রংপুরের লেখিকা নিলুফার জাহান রুবাইয়া’র সেরা গল্প “দাদুর বঙ্গবন্ধু”

লেখিকা পরিচিতিঃ নিলুফার জাহান রুবাইয়া। ২০ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে জন্ম। পৈতৃক নিবাস চকফুলা পীরগঞ্জ রংপুর। পিতা: আব্দুর রশিদ সরকার, মাতা: দিলরুবা জাহান। বর্তমানে রংপুর সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে অধ্যায়ন করছেন। ইতিপূর্বেই বিভিন্ন যৌথবইসহ বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। করোনা কালীন অবসর সময় কাটাতেই সাহিত্য জগতে প্রবেশ। “দাদুর বঙ্গবন্ধু” গল্পের জন্য তাকে রূপকথা সাহিত্য সংসদ কতৃক কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য পুরস্কার – ২০২৩ প্রদান করা হয়।

দাদুর বঙ্গবন্ধু
নিলুফার জাহান রুবাইয়া

মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে ভেজা মাটির অদ্ভুত এক সিদ্ধ গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। সবাই সবার মতো করে বৃষ্টিবিলাস করছে। আমার বয়সের ছেলেরা মাঠে বৃষ্টির মধ্যে ফুটবল নিয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে ব্যস্ত। আর এদিকে আমি চার দেয়ালের মাঝে বদ্ধ এক ছোট ব্যালকুনিতে বসে তাদের বৃষ্টিবিলাস দেখছি। আমার মতো আরো একজন সেও আমার মতো করেই বৃষ্টিবিলাস করছে। তার আর আমার মধ্যে যেটুকুই পার্থক্য তা হলো বয়সের। মানুষটি আমারদের পাশের ফ্ল্যাটের। যখন প্রথম এই ফ্ল্যাটে আসি তখন প্রায়ই দেখতাম আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে হুইল চেয়ারে বসা এক বৃদ্ধ কারো সাথে গল্প করার একরাশ ইচ্ছে নিয়ে বসে থাকতো। তিনি তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের কথা প্রতিটি চায়ের চুমুকে যেন বলতে চাইতেন।অথচ তিনি একা। তাকে সময় দেবার মতো বা গল্প করার মতো কেউ নেই। আমারও গল্প করার মতো কেউ নেই। বাবা মায়ের একমাএ সন্তান আমি। তারা কাজে ব্যস্ত। তাই আমি তার কষ্টটা বুঝি।খুব আফসোস হয়, কেউ তো একজন থাকতে পারতো মনের কথা শোনার জন্য। অবশেষে আমরা বন্ধু হলাম। মানুষটার সঙ্গে সঙ্গে আমারও একাকিত্বের অবসান ঘটলো। মানুষটা প্রায়ই আমাকে তার জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলে। আজও আমরা গল্প করছি…..

দাদু, তোমার এত চা খেতে বিরক্ত লাগে না?

আরো পড়ুনঃ  বাস্তবতার মুখোমুখি কলমে আমাতুল্লাহ খাদিজা খুশি

বিরক্ত কেন লাগবে রে? চা হলো সৌখিন মানুষদের খাবার। যারা চা খায় না তারা এখনও সুখের সন্ধান পায়নি। রাত হোক কিংবা দিন, আমার কাছে চা মানেই নিকোটিন। তুই খেলতে যাবি না?

– মা যেতে দিবে না।

– কেন?

– বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসবে। সামনে যে পরীক্ষা। তাছাড়া বৃষ্টিতে খেলতে গিয়ে যদি চশমাটা ভেঙ্গে যায় তাহলে আমি দেখবো কি করে। আমি যে চশমা ছাড়া চলতেই পারি না।

– চশমা ভেঙ্গে গেলে নতুন চশমা পাওয়া যাবে।কিন্তু এমন সুন্দর মুহূর্ত জীবন থেকে একবার চলে গেলে তা আর ফেরানো সম্ভব না রে।

– না দাদু। বাবা বলেছে এবার চশমা ভাঙ্গলে আর কিনে দিবে না। তাছাড়া বিল্টুটা সুযোগ পেলেই আমার চশমা নিয়ে টানাটানি করে। আমাকে মারে। তাই আমি যাবো না।

– কেন মারে?

– অন্যায়ভাবে আমাকে মারতেই থাকে। ওকে আমার খুব ভয় লাগে।

– তুই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানিস না! একদিন প্রতিবাদ করবি তো দ্বিতীয় দিন তোর দিকে হাত তোলার সাহস পাবে না। কেন তুই আমাদের খোকার ভাষণ শুনিসনি! ওই যে,❝রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। তবুও এই বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।❞ ঠিক সেরকমই প্রতিবাদী হতে হবে।

– কিন্তু বাবা মা চায় না আমি কোনো ঝামেলায় জড়াই।

– আমি তোকে ঝামেলা করতে বলছি না রে। আমি বলেছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। তুই জানিস এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। তবুও তিনি কোনো কিছুতে ভয় পেয়ে পিছু সরে যাননি। তোরাই তো হবি আগামী দিনের বঙ্গবন্ধু। সেই তোরাই যদি পিছিয়ে যাস দেশটাকে কে রক্ষা করবে বল!

অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন,❝যতদিন রবে পদ্ম-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।❞ এর অর্থ শেখ মুজিবুর রহমান তিনি তো আমাদের জাতির পিতা, আমাদের গর্ব, আমাদের ভালোবাসা। তার প্রণয়ের ৪৮ বছর পরেও তিনি আমাদের মাঝে, এই বাংলার মাঝে আছেন। তিনি থাকবেন তোদের মতো সাহসী তরুণ যুবকদের মাঝে। যাদের দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ। ওরে তোদের মাঝ থেকেই তো তৈরী হবে এক একটা বঙ্গবন্ধু। সেই তোরাই যদি ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকিস তবে কি করে তা মানি বল!

আরো পড়ুনঃ  লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের রকমফের

– আমি কি করবো বলো! বর্তমানে কেউ প্রতিবাদ করলেই যে তাকে চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়।

– তাই বলে কি সত্যের মুখোমুখি হবি না! তোদের মতো বয়সে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধে গিয়েছি। এই দেশ আমার মা, আমি সেই মায়ের জন্য হাতে অস্ত্র তুলেছি। দেশ থেকে হানাদারদের বিদায় করেছি। ভাবলেই আমার গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। যতদিন পেরেছি সুপুরুষের মতো সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছি। জানিস তোর আর আমার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আমি বার্ধ্যকের জন্য হুহলি চেয়ারে বসে আছি। আর তুই এই বয়সে নিজে থেকে অদৃশ্যভাবে এক অদৃশ্য হুইল চেয়ারে বসে আছিস।

– আমিও বঙ্গবন্ধু হবো।

– বঙ্গবন্ধু হওয়া কি মুখের কথা! বঙ্গবন্ধু হতে গেলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, সাহসের সঙ্গে বাঁচতে হবে। তোকে আগে ওই অদৃশ্য হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে হবে।প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে হবে।

– তুমি দেখো দাদু, আমিও একদিন বঙ্গবন্ধু হবো। দেশের হয়ে কাজ করবো। সেদিন তোমার কথা মতো প্রকৃতির সঙ্গে মিশে দেখাবো।

– তবে তাই করে দেখা। বৃষ্টিটা থেমে গেলো। ছেলেগুলোও খেলার মাঠ থেকে চলে গেলো।তুইও যা অনেক তো হলো গল্প।

পরেরদিন…
– দাদু আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তুমি নিজের যত্ন নিও। বাবার বদলি হয়েছে। আমি তোমাকে দেখতে আসবো। যেদিন আসবো সেদিন বঙ্গবন্ধু হয়ে আসবো তুমি দেখো দাদু।

– যাচ্ছিস যা। মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে আমাকে দেখতে না এলেও আমাকে দেয়া কথা তুই রাখিস।

বছরের পর বছর চলে যায়। শুনেছি পাশের ফ্ল্যাটের সেই ছোট্ট ভীতু ছেলেটি এখন একজন দেশপ্রেমিক। সে পেরেছে অদৃশ্য হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে। দেশের জন্য তার নিবেদিত প্রাণ। সকল অন্যায়ের প্রতিবাদে সবার আগে সে। বঙ্গবন্ধুর আর্দশে বড় হয়েছে সে। এ যেন এক বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছবি। সেই ছোট্ট ছেলেটি কথা রেখেছে। দাদুকে দেখতে এসেছিলো তবে তাদের দেখা হয়নি। দাদু চলে গেছেন ওপারে। তবে তিনি সকলকে জানিয়ে গেছেন তার বঙ্গবন্ধুর কথা, সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা।

আরো পড়ুনঃ  একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প | একজন আসল মুক্তি যোদ্ধা

 

আরো অসংখ্য লেখা পড়তে চিরকুটের সাথেই থাকুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *