সুখের দিন কলমে মালুফা ইসলাম

সুখের দিন কলমে মালুফা ইসলাম

সুখের দিন
মালুফা ইসলাম

আমি মুন্নি, আব্বা আদর করে মিনু ডাকেন। আমার মা নেই, জন্মের সময় মারা গেছেন।

আমি দাদির কাছেই বড় হচ্ছিলাম। আমার মা এ বাড়ির ছোট বউ ছিলেন বলে দাদি কে মায়ের ঘরে দিয়ে চাচিরা আলাদা হয়ে গেছেন।

আমার যখন ২ বছর, আব্বা আরেকটি বিয়ে করলেন। নতুন “মা” সবার সামনে আমাকে ভালোই জানতেন, খাইয়ে দিতেন, গোসল করিয়ে দিতেন। তাই পুরো এলাকা হয়ে গেলো আমি নাকি আপন মা পেয়েছি।

কিন্তু নতুন মা যে সবার আড়ালে খাওয়াতে যেয়ে আমার গাল টিপে দিতেন, গোসল করাতে যেয়ে মারতেন। এগুলো কি আপন মায়েরাও করে??

জানি না, দেখিনি তো আপন মা কে!

দাদির কাছে শুনতাম, আমার মায়ের থেকে চাচিরা বিনামূল্যে সবজি নিতেন। তাই নাকি সবাই মাকে ভালো জানতো খুব।

কিন্তু চাচিরা তো আমাকে দেখতেই পারেন না। শুধু বলেন আমি নাকি নতুন মার জন্য সব কাজ ফেলে রাখি, গোসল টাও করতে জানি না!

তাই ভাবলাম আমিও মায়ের মত সবজি দিবো। চাচিরা আমাকে অনেক আদর করবে।

একদিন চাচিকে লুকিয়ে সবজি দিলাম। চাচি এসে নতুন মাকে বললেন, আমি নাকি লুকিয়ে সবজি বিক্রি করেছি তার কাছে!

এটা শুনে নতুন মা আমার মুখে গামছা ঢুকিয়ে দিয়ে অনেক মারলেন। বলে দিলেন, মারের কথা আব্বাকে বা দাদিকে বললে আমাকে মেরে ফেলবেন।

সেদিন ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি। দাদি আমার পক্ষ নিতেন বলে মা দাদিকে এক রুমে আটকে রাখলেন। বলেছেন কাজের সময় ছাড়া রুম থেকে বের হলে খাবার বন্ধ…

মারের ব্যথায় আমার ভীষণ জ্বর এলো। মা আমাকে আর দাদিকে ঘরে রেখে বাহির থেকে দরজা আটকে গল্প করতে গেলেন চাচিদের সাথে।

পাশের রুমে শুনলাম দাদির গোঙ্গানোর আওয়াজ আসছে, আমি জ্বরে চোখ বুজে ছিলাম, উঠে যেতে পারলাম না।

আরো পড়ুনঃ  ৬৯ টি গরম নিয়ে স্ট্যাটাস, ক্যাপশন ও কবিতা ২০২৪

সন্ধ্যায় মা এসে দাদিকে, আর আমাকে ডাকলেন হাঁস মুরগিকে খাবার দিতে। আমি উঠতে পারলাম না, মা এসে চুলের মুঠি ধরে দরজায় নিয়ে ফেললেন আমাকে!

দাদিকে বকতে বকতে রুমে যেয়ে দেখলেন দাদি আর নেই। মা চিৎকার করে পুরো বাড়িকে জানালো আমি দাদিকে ঘুমের মধ্যে গলা টিপে মেরে ফেলেছি।

বুঝলাম মার কথা কেউ বিশ্বাস করেননি। এটা তো বিশ্বাস যোগ্যও না বটে।

তবুও চাচিরা মার পক্ষ নিয়ে আমাকে বকতে লাগলেন।

খবর শুনে আব্বা বাড়ি এলেন। মা বললেন আমি দাদি কে মেরে ফেলেছি আব্বা তখন কিচ্ছু বলেননি। রাতে মা কাঁদতে কাঁদতে আমারও আব্বাকে বললেন আমি নাকি দাদিকে মেরে ফেলেছি। বাবা এবার মাকে জোরছে ঝারি মারলেন! মা চুপ হয়ে গেলেন….

তারপর থেকে আব্বা আমার খুব খেয়াল রাখেন। কিন্তু আব্বা যখন কাজে যান তখন?

তখন কি হয় সেটা যদি আব্বা কে কখনো বলতে পারতাম? তাহলে মনের ব্যথার সাথে শরীরের ব্যথাও ভুলে যেতাম!

এখন আমার বয়স তেরো….

আমার ২ জন সৎ বোন আছে।
ওরা স্কুলে পড়ে। আব্বা অবশ্য আমাকেও ভর্তি করতে চেয়েছিলেন, আমার ৬ বছর বয়সে।
মার জন্য পারেননি, মা বলেছিলেন ঘরের কাজ তিনি একা সামলাতে পারবেন না! আমাকে স্কুলে দিলে মা বাপের বাড়ি চলে যাবেন!

একদিন মা আমাকে বললেন, আমি যেন আলীদের ফ্যাক্টরিতে কাজে যোগ দেই, তাহলে তারা মাসে ২ হাজার টাকা করে দিবে।

মা বললেন আমিও যদি সংসারে টাকা দিলে, আব্বার কষ্ট একটু কমবে। তাই রাজি হয়ে গেলাম। তবে মার কড়া আদেশ, আব্বা যেন এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরেও না জানেন!

একদিন আমার ফ্যাক্টরির বান্ধবী রোজিনা বললো, তাদের স্কুলে নাকি শহর থেকে বড় আপুরা আসে, কুরআন-হাদিস এর কথা বলে, অনেক ভালো নাকি সেই আপুরা।

আমার খুব ইচ্ছে হলো, একদিন আগেভাগে কাজ শেষ করে রোজিনার সাথে আমিও গেলাম।

আরো পড়ুনঃ  অনন্ত অসুখ কলমে ফকির শাহিন শাহ্

সত্যিই.. এত আদর করে জীবনেও কেউ আমার সাথে কথা বলনি। এত সুন্দর তাদের ব্যবহার!

এভাবে মাঝেমধ্যেই যেতে লাগলাম, সেখানে এক সানজিদা আপু ছিলেন। আপু আমার সব কথা শুনতেন একা ডেকে নিয়ে।

একদিন কাজ শেষে বাড়িতে এসে শুনি, মিলে কাটা পড়ে আব্বা মারা গেছেন….

সেদিন………….

সেদিন আমি এই বিশাল পৃথিবীতে পুরো একা হয়ে গেলাম। আর কেউ রইলো না আমার!!

কিছুদিন পর আপুরা আমাকে দেখতে আসলেন, কিভাবে যেন তারাও জেনে গেছেন আব্বার কথা।

সানজিদা আপু একা ডেকে নিয়ে বললেন, আমি চাইনা তুমি আর এ বাড়িতে থাকো। আমরা যদি তোমাকে নিতে আসি যাবা?

আমি বললাম মা যেতে দিবেন না। আপু বললেন আমাকে তার ভাইয়ের বউ করে নিবেন। আমি কিছু বললাম না…

আপু বুঝলেন আমিও এ বাড়ি থেকে বের হতে চাচ্ছি যে করেই হোক!

তারও কিছুদিন পর আপু আসলেন, তাদের ফুল ফ্যামিলিসহ। মা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। আমি এখন দুই টাইমে কাজ করি, ৪ হাজার টাকা পাই, এখন আমি গেলে সংসার চলবে না। মা তাদেরকে সাফ সাফ মানা করে দিলেন।

যখন শুনলেন তারা আমাকে কোনো খরচ ছাড়া আজকেই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবেন, আর আমার হবু জামাই বললেন মাসে ৫ হাজার করে দিবেন আমার ছোটবোনদের জন্য।

তখন মা রাজি হয়ে গেলেন। আমারও বিয়ে হয়ে গেলো। তারা শহরে নিয়ে আসলো আমায়।

এখন ২০২৪ সাল….
বলে রাখি, আমার বয়স এখন ১৮।

কাল আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
যেদিন থেকে হজ্জ্ব সম্পর্কে জানলাম, সেদিন থেকে আমার খুব ইচ্ছে ওমরাহ্‌ করতে যাবো।

আমার উনি সেটা জানতে পেরে ৪ বছর ধরে টাকা জমিয়েছেন। কাল আমাদের ফ্লাইট….

আলহামদুলিল্লাহ!!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *