রক্ত গোলাপ কলমে আমজাদ হোসেন

রক্ত গোলাপ
আমজাদ হোসেন
(নওদা, মুর্শিদাবাদ, ভারত)

 

রিমি টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে ধীর পায়ে ফুট রাস্তা পেরিয়ে কাউন্টারে এসে দাড়াল। আজ সে একটু আগেই চলে এসেছে। অবশ্য বরাবরই সে আগেই আসে। কতবার বলেছে রঞ্জনকে, সে যেন একটু পাংচুয়াল হয় সময় সম্পর্কে। কিন্তু প্রতিবারই স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলেছে –

– ওটা আমাকে মানায় না রাই।

– আজ বেকার আছ মানায় না টা বেশ মানাচ্ছে। কিন্তু যখন কর্মক্ষেত্রে ঢুকবে তখন?

– না রাই আমার আর তা হবে না। তুমিই বরং …

– সে হচ্ছেনা। কাজ তোমাকেই করতে হবে। আমি ঘর সংসার সামলাব।

সংসারের কথা মনে হতেই মুখে একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠল রিমির। আজ শেষ বারের জন্য রঞ্জনের সাথে দেখা করতে এসেছে। দীর্ঘ আট বছরের রিলেশনে ইতি টানতে যাচ্ছে। আচ্ছা সত্তিই কি সে একাই ইতি টানছে, নাকি রঞ্জন এর জন্য দায়ী? প্রশ্নটা মনে আসতেই নিজের অজান্তেই মাথাটা দুলিয়ে নিল। যেন নিজেকেই দায়ী করছে সম্পর্ক ভাঙার জন্য।

– ম্যাডাম, কটা দেব? কাউন্টারের ভিতর থেকে ছেলেটি জিজ্ঞেস করতেই ভাবনা থেকে ফিরে আসে। বলে-

– দুটো দাও।

রিমির এই এক গুন। সে কয়েকদিন নিয়মত কাউকে যদি দেখে এবং সেই মানুষটি যদি মিশুকে হয় তাহলে খুব সহজেই তাকে তুমি করে বলতে পারে। এই যেমন ফুচকা ওয়ালা, টিকিট কাউন্টারের ছেলেটা, পার্কের রক্ষী, নৌকার বুড়ো মাঝি, টোটো চালক সকলকে। এমন মিশুকে মানুষটিকেও রঞ্জন ধরে রাখতে পারল না! রিমির আজ ঠিক দুঃখ না কষ্ট হচ্ছে সে নিজেই বুঝতে পারছেনা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অভ্যাস বশত ফোন করেছিল। ওপার থেকে নিরুত্তাপ রনঞ্জন উত্তরে বলেছিল-

– তুমি বেরও। আমি একটু পরেই আসছি।

বলেই রিমির কোনো কথার অপেক্ষা না করেই কলটা কেটে দিয়েছে। একমূহুর্তের জন্য স্তম্ভিতই হয়েছিল রিমি। আজকের দেখাটা যে তাদের জীবনের শেষ দেখা সে কথা দুজনেই জানে। এতকিছুর পরেও রঞ্জনের ভিতরে কোনো উত্তেজনা কেন নেই? তাহলে কি সেও চাইছে এই রিলেশন থেকে মুক্তি পেতে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে পার্কের নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়ে বসল সে। এই জায়গাটা তাদের খুব প্রিয়। যেদিন প্রথম তারা দেখা করতে এসেছিল সেদিন এখানেই বসেছিল। সেদিন থেকে আজ আট বছরের স্মৃতির সাক্ষী এই কংক্রিটের বেঞ্চি।

আরো পড়ুনঃ  একজন মায়ের গল্প

প্রথম দিনেই রঞ্জন খুব কাছে বসেছিল। প্রথমে একটু ভয় পেলেও সে বুঝতে পারে রঞ্জন এমন একটা মানুষ যাকে সত্তিই ভরসা করা যায়। সেদিন ও একবারের জন্যও হাতটাও ধরেনি। তবে অনেক ভালভাল কথা শুনিয়েছিল। রিমির সেদিন মনে হয়েছিল ওর জন্যই বুঝি রঞ্জন পৃথিবীতে এসেছে। এমন ভাল মানুষ আজও আছে ভাবতেই পারেনি।

এতদিনের দীর্ঘ পথ পার করে এসে তাদের সম্পর্ক কেমন যেন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। তাদের মাঝে যা হয় সবই কেমন পাংশুটে। কোথাও যেন আর কোনো স্বাদ নেই।ফেলে আসা দিনের হাজার একটা ভাবনা রিমির মনে এসে ভিড় করেছে।

হটাত মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠতেই পুরনো সেই বেঞ্চিতে বসে পড়ে। ব্যাগ থকে জলের বতল বের করে কয়েক ঢোক জল খেয়ে নেয়। ফোনটা হাতে নিয়ে একবার ইন্সটার ইন বক্স চেক করে। না আজও রঞ্জন তার ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়নি এখনও। অথচ একটা সময় ছিল রিপ্লাইয়ে এক মূহুর্ত দেরি হলে রঞ্জনই কতো কথা শুনিয়েছে তাকে। সেসব আজ কেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিলালিপি বলে মনে হয়। এতদিনের রঞ্জনটা কেমন করে এমন পালটে গেল!

রিমির কাছে সময় যেন আজ বড্ড বেশি স্লো হয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে যেন হাজার বছর অপেক্ষায় আছে। রঞ্জন আসবে বলেও আসেনি। তবুও অপেক্ষায় আছে সে। তার বিশ্বাস সে এখুনি চলে এসে পিছন থেকে তার চোখ চেপে ধরে নাকের কাছে ছোঁয়াবে তাজা রক্তগোলাপের সুবাস। এসব কি ভাবছে সে। নিজেই নিজের ভাবনাতে হেসে ওঠে। সে হাসি যে কি বেদনা বিধুর তা তার সামনে থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না।

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল রঞ্জনের নাম। রিমি এক মুহুর্তের জন্য আঁতকে ওঠে। তাহলে কি আজও সে আসবে না। এভাবেই কি তাদের সম্পর্কের ইতি টানতে হবে? ফোনটা ধরে রিমি। তার হাত কাঁপছে। কন্ঠস্বর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে-

আরো পড়ুনঃ  রং বদল

– হ্যাঁ রঞ্জন বলো। ওপার থেকে ভেসে এলো-

– আমার না এলেই কি নয়?

– তুমি সত্তিই কি আসতে চাও না?

– তা নয়, বন্ধুদের সাথে একটু…

– তুমি আসবে কি না বলো? কাঁদ কাঁদ গলায় কোনো মতে জানতে চায়।

– না।

– সত্তিই আসবে না? আর কথা বলতে পারছে না রিমি। তার গলা বন্ধ হয়ে আসছে। দুচোখ বেয়ে দুফোটা মুক্ত কপল বেয়ে নেমে আসছে বুকেরে খুব কাছে। রঞ্জন রিমির গলা বুঝতে পেরেছে কিনা জানি না। ওপার থেক শুধু ভেসে এল-

– না, কখনও না।

কথা গুলো রিমির কানে যেন বজ্রাঘাতের মতো শোনাল। হয়তো তার থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু। তার হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল মাঠিতে। তারপর গোটা পৃথিবীতে নেমে এল এক অসহ্য আঁধার। এই আঁধারের ভিতর দিয়েই চলতে হবে তাকে বাকি জীবন।

কতক্ষন সময় পার হয়েছে রিমির মনে নেই। হটাৎ ফোনের আওয়াজে তার খেয়াল হল ফোনটা বেঞ্চির নিচে পড়ে আছে। কোনো মতে সেখান থেকে ফোনটা তুলে দেখে একটা অপরিচিত নাম্বার। ধরতে যাবার আগেই কলটা কেটে গেল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একই নাম্বার থেকে তেরটা মিস্টড কল।

 

 

আরো পড়ুন এবং লেখুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য 

2 thoughts on “রক্ত গোলাপ কলমে আমজাদ হোসেন”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *