লালভাত
কলমে: নিলুফার জাহান রুবাইয়া
❝আম্মা,আমার খুব গোশত দিয়ে ভাত খাইতে মন চাইতাছে। আইজকা তো আমার জন্মদিন আব্বারে এই টাকাগুলা দিও কইও গোশত নিয়ে আসতে। সবাই একলগে খামু।❞
❝ তুই এই টাকা কই পাইলি বা’জনা?
ক্যান ভুইলা গেলা!❞ ❝ বেলুন বেইচা নিয়ে আইছি।❞ ❝ তোরে না কতদিন কইছি ইস্কুলে যাইতে। কাম করার জন্য তো তোর বাপ আর আমি আছিই।❞ ❝ইস্কুলে গেলে কি পেট ভরবো মা কও! হের থাইকা তোমাগো লগে কাম করি তোমার আর আব্বার খাটনি কমবো।❞
এতক্ষণ কথা হচ্ছিলো পথশিশু লিমন ও তার মায়ের। লিমনের মা যখন সন্তানহারা জননী সন্তানের শোকে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠিক তখনই লিমনকে কুড়িয়ে পায় ডাস্টমিনের কাছে। সেই থেকে লিমনকে মাতৃস্নেহে বড় করে তোলা। তাদের দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের যে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। কথাতেই তো আছে, ❝জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না।❞ লিমনের বাবা একজন ছদ্মবেশী দিনমজুর। অর্থাৎ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ পায় কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বসে থাকতে হয়। লিমনের বাবা দুপুরে বাড়িতে আসে….
❝পোলাটার তো আইজকা জন্মদিন। পোলা একটু গোশত দিয়া ভাত খাইতে চাইছে।❞ ❝হাতে তো টেকাও নাই এখন। যেমনে হোক কালকে নিয়ে আমুনে৷❞ ❝পোলাটা কিছু টেকা দিছে কইছে এটা দিয়া নিয়ে আইতে।❞ ❝বাজারে জিনিসের যে দাম জানোই তো। এই টেকা দিয়ে তো কিছুই হইবো না। তুমি বরং টেকাটা রাইখা দাও পোলাটারে ভালো একখান স্কুলে ভর্তি করাইতে হইবো তো। আমার পোলা একদিন অফিসার হইবো হেও কি আমার মতো কামলা হইবো নাকি।❞ ❝তাহলে আইজকা পোলাটারে কি কমু? ❞ ❝আইজকের দিনটা এই লালশাকটা চালাও।আমি কালকের মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা করতেছি।❞
খাবার খেতে বসে….
❝আম্মা, আব্বায় গোশত আনে নাই। কই গোশত রাঁধো নাই যে?❞ ❝তোরে কালকে গোশত খিলামু বা’জান আইজ তোরে আমি নিজের হাতে লালভাত তুলে খিলামু।❞ ❝কি কও মা! ভাত তো সাদা হয়। তুমি লালভাত পাইবা কনে?❞ ❝মায়েরা সব পারে রে বা’জন।❞
লিমনের মা লালশাক দিয়ে ভাত মেখে ভাত লাল করে তুলে খাওয়ায়৷ আর ভাবতে থাকে আজকে যদি সে তার আসল বাবা মায়ের কাছে থাকতো তাহলে হয়তো গোশত দিয়েই ভাত খাওয়াতো। তার এমনই কপাল ছেলেটার জন্মদিনেও একটা ভালো খাবার মুখে তুলে দিতে পাচ্ছে না। ঠিক তখন……
আরো পড়ুনঃ নিলুফার জাহান রুবাইয়া’র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও জীবনী
❝আম্মা, আব্বারে বইলো গোশত না আনতে। আমি আর গোশত দিয়ে ভাত খামু না। ❞ ❝ক্যান রে বা’জান? রাগ করেছিস! তোর আব্বায় কালকেই গোশত নিয়ে আসবেনি।❞
❝না, না মা। কি কও! রাগ করতে যাবো ক্যান? তোমার হাতের লাল ভাতের স্বাদ ওই গোশতের স্বাদের থেকে ম্যালা ভালো।আমার তো পেট, মন দুটোই ভরে গেছে। এখন তুমি আমারে ঘুম পারায় দাও দেখিনি।❞
আসলে লিমনেরও গোশত খেতে ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু ছোট পথশিশু লিমনও জানে মায়ের চোখে পানি কেন? সেও পথে ঘুরতে ঘুরতে জেনে গেছে বাজারে পরিস্থিতি। তাই তো সে ছোট বয়সে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে পরিবারের দায়িত্ব। আয়ত্ত করে নিয়েছিলো পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে নিজের ইচ্ছা দমিয়ে রাখার ক্ষমতা। এই লিমন তবুও তো পেয়েছে আশ্রয়, খাদ্য। বিশ্বব্যাপী ০২অক্টোবর বিশ্ব পথশিশু দিবস পালন করা হলেও আজও বিশ্বব্যাপি পথশিশুদের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি। তাই তো আজও অনেক লিমন ক্ষুধায় নিঘুর্ম রাত পার করছে।
অসাধারণ একটি গল্প পড়লাম।