আলো-আঁধার কলমে ইমরান

আলো-আঁধার
কলমে ইমরান

পরিক্ষা শেষ করে একটা সিগারেট নিয়ে ফাঁকা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রাস্তার জ্যাম দেখছি। ভালোই লাগছে দেখতে। দিনের আলো কমে এসেছে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জলতিছে। হাজার গাড়ির হরেক রকমের আলো।
আমার মনে হয় রাস্তায় জ্যাম লাগলেই মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সামনে ব্লক দেখেও কয়েকজন হর্ণ দিতেই আছে। আমার মনে হয় এরা সাইড নেওয়ার জন্য হর্ণ বাজায় না, বাজিয়ে মজা পায় বলে বাজায়। আশেপাশের কার সমস্যা হচ্ছে কি না হচ্ছে তাতে এদের কোন মাথাব্যথা নেই।

সাইড থেকে এক পিচ্চি ডাক দিয়ে বলল,
-বস, দুইডা ফুল লন। ২০ টেহা দাম তয় আপনে ২৫ টেহা দিয়েন।

তাকিয়ে দেখি পাশে সুপারম্যান দাড়িয়ে। সুপারম্যান বললাম কারণ এই হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে সে শুধু একটা হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডোগেঞ্জি পরে আছে। হাতে ছোট একটা বালতি। সেখানে ৮-১০ টার মতো গোলাপ।
‘২০ টাকার ফুল তুই ২৫ টাকা নিবি কেন?’
-এক কাপ চা খামু ৫ টেহা দিয়া।
‘আমাকে খাওয়াবি না?’
-তাইলে ৪ডা ফুল লেওন লাগবো, ৫০ টেহা।
’ঠিক আছে আগে চা খাই চল, ফুল না হয় পরে নেওয়া যাবে।’

পিচ্চির বয়স আনুমানিক ৮/১০ বছর হবে। রাস্তায় রাস্তায় ফুল বিক্রি করে বেড়ায়। শহরের সব রাস্তা ওর মোটামুটি চেনা। আমাকে সাথে নিয়ে এক গলির ভেতরের চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। আমি গায়ের জ্যাকেটটা খুলে চায়ের চুলার পাশে বসলাম। বেশ আরাম লাগলো।
-কাকা, কড়া লিকারে স্যাকারিন দিয়া দুইডা চা বানাও। বস, কড়া লিকার চলবো তো নাকি?
‘কড়া লিকার তো চলবে কিন্তু চায়ে স্যাকারিন কেন?’
-গরীবের চা, খাইয়া দেহেন। আবার আইতে অইবো।

চা আসলেই সুন্দর হইছে। সচারাচর এমন চা খাওয়া হয় না। চা খেতে খেতেই জিজ্ঞেস করলাম,
‘নাম কি তোর?’
-মানিক, তয় সগ্গোলে মনি কইয়া ডাহে।
‘ঠান্ডা লাগে না তোর? এই শীতের মধ্যে খালি গায়ে বেড়াচ্ছিস!’
-লাগে, তয় আস্তে আস্তে একসময় সয়া যায়। কি করুম গায় দেওয়ার কাপুড় নাই।
‘তোর মা আছে?’
– জ্বে না, মইরা গেছে। আমার জন্মের দুই বছর আগে!
‘বলিস কি! তুই তাহলে কার পেটে হইছিস?’
– আমার আব্বা আমগো বস্তির এক বেটির লগে পিরিতি করেছিলো। হের প্যাডে। আমি তারে চাচি ডাকি।
‘ সর্বনাশ। তোর নিজের মা কে চাচি ডাকিস! তোর বাপ বেঁচে আছে?
– নাহ, হেয় মরছে আমার মায়েরও মেলা আগে।
‘ধুর ব্যাটা! তাহলে তোর জন্ম হলো কিভাবে?
– আমার বাপ যে বেটির লগে পিরিতি করেছিলো হে আমার বাপ মরার পর আরেক বেটার লগে গেছিলো ভাইগা। তারে আমি চাচা ডাকি।
‘কি আশ্চর্য! তাহলে তোর বাবা মা কে তুই চাচা চাচি ডাকিস কেন?’
-এমনি ভাল্লাগে তাই।
‘তোর বাপ-মা মানে চাচা চাচি তোর দেখভাল করে না?’
-জ্বে না, তারা এখন দেশ চালায়।
‘তুই কাকে চালাস এই টাকা দিয়ে?’
-দুনিয়া।

আরো পড়ুনঃ  কন্যারা_এ_যুগে_পিঞ্জিরাবদ্ধ আফিফা ইবনাত স্পর্শিয়া

আমি আর কিছু বললাম না। চায়ের ১০ টাকা দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। পেছন থেকে মনি ডাক দিল।
-বস ফুল নিবেন না?
‘ফুল কেনার মতো টাকা নাই আমার কাছে।’
-আপনের জ্যাকেটটা নিয়া যান। খুইল্যা রাখছিলেন।
‘রেখে দে।’

একবার মনে হলো মনির রিয়্যাকশনটা দেখি কিন্তু আর পেছন ফিরে তাকালাম না। আমি আবার রাস্তায় বেরিয়ে পরলাম। এবার হালকা হালকা শীত লাগা শুরু হইছে। পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরালাম। রাস্তায় এখনো জ্যাম আছেই। আমি আবার সেই জ্যাম দেখছি, এবার হাঁটতে হাটতে। ভালোই লাগছে।

নিয়মিত পড়ুন এবং লেখুনঃ- চিরকুটে সাহিত্য প্লাটফর্মে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *