বাবার লেখা চিঠি | বাবার চিঠি

বাবার লেখা চিঠি | বাবার চিঠি কলমে শাহ্ কামাল

বাবার চিঠি
— শাহ্ কামাল

স্নেহের বাবা সোনা, কেমন আছিস তুই?
অনেক বছর হয় দেখিনা তোকে।
অবসরের পর মাস কয়েক পাশে ছিলি,
চাকুরির কথা বলে আমার শেষ সন্চয়ের
টাকাগুলি নিলি। চাকুরি হল কিনা
আজো জানা হল না।
লোকে বলে তুই নাকি ভাল আছিস।
চৌদ্দ বছর কেটে গেল।
একটি বারো খোঁজ নিলি না
তোর কি মনেপড়ে আমাদের?
আমি হাঁটতে পারি না, বাবা।
তোর মা শয্যাশায়ী তিন বছর।
ওষুধ কিনতে পারি না,
টাকা নেই,
তুই কি শুনবি আমার এ কথাগুলো?
যেদিন তোর মা বলল, একটা খুশির
খবর আছে, বলতো কী?
আমি ভেবে বলবার আগেই তোর মা
অট্ট হাসি হেসে বলেছিল, তুমি বাবা হচ্ছো
তুই কী জানিস এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে
বেশি খুশি কেঊ ছিল না রে।
পরদিন থেকে অফিসে চেয়ে অতিরিক্ত
সময় কাজ করতাম তোর জন্য।
তুই জন্মনিবি।
তোর মায়ের চিকিৎসা দরকার,
ভাল ভাল খাবার দরকার,
জিনিসপত্রের যা দাম!
আমার মাইনেতে কুলোবে না।
পথে ঘাটে কত কি বিক্রি করতো
চোখ সামলে মনকে বোঝাতাম।
মাসে একবার তোর মাকে কাচ্চি
বিরিয়ানি আর কাবাব খাওয়াতাম।
তাও আর হয়ে ওঠেনি।
তোর জন্মের সময় অনেক খরচ হবে
বলে টাকা জমাতাম দুজনে।
রোজ বিকেলে তোর মায়ের সাথে আড্ডা
দিতাম আর ধোঁয়া ওঠা চা এ চুমুক দিতাম
তাও হয়নি আর।
অফিস থেকে দেরী করে রোজ ফিরলেও
তোর মাকে সময় মতো ডাক্তারের কাছে
নিয়ে যেতাম স্বযতনে।
বাবা, খুঊব শীতে তোর মাকে নাস্তা
বানাতে বারণ করতাম।
যদি তোর কিছু হয়ে যায়।
তোর যখন জন্ম হল সিজারে
তোর মা খুঊব কষ্ট করে বেঁচেছিল।
তোর নরম পায়ের আঘাতে তার
সেলাইয়ের জায়গাতে ইনফেকশন হয়ে গেছে।
তোর কাঁথাগুলো অফিসে যাবার আগে
রোজ রোজ আমি ধুয়ে দিতাম।
আমার শত ব্যস্ততায় তোর জন্য
শন পাপড়ি আনতে ভুল করিনি কখনো।
তোর কি এসব মনেপড়ে, বাবা?
তোর মা শুধু বিরবির করে তোকে ডাকে।
তোর মনে আছে রুমুর সাথে খেলতে
গিয়ে ডান পা টা ভেঙ্গে গিয়েছিল?
আমার সাইনাসের অপারেশন না করে
তোর পায়ের চিকিৎসা করেছিলাম।
আজো আমার সাইনাসের অপারেশন
হয়নি
বৃষ্টিতে তোকে স্কুলে দিতে গিয়ে
একফোঁটা বৃষ্টি তোর গায়ে লাগতে দেইনি
ঠান্ডায় মাথা বড্ডো ভার হয়ে যেতো।
তবুও কোনদিন তোকে ভিজতে দেইনি।
কোন ঈদে তোর কোন চাওয়া অপূর্ণ রেখেছি, বাবা?
পুরনো শার্ট আর জুতো জোড়ায়
আমার ঈদ দিব্যি চলে যেতো।
এখনো আমার ঈদ তেমনই যায়
আধপেটা বা না খেয়ে খেয়ে স্মৃতিতে
ধুলো জমে সব ঝাপসা হয়ে আসছে।
তোর যখন তিন বছর,
মাঘের রাত। রাত্রি এগারো হবে
তোর খুঊব বমি হচ্ছিল
একটু পর পর বমি দেখে তোর মায়ের
সে কি কান্না। তোর দাদুর দেয়া
সুতো ওঠা শালটা জড়িয়ে আমি
হাঁটতে শুরু করলাম এক জোড়া চপ্পল পায়ে দিয়ে।
শীতে আমার পা বেঁকে যাচ্ছিল বারবার
এ মোড়, ও মোড় সব খুঁজে একটা
ফার্মেসীও খোলা পাইনি, বাবা।
শেষমেষ ছয় কিলো পর একটা ছোট্ট
ফার্মেসী খোলা পেয়েছিলাম সরকারি হাসপাতালের কাছে।
সেখান থেকেই তোর জন্য বমির ওষুধ
এনেছিলাম সেই রাতে।
আড়াইটায় যখন তুই ঘুমোলি
আমি আর তোর মা ঘুমোইনি সারারাত।
বাবা, সোনা যাদু আমার, তুই ভাল আছিস?
এখন ভর দিয়ে চলবার লাঠিটা কেনার পয়সা নেই,
তোকে দেখতে ইচ্ছে করে খুঊব
শুনেছি বিয়ে করেছিস
দুটো নাতিপুতিও নাকি হয়েছে
তারা কার মতো দেখতে ?
ওরা কি ওদের দাদু-দিদা দেখতে চায় না?
ওদের কি বলিস, বাবা?
ওরা কি তোর কাছে তোর মত চিকেন ফ্রাই খেতে চায় রোজ রোজ?
এনে দিস তো ওদের?
আমাদের দুবেলা ডাল ভাতও জোটে না রে
এই বয়সের ওষুধের দাম ভাতের চেয়ে বেশি
তোর একটা বায়নাও অপূর্ণ রাখিনি অথচ
আজ আমাদের একটাই বায়না,
যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস।
তোর মা একটু দই চিড়ে খেতে চেয়েছে
আমি বেশি হাঁটতে পারি না বলে
তার চাওয়া আজো পূর্ণ হল না।
তোর এক কঠিন ব্যামো সাড়াবার জন্য
তোর মায়ের মানত ছিল কখনো
সোনার গহনা পরবে না।
আজো তাই বিয়ের মাদুলী স্পর্শ করে না
ঝং ধরা কৌটোতে রাখা আছে তোর বঊয়ের জন্য।
তোর সেই গরীব বন্ধু আসিফ যার শহরে চাকুরি হয়নি সে এসে মাঝে মধ্যে খোঁজ নেয়।
আমার চাদরটা এতটাই ছিড়েছে যা
আর পরা যায় না, বাবা।
টিনের ঘরে খুঊব ঠান্ডা।
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে
কত পৌষ মাঘ অনায়াসে চলে গেল।
এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না
অনেকেই মোবাইলে ছেলের সাথে
কথা বলে মনখুলে,
আমার মোবাইল নেই
কোন টিঊনও বাজে না।
আমার কথাগুলো তুই কি শুনবি?
আমার চশমার ফ্রেম দুটাে আছে
গ্লাসগুলো অর্ধেকটা ভাঙ্গা
তবুও আমি দূর পথে চেয়ে থাকি প্রতিদিন
তোর প্রতীক্ষায়।
মা চলে যাবার আগে একটি বার
আসবি, বাবা?

আরো পড়ুনঃ  জীবনে শিক্ষা

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *