মায়া নিয়ে গল্প | মায়া কলমে ঝুম্পা বড়ুয়া

মায়া নিয়ে গল্প | মায়া কলমে ঝুম্পা বড়ুয়া

মায়া
কলমে ঝুম্পা বড়ুয়া

 

আদ্ভিক— কিরে! কাল থেকে তো একবারও ফোন করলি না! রাগ করেছিস বুঝি? আচ্ছা!” বললাম তো আই অ‍্যাম রিয়েলি স‍্যরি!

শুভশ্রী— না রে! রাগ অভিমান আবার আমার হতে আছে নাকি? ওসব তোদেরই হয়!”

আদ্ভিক— আচ্ছা শোন না! রাগ করছিস কেনো? কি করবো বল? বসটাই কাল লাস্ট মোমেন্টে ঝুলিয়ে দিলো। নাহলে তো আরও আগে

শুভশ্রী— থাক। আর এক্সকিউজ দিতে হবে না। বলি আমার জন্য কি একটুও সময় নেই তোর?

আদ্ভিক— ট্রাস্ট মি! আমি আগেই অফিসে বলে রেখেছিলাম যে আমার কাল একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। লাস্ট মোমেন্টে একটা ইম্পর্ট্যান্ট ক্লায়েন্ট মিটিং এসে গেলো, আর না করতে পারলাম না

শুভশ্রী— তুই তো কখনোই না করতে পারিস না! একটা দিন একটু তোর সাথে সময় কাটাতে চাওয়াটা কি খুব বেশি?

আদ্ভিক— আমি কি সেটা বলেছি? ইনফ্যাক্ট আজ তো আমার প্ল্যানই ছিলো অফিসের পর তোকে বাড়ি থেকে লং ড্রাইভে যাবো ঘুরবো খাবো। তুই তো বললি কোথাও যাবি না। বাড়িতে একসাথে আমার সাথে সময় কাটাবি।
কেন রে? আমি তোর বাড়িতে এসেছি বলেই কি সমস্যা? বল তবে, চলে যাচ্ছি। আমায় ছাড়তে পারলেই বাঁচিস বল?

আদ্ভিককে দু বাহুতে জড়িয়ে ধরে শুভশ্রী । প্রথমে একটু হাত পা ছুঁড়লেও, আদ্ভিকের সারল্য মাখা, মিষ্টি মুখটার দিকে এক ঝলক দেখে আর চোখ ফেরাতে পারে না শুভশ্রী। সব মান-অভিমান, রাগ-দুঃখ এই একটা গন্তব্যে এলে তার গলে জল হয়ে যায়। সে পারে না, এই একটি মানুষের ভালোবাসাকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। শুভশ্রীর মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে অাদ্ভিক একটা দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় তার ললাটে

শুভশ্রী – তারপর মুখটায় অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে আধো আধো গলায় বলে,ছাড়ো কেউ দেখে ফেলবে!”

আদ্ভিক— তোকে ছাড়বো কে বলেছে? আমি তো বলি সবসময়, ‘পাগলী,

শুভশ্রী— থাক, আর ঢং করতে হবে না। তোকে আর বদলাতে পারলাম না।

আদ্ভিক— বদলাতে চায় কে? আমি তো থেকে যেতে চাই তোর হাত ধরে, এই জীবনের শেষ অবধি। বৃদ্ধ হতে চাই তোর সাথে। সেই কলেজ থেকে আজ অবধি কত ঝগড়া করেছি বলতো? কিছু কি বদলেছে কখনো?

আরো পড়ুনঃ  ডায়েরীর পাতা থেকে কলমে ইশরাতুল জান্নাত

শুভশ্রী— ইঞ্জিনিয়ার’রাও যে এত কাব্যিক হয় তা তোকে না দেখলে জানতাম না।

আদ্ভিক— আমার হবু বৌয়ের জন্য সব হতে রাজি।

শুভশ্রী— আর যদি আমার কিছু হয়ে যায়? আসলে জীবনে কখন কি হয়? মাঝে মাঝে ভয় পাই জানিস তো, এটা ভাবলেই যে জীবনটা অনেক ছোট, একদিন তোকে ছেড়ে আমাকেও চলে যেতে হবে কালের নিয়মে।

আদ্ভিক— চুপ! একদম চুপ। এসব শুনতে চাই না আমি। এখন বল তো, কি খাবি? কিছু অর্ডার করব?

শুভশ্রী— ধুর! অর্ডার করায় মজা নেই।আজ শুধু গল্প করে দিন কাটাবো।

আদ্ভিক— জো হুকুম, ম্যাডাম!

শুভশ্রী— বাই দি ওয়ে, শোন্ না! তোর জন্য তোর প্রিয় গ্রিন লেজ এনেছি, খাবি তো? হোয়াইট সস পাস্তা উইথ লেজ…

আদ্ভিক— বাবাঃ! এত্ত ভালোবাসা?
তবে আমি কিছুটা খেয়ে নিয়েছি কিনেই। লোভ সামলাতে পারিনি

শুভশ্রী- কাঁচুমাচু মুখ করে বলে
বাহ্! কি দারুণ বর আমার! চিপস কিনে নিজেই খেয়ে নিয়েছে…

আদ্ভিক— এই নে তোর জন্যও আছে। দেখি,খাইয়ে দিই!

শুভশ্রী— আগে আমায় ধরে তো দেখা, তারপর! আয়, আয় আদ্ভিক, আমায় ধর এই তো, আমি এখানে!

আদ্ভিক – কি করছিস ! পড়ে যাবি তো, উফ! এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। দাঁড়া বলছি

শুভশ্রী— হাহাহাহা!
ছুটে যায় এই ঘর থেকে ওই ঘর আর সে খিলখিলিয়ে হাসছে। মেয়েটা বরাবরই প্রাণবন্ত, দুরন্ত। আস্তে আস্তে তার কথাগুলো আবছা হয়ে আসে। তারপরেই আদ্ভিক কানে বেজে উঠল এক কান ফাটানো আর্তনাদ।

আআআআ… অাদ্ভিক

শুভশ্রীর আর্তনাদ কানফাটা চিৎকার আর তারপর কিছুক্ষণের জন্য সব নিস্তব্ধ। চারিদিক ভেসে যাচ্ছে রক্তে, চাপ চাপ রক্ত এদিকে ওদিকে। অাদ্ভিকের কানে চিৎকার, মানুষের কোলাহল, ভিড়, হাসপাতালের ব্যস্ততা আর ডাক্তারদের চিৎকারের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। সেই, সেই কথাগুলো তার মাথায় বেজে উঠতে থাকে বারবার,

আরো পড়ুনঃ  খেয়া বালিকা কলমে বখতিয়ার উদ্দিন

নো, মিস্টার আদ্ভিক চ্যাটার্জী! শি ইজ নো মোর।

আদ্ভিক – এক মর্মভেদি বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল। মাথাটা চেপে ধরে সে বসে পড়লো মেঝেতে, তার চুল উসকো-খুসকো। জামাটা ময়লা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে, সে হাত পা ছুঁড়তে থাকে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে।
আর পারছি না! আর পারছি না! শুভশ্রী যাস না শুভশ্রী তোর আমার স্বপ্ন, আমাদের সংসার, আমাদের সবটা ফেলে এইভাবে যাস না!
চিৎকার করে ওঠে অাদ্ভিক হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে দেয়। অাদ্ভিকের মা ছুটে আসে, সে তার ছেলেকে দু হাতে জড়িয়ে বলে,

আদ্ভিকের মা – অাদ্ভিক এই অাদ্ভিক। কি হয়েছে? তুই আবার একা একা কথা বলছিস? তুই কেন শুনিস না আমার কথা। কেউ কোথাও নেই? কাকে দেখছিস তুই! কি হয়েছে তোর? তাকা বাবা! একটু দ‍্যাখ আমার দিকে! কি হয়েছে? আমায় বল?
আদ্ভিকের কান্না থামে না, সে ডুকরে কেঁদেই চলেছে। জড়ানো গলায় বলে ওঠে,

আদ্ভিক—শুভশ্রী ! মা, শুভশ্রী এসেছিলো ও এখানেই ছিলো ও কোথায় গেল বলো তো? ও সবসময় এমনই ফাঁকি দেয় আমায়! ও তো এখানেই ছিলো আমার সাথে আমার সাথে কথা বলছিলো কত অভিমান করেছিলো

আদ্ভিকের মা— কেউ নেই, অাদ্ভিক কেউ নেই! কেউ কোথাও নেই তুই একা এই ঘরে। শুভশ্রী আর নেই,আদ্ভিক ও আর এই পৃথিবীতে নেই। কেন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিস বাবা এইভাবে? শুভশ্রী বলে আর কেউ নেই??

আদ্ভিক— তোমরা মিথ্যে বলো, ‘ও এক্ষুণি এখানে ছিলো আমার সাথে কত কথা বললো। যেই না ছুঁতে চাইলাম অমনি (কাঁদো কাঁদো গলায় )
আদ্ভিকের মা ছেলের অবস্থা দেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

আদ্ভিকের মা – শুভশ্রী চলে গেছে আজ দু বছর। সেদিন অাদ্ভিক বাড়ি থেকে বেরোতে খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খায় শুভশ্রী, পা স্লিপ করে যায় চারটে সিঁড়ি টপকে, আর তারপরই কান ফাটানো আর্তনাদ।
ছুটে এসেছিলি তুই কিন্তু ততক্ষনে যা অঘটন ঘটার ঘটে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে আর থামেনি শুভশ্রী যখন থেমেছিলো, তার শরীর রক্তে মাখামাখি, মাথা থেকে ভেসে আসা লাল তরল মার্বেল পাথরের সাদা সিঁড়িটা’কে একদম রক্তজবার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। সাথে শরীর থেকে সেখানে মিশে যাচ্ছে শুভশ্রীর আত্মা’টা। অাদ্ভিকের আওয়াজ, কান্না, চিৎকার, হাহাকার, কত মানুষের আওয়াজ সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে কানে, চোখ ঝাপসা! এক দু’বার কেঁপে উঠে নিথর হয়ে গেল তার দেহটা। সামনেই তাদের বিয়ে। শুভশ্রী চেয়েছিলো পরের মাসে আদ্ভিকের জন্মদিনের দিন ম্যারেজ প্রপোজালও দেবে একটা। তবে তা আর হল না। যতক্ষণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তার শরীরে আর প্রাণ ছিলো না। চোখগুলো বিস্ফারিত।
হাসপাতালে যেতেই কিছুক্ষণ চেকআপের পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সে তো চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে, ফেলে গেলো তার অাদ্ভিককে। সে এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। একা একাই কথা বলে, মাঝে মাঝে শুভশ্রীর নাম ধরে চিৎকার, কখনো কাঁদে, কখনো হাসে। কখনো ‘না না এটা হতে পারে না, হতে পারে না…’ বলে চেঁচায়, হাত-পা ছোঁড়ে ছোট শিশুর মতো। ডাক্তার বলেছে সে ডিলিউশানাল, সিজফ্রেনিক। সে তার কল্পনার জগতে বাস করে। কিন্তু শুভশ্রী’কে তো এখনও স্পষ্ট দেখতে পায় সে, কথাও শুনতে পারে তার! কি করে মেনে নেবে শুভশ্রী আর নেই?

আরো পড়ুনঃ  ৫ টি সেরা ঈদের গল্প

চিকিৎসার অভাব রাখেনি অাদ্ভিকের বাবা মা। কনস্ট্যান্ট অ‍্যান্টি-ডিপ্রেশনের ওষুধ, কাউন্সিলিং কোনোকিছুতেই কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নেই তার। সে তার কল্পনার জগতে বাস করে তার শুভশ্রীর সাথে। আর মাঝে মাঝে জড়ানো গলায় হেসে হেসে একটা কবিতা বলে,

‘পাগলী, তোমার সঙ্গে জীবন কাটাবো
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঘর বাঁধবো
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাবো
পাগলী, তোমার সঙ্গে একগুচ্ছ। কদম হাতে নিয়ে ভিজবো তোমার একসঙ্গে রিকশা করে সারাদিন ঘুরবো। শুভশ্রী আই লাভ ইউ শুভশ্রী। এই বলে শুধু কাঁদে।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *