চল্লিশ বছর
নারগিস খাতুন
দিদি তুমি এই ঘরে আমি জানতাম তুমি আজ এই ঘরেরই থাকবে। কাল ঈদ আর আজ তুমি ঘর থেকে বাইরে যাবে না সারারাত এই ঘরে বসে কান্না করবে জানি আমি। কিন্তু কত বছর হয়ে গেল আমার জ্ঞেন হওয়া থেকেই দেখি ঈদের আগের দিনেই তুমি নিজেকে এই ঘরে বন্দি করে নাও। এত বিলাসিতা তবুও তুমি ভেতর ভেতর একা আর এই একটি ঘরে বসে কান্না করো কয়েকটা মানুষের ছবি সামনে দাঁড়িয়ে। দিদি তোমার এখন ষাট বছর বয়স আমার 38 বছর তবুও তোমার এই কান্নার রহস্য কোনো দিন আমাকে বলনি। আজ তোমাকে বলতেই হবে দিদি কেনো তুমি ঈদ আসলে আনন্দ করা বাদে কান্না করো। তোমার তো অভাব বলতে কিছুই নেই। তুমি নিজেই বিয়ে করোনি অথচ আমার বিয়ে দিয়েছো আমি দূরে চলে যাব বলে আমার স্বামী কেই তুমি এই কোম্পানি ম্যানেজার বানিয়ে দিয়েছো, তোমার এই পাঁচ তলা বাড়ি, এত সম্পত্তি বাড়ি গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব নেই তোমার। আমরা সবাই থাকি এই বাড়িতে, আমিও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না তোমাকে একা করে তাই থাকি।
ঠিক আছে বোন আজ তোমাকে আমি সব বলবো। এই আমার হাতে যে পেপারটা কাগজ টা দেখছ এটা আমার সমস্ত সম্পত্তি কাগজ এই সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমার নামে লিখে দিয়েছি। আমি কয়দিন বা বাঁচবো। আমার হাতে যে ছবিটা আছে এই ছবির মানুষ গুলো আমাদের পরিবার ছিল। আমাদের পরিবারের মধ্যে তুমি ছিলে সব থেকে ছোটো রাজকন্যা আমি ছিলাম বাড়ির বড়ো রাজকন্যা। তুমি হলে আমার ছোট কাকার মেয়ে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগের ঘটনা তখন তোমার জন্ম হয়নি। ছোটো কাকিমা নয় মাসের গর্ভবতী। তখন আমি কলেজে ফাইনাল ইয়ার শেষ হয়েছে। বাড়িতে সবাই আমার বিয়ের কথা বার্তা বলছে। আমার বাবা ছিল গ্রামের মোড়ল। মেজো কাকা মাস্টারের চাকরি করত। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। ছোটো কাকা মানে তোমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিল। আমাদের সুখী পরিবার ছিল। আমি একটা চাকরি পেয়ে বিয়ে করব বাড়িতে বলি। পরিবারের সবাই মিলে আমার বিয়ে ঠিক করে একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে তার নাম নিলয়। বাড়ির সবাই বলছে বিয়ের পর ছেলেটা তোমাকে পড়াবে, চাকরি করাবে।
নিলয় কে দেখে আমারও খুব পছন্দ হয়েছিল নিলয়ের পরিবারেরও আমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আর নিলয়ের। ঈদের পরে বিয়ে হবে ঠিক করলো দুই পরিবার। নিলয় কাজ ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে ততদিন ছোটো কাকিমার বাচ্চা হয়ে যাবে সেই দিক ভেবেই। ঈদের দুইদিন আগে নিলয় বাড়ি আসে পরের দিন বিয়ের কথা বার্তা বলার জন্য আমাদের বাড়ি আসে নিলয় ও তার পরিবারের সবাই। আমি ঘরে বসেছিলাম বাইরে সবাই কথা বার্তা বলছে। ছোটো কাকিমা আমার হাতে তোমাকে দিয়ে বলল ‘খেয়ার রেখো’, আমি ওই দিকটা দেখি। তারপর হঠাৎ বাইরে থেকে খুব আওয়াজ ও পুরা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে দেখি পুরো বাড়িতে আগুন জ্বলছে। দরজার বাইরে দাউ দাউ করে আগুন আমি জানালা ভেঙে তোমাকে কোলে নিয়ে কোনো রকম বাইরে চলে আসি। পরে সবাই মিলে আগুল নেভানোর পর দেখাযায় দুই পরিবারের সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে আমার বাবা গ্রামের একটি লোক কে দোষী পেয়ে সাজা শুনিয়েছিল আর ছোটো কাকা তাকে জেলে দিয়েছিল, সেই আসামি জেলে যাওয়ার পর, দরিদ্র তার পরিবারের সবাই মারা যায় । সেই পরিশোধ নেওয়ার জন্য সে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার পুরো পরিবার কে এক সাথে অগুল লাগিয়ে দিয়েছিল আর বাইরে থেকে সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে বাড়ির কেও পালাতে পারেনি সবাই মারা গিয়েছে। পুলিশ আমাকে জানায় আমি যেনো দূরে কোথাও চলে যায় না হলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। তখন আমার চোখে পড়ে সেই বাড়িতে পুরা জিনিসের মধ্যে এই ছবিটা দেখতে পায়। এই ছবিটা আর তোমাকে নিয়ে আমি সেই রাতেই ট্রেনে ওঠে শহরে চলে আসি। তুমি এক মাসের মেয়ে। আমি কি খোয়াব কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। শহরে চায়ের দোকানে কাজ করতে লাগলাম যে কটা টাকা পেতাম তা থেকে তোমার দুধ ও আমার খাবার কিনে খেতাম। আস্তে আস্তে শহরের বাচ্চা দের টিউশন পড়তে শুরু করি। আর বিগত চল্লিশ বছরের একটু একটু করে গড়ে তোলা আমার এই প্রসাদ। আজ তোমাকে দিলাম তুমি এই দায়িত্ব নাও। আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। এবার আমার একটা নিশ্চিন্তে ঘুম দরকার।
সমাপ্ত
মুর্শিদাবাদ ভারতবর্ষ