয়ে লেখা গল্প

অহেতুক মনে কষ্ট পাওয়া তাই আর ও বিষয় নিয়ে ভাবে না। শহর আলী কোন কিছুই নিয়ে ভাবে না। নামটা নিয়ে ভাবে। যেহেতু নাম তার শহর আলী। তাই সে মুসলমান। তাছাড়া সে হিন্দু না মুসলমান নাকি বৌদ্ধ- খ্রিস্টান সে কিছুই জানে না। নামের জন্যই তার 

মুসলমান ধরে নিয়েছে সে। সে কোন সুরা কেরাত পারে না। নামাজ পড়তে গেলে মানুষের সাথে শুধু ওঠ বস করে। মসজিদে গেলে তার ভালো লাগে। এই একটা জায়গা খুবই শান্তির জায়গা। সবাই যে মানুষ, তার একটা মূল্যায়ন হয়। ধনী দরিদ্র বাদ বিচার নাই। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়। তখন নিজেকে মানুষ ভেবে গর্ববোধ হয়। মুসলিম ধর্মটাকে ধন্যবাদ জানায়। মন থেকে সালাম জানায়। শুক্রবারে শুক্রবারে নামাজ পরেই জেনেছে।নামাজ পড়তে হবে। মুসলমানদের চেনার একমাত্র উপায় নামাজ পড়া। তাছাড়া নামাজের হিসেব নেওয়া হয়।নামাজ পড়লে বেহেস্ত পাওয়া যায়।বেহেস্ত হলো চরম সুখের স্থান। এখানে তো সেই সুখটা পাওয়া হলো না তাই সেই পরকালের সুখের জন্য এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। রোজার গূরুত্ব সেখান থেকেই শিখেছে।

রোজা থাকলে আরেক টি বিষয় মসজিদে ইফতারি দেয়। রোজা না থাকলে তো দেয় না। তাই রোজা থাকার প্রতি তার ঝোঁক।ইফতারের সময় ফল,মূল খেজুর, শরবত পাওয়া যায়। যা সে কখনো খায় নাই তাও খাওয়া যায়। শহর আলী ভাবে মুসলমান হয়ে ভাল হয়েছে অন্তত একটা মাস খুব ভালোমন্দ খাওয়া যায়। খিচুরি,বিরিয়ানি অনেক কিছুই খাওয়া যায়। পেট ভরে খেয়ে আবার সেহেরির জন্য চেয়ে ও নিয়ে যায়। রেলস্টেশনের সামনের মসজিদের মুসল্লীরা এখন শহর আলী কে চেনে। তাই শহর আলীকে সেহেরি খাওয়ার জন্য বেশি করে খাবার দিয়ে দেয়। শহর আলীর মনে 

আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠে। পেট পুরে খাওয়ার আনন্দ। রোজা থাকাও হয় আবার পেট ভরে খাওয়া ও যায়।  শহর আলী ভাবতে থাকে এভাবে সারা বছর রোজা থাকতো। কত ভালোই না হতো। ছোট মানুষ। ছোট চিন্তা। খাওয়াকেই জীবনের প্রধান কিছু মনে করে সে। খাওয়া ছাড়া জীবনের আর কিছু যে আছে তা শহর আলীর ভাবনার মধ্যে নাই। কিন্তু সেই খাওয়াটাই অপূর্ণ থেকে যায় তার জীবনে। শহর আলী কখনো স্কুলে যায়নি। লেখা পড়া সম্পর্কে তার ধারণাই নাই। কোন মক্তবে গিয়ে আরবি শিক্ষা দেয় নি কেউ। 

তবে দুইটি সুরা সে মুখস্থ করেছে। সেই সুরা দুটি দিয়েই নামাজ পড়ে। ধর্ম কর্ম যা যা কিছু তার ঐ সুরা দুটিই।

শহর আলীর ইচ্ছে হয় লেখাপড়া করার, কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগ দেয় নাই। শহর আলীর সে বিষয়ে আফসোস ও নাই। তবে রোজা থেকে ইফতারের পর আরো অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছে করে। গরম গরম চপ, বেগুনি, ভেজে রাখা চিংড়ি মাছ, হালিম। মাঝে মাঝে দোকানের পাশ দিয়ে ঘুরে আসে। কিন্তু চাওয়ার সাহস হয়না। চাইলে কেউ দিবে না। বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে শহর আলীর সেই জ্ঞান টুকু আছে। শুধুমাত্র দেখে আর ঘ্রাণ নিয়ে নিজের ভিতরের খাবার ইচ্ছে টা পূরণ করে। অসাধারণ চিন্তা ভাবনা। এই তো সেদিন কুড়ানো সেই বোতল আর অন্যান্য ফেলনা জিনিস পত্র ভাঙ্গারি দোকানে বিক্রি করে ৭৫ টাকা পেয়েছিল। সেদিন তার দই আর হালিম খেতে ইচ্ছে করেছিল। হালিম টা কি কেমন স্বাদ ও জানে না। ওর বয়সি অনেকেই খায়।

খুব তৃপ্তি ভরে খেতে দেখেছে। এই জন্যই ভাবে কত না জানি স্বাদ।তাই হালিম খাবারের জন্য প্রবল ইচ্ছা।

ইফতারের পর হালিম খেতে যায় শহর আলী। দোকানদারকে হাফ প্লেট হালিম দিতে বলে।এক প্লেট হালিমের দাম দেড়শ টাকা কয়েকদিন আগেই দাম জেনে গেছে সে। দোকানদার হালিম দিতে দেরি করলে 

শহর আলী বলে ভাই, আমাকে হাফ প্লেট হালিম দেন।

দোকানদার বলে যা তোর হালিম খেতে হবে না। তোর কি টাকা আছে? অনেক লোক সেখানে। হালিম খাচ্ছে কেউ কেউ। শহর আলী বলল আমার কাছে পচাত্তর টাকা আছে। দোকানদার ধমক দিয়ে বলল, তোর হালিম খেতে লাগবে না। তোকে দেওয়ার মত প্লেট আমার নাই। তুই এখান থেকে চলে যা।

শহর আলী অনেকটা লজ্জা পেল।সব মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি চোখ শহর আলীর বুক খুঁচিয়ে রক্ত বের করে নিচ্ছে মনে হতে লাগল। এক পা দুই পা করে শহর আলী পিছিয়ে যাচ্ছে, আর ভাবছে আমার হালিম খেতে নাই।

টাকা থাকলেও আমার হালিম খেতে নাই। আমার খাওয়ার জন্য প্লেট উনার কাছে নাই।

শহর আলী হাঁটতে হাঁটতে সেই পরিত্যক্ত কামরায় চলে আসে। এসে দেখতে পায় সেহেরি খাওয়ার জন্য যে খাবার এনে ছিলো সেই খাবার কুকুরটি খাচ্ছে। শহর আলী অবাক হয় না। মনে মনে বলে তুই আর আমি একই প্রাণি। 

তোর জন্য কারো প্লেট নাই। আমার ও খাওয়ার জন্য কারো কাছে প্লেট নাই। কুকুরের খাওয়া বাকি খাবার গুলো শহর আলী তুলে নেয় শেষ রাতে সেহেরি খাওয়ার জন্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *