
অপেক্ষা
উম্মি হুরায়েরা বিলু
কোনো এক অগোছালো বিকেলের মতো ছিল তাদের বন্ধুত্ব।
কখনো বৃষ্টির মতো হঠাৎ ঝরে পড়তো আনন্দ, কখনো সূর্যের মতো স্থির আলোয় জ্বলে থাকতো একে অপরের চোখে।
যেখানে রুহি আর শিফা ছিলো যেন এক আত্মা, দুই দেহ।
স্কুলের করিডোরে হাত ধরে হাঁটা, ক্লাসে এক বেঞ্চে বসে খিলখিলিয়ে হাসা,
বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ভেজা মন নিয়ে গল্প করা—
সবটাই যেন ছিলো তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
শিফা ছিল রুহির কাছে শুধু বন্ধু নয়—
একটি আশ্রয়, একটি ঘর, একটি নিঃশ্বাস।
তারা ছিল একে অপরের ছায়া। দু’জনেই জানতো—জগৎ ভেঙে পড়লেও তাদের বন্ধুত্ব ভেঙে পড়বে না।
একটি বাঁধনের মধ্যে আটকে ছিল তাদের প্রতিটি সকাল, প্রতিটি সন্ধ্যা।
স্কুলের করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে তারা স্বপ্ন দেখতো একসাথে বুড়ো হওয়ার,
সাদা চুলের ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতির গল্প গেঁথে রাখার।
তারা ছিলো দু’টি হৃদয়ের গল্প—
একসাথে কাঁদা, একসাথে হাসা, একসাথে বেড়ে ওঠা।
স্কুলের শেষ বেঞ্চে বসে ভাগ করে খাওয়া চিপস,
পেন শেয়ার করে লিখে ফেলা কবিতা,
আর একে অন্যের চুলে বেঁধে দেওয়া গোলাপি রাবার—
সবই ছিল এক রূপকথার মতো।
কিন্তু রূপকথারও তো একদিন পরিসমাপ্তি আসে।
হঠাৎ করেই শিফার আচরণে নেমে এল এক অচেনা শীতলতা।
সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে।
আকাশ রঙ বদলায়, বাতাসে ঘুরে বেড়ায় ফেলে আসা দিনের দীর্ঘশ্বাস।
তেমন এক বিকেল ছিল, যখন রুহির জীবনে প্রথম নেমেছিল অচেনা নিঃশব্দতা।
আর সেই নিঃশব্দতার নাম ছিল—শিফা।
হঠাৎ একদিন, ঠিক এমন একদিনেই—
যেদিন আকাশ ছিল ধূসর মেঘে আচ্ছাদিত, সেদিন থেকেই যেন শিফা কেমন বদলাতে শুরু করলো।
আগের মতো আর ফোন আসত না।
মেসেজে হো হো করে হাসত না শিফা।
চোখে চোখ রাখলেও যেন কুয়াশা পড়ে থাকত মাঝখানে।
রুহি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি।
হৃদয় যে বড় বিশ্বাসী, বড় অবুঝ।
সে ভেবেছিল—
“সময় হয়তো ব্যস্ত করে তুলেছে তাকে। আমি অপেক্ষা করি…”
অপেক্ষা তো নদীর মতো—
সে শুধু গড়িয়ে যায়, ফিরে আসে না।
অপেক্ষা যত বাড়তে লাগল,
ততই দূরত্ব গভীর হতে থাকল।
এক সময় কথা বলাও কমে গেল,
দেখা হওয়া যেন ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়াল।
রুহি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগল প্রতিদিন—
“আমি কী এমন করলাম, যে তুই এভাবে সরে গেলি?”
কোনো উত্তর আসেনি।
শুধু একটা নীরবতা এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো উত্তরের বদলে।
একদিন রুহি শেষবার সাহস করে বলল—
— “তুই আগের মতো নেই, শিফা। তুই আর আমার শিফা নেই…”
শিফা একটু হেসে বলল—
— “সব সময় তো একরকম থাকে না রুহি। মানুষ বদলায়, জীবন বদলায়।”
তারপর রুহি আর কিছু বলেনি।
কেউ যখন দূরে চলে যেতে চায়,
তাকে টেনে রাখা মানে সম্পর্কের শ্বাসরোধ করা।
তবুও, রাতে জানালার পাশে বসে রুহি ভাবতে থাকে—
> “বন্ধুত্ব কি সময়ের কাছে হার মেনে যায়?
নাকি কোনো এক ব্যাখ্যাতীত ক্লান্তি এসে হৃদয়ের গায়ে ধুলোর পরত বসায়?”
রুহির ইচ্ছে হয় শিফার কাছে প্রশ্ন করতে—
“তুই তো বলেছিলি, আমরা চিরদিন একসাথে থাকব।
তবে কেন এই ‘চিরদিন’টা এতো ছোট হয়ে গেল, শিফা?”
রুহি এখন আর অভিযোগ করে না।
সে জানে—সব সম্পর্কের কোনো না কোনো এক অপ্রকাশিত প্রস্থান থাকে।
তবুও কিছু ক্ষত থাকে,
যা জোড়া লাগে না কখনো।
তবুও কিছু প্রশ্ন থাকে,
যার উত্তর মেলে না কোনোদিন।
কথায় আছে—
ভালোবাসা ভাঙলে মানুষ কাঁদে,
কিন্তু বন্ধুত্ব ভাঙলে মানুষ ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যায়।
একদিন পুরনো সেই ছবির অ্যালবাম খুলে রুহি দেখতে পায়—
দুজন মিলে হাসছে, এক দোলনায় বসে।
ছবির পেছনে লেখা—
“তুই আর আমি, যতদিন আকাশ থাকবে।”
রুহির ঠোঁটে হাসি আসে না,
চোখের কোণটা শুধু একটু ভিজে ওঠে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের অশ্রুটুকু মুছে ফেলে রুহি বলে ওঠে—
“একটা সময় ছিল, যখন তুই ছিলি আমার সব।
আজ তুই নেই, তবু প্রতিটা মুহূর্তে তোরই অভাব।”
“একটা মানুষ বদলে গেলে
শুধু সে বদলায় না—
তার সাথে বদলে যায় কারো ভেতরের পৃথিবীও।
আর আমি?
আমি আজও আগের মতোই আছি—
ঠিক তোর অপেক্ষায়!”