হাসু বু
বখতিয়ার উদ্দিন
হাসু বু পাড়ার সাধারণ একটি মেয়ে। ছোট শিশুদের নিকট অনেক প্রিয় মানুষ ।হাসু বু নিজের সরল মনে বাচ্চাদের সাথে মিশে গিয়ে মন খোলে খেলা করে তাই ছোট শিশুরা তাকে অনেক ভালোবাসে।
হাসু বু মাঝে মধ্যে ছোট ছেলে – মেয়েদের নিয়ে কানামাছি, দাঁড়িয়ে বান্দা, নানান খেলা করে আবার মাঝে মধ্যে রাজা রাণীর গল্প বলে।হাসু বু যখন গল্প বলে তখন বাচ্চারা চারদিক দিয়ে তাকে ঘিরে ধরে চুপ করে শান্ত মনে মনোযোগ সহকারে গল্প শুনে।এতে পিতামাতারা একটু শান্তি পায় তার নিকট বাচ্চাদের রেখে গেলে।প্রতিদিন বাচ্চারা হাসু বুর নিকট আসার জন্য কান্না করে।তাই হাসু বুর ধ্যান জ্ঞান হলো বাচ্চাদের সাথে মিশে থাকা।তাদের মাঝে খেলা – ধূলা আর গল্প গুজব করে সময় কাটানো।তার মন খানি নদীর গতির মতো শুধু বাচ্চাদের সাথে ছিল। নদী যেমন সাগরে গিয়ে সুখ পেত তেমনি হাসু বু পাড়ার শিশুদের মাঝে সুখ খোঁজে পেত।
এক মুখি জীবনের ভিতর ঠিকই মনে হালকা মেঘের ভেলার মতো একটা স্বপ্ন আর প্রত্যাশা ছিল। জীবনে ষোলটি বছর পার করে দিয়েছে। এই বৃহৎ জীবনের শুরুতে প্রত্যাশাটা প্রবল ছিলনা।শুষ্ক তুলির আঁচড়ের মতো একটুখানি মনের কোণায় রং লাগার মতো প্রত্যাশা ছিল। কখন যে অজানা মানুষটি এসে চির চেনা মানুষের মতো জীবনের আনন্দ, সুখ – দুঃখ, হাসি – কান্নার ভাগ নিবে।
সময়ের কল্পনায় একদিন কাল বৈশাখীর ঝড়ের মতো ঠিকই হাসু বুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।মনের মাঝে স্থান করে নিল স্বপ্নের প্রত্যাশার এক অপরিচিত মানুষ। হাসু বুর সমস্ত ধ্যান – জ্ঞান মানুষটির জন্য ঠিকই গড়িয়ে যেতে শুরু করল। আকাশ কেঁদে যে জল নদীতে গড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে সরল প্রবাহে সাগরে যেতে শুরু করল। এই গতি বর্ষা কালে প্রবল হতে পারে আবার ধীরেও হতে পারে।তবে গতিখানি হয়তো আর কোন দিন স্থীর হবে না।
হাসু বু এই প্রবাহের ঝড়ে প্রায় বাচ্চাদের কথা ভুলে গেল।প্রতিদিনের মতো বাচ্চারা হাসু বুর জন্য বাগানে অপেক্ষা করে বসে আছে। কিন্তু হাসু বু আগের মতো বাগানে আর আসে না।আগের মতো তাদের সাথে আর খেলায় মেতে উঠে না।রাজপুত্র আর রাজ কন্যার গল্প বলে না।হাসু বু একটুর জন্য বাচ্চাদের মাঝে দেখা দিলেও আগের মতো আর ভালো লাগে না।হাসু বু ছাড়া বাচ্চাদেরও খেলাধূলা আর জমে উঠে না।হাসু বু ধীরে ধীরে তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে তা বাচ্চারা বুঝতে পারে।বাচ্চাদের মাঝ থেকে একজন বলে, হাসু বু তোমার কি হয়েছে?তুমি আগের মতো আর খেলাধূলা করো না কেন?আমাদেরকে আর গল্প বলো না কেন?
বাচ্চাটির কথায় হাসু বুর মনে এক অজানা স্বপ্ন ও অনাগত ভবিষ্যৎ শিহরণ দিয়ে ছল ছল চোখে কত কিছু ভাসতে থাকে ।মনের মাঝে এক বিশাল জীবনে সন্তান আর তারও পরে নাতী – নাতনীর মুখ প্রত্যাশার নদীর বুকে ভেসে ভেসে চলেছে। নারীর মনের ধর্মে প্রত্যাশা কি নিজেও জানে না, জীবনে কি চাই তাও বুঝে না।শুধু অজানা শিহরণে ক্ষুদ্র জগৎ থেকে বৃহৎ জগতে ডুবে থাকে।বাচ্চাদের চিৎকারে হঠাৎ হাসু বুর ধ্যান ফিরে পেলে তাদের প্রতি উত্তরে বলে, না বাপধন, আমার তো কিছু হয়নি।
হাসু বুর কথায় বাচ্চারা উচ্চ স্বরে হেসে উঠে আর বলে, নিশ্চয়ই তোমার কিছু হয়েছে, তা না হলে আমাদের বাপ বলতেছ কেন?আমরা তো তোমার ভাই হয়।
বাচ্চাদের কথায় হাসু বু লজ্জায় চমকে উঠে আর একটু মৃদ হাসি দিয়ে শৈশবের মত তাদের সাথে খেলা ধূলায় মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু এই খেলাধূলায় আর মন বসে না। মন বড়ই উদাস উদাস।এই মন নীড় ছেড়ে পাখির মতো ডানা মেলে দূর দেশের নীড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
বাচ্চারা আপন মনে খেলে যাচ্ছে। হাসু বু আবার কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়। হাসু বুর দিকে আর কারো কোন খিয়াল নেই। এখন মাঝে মধ্যে অকারণে হাসে আবার কারো কথায় উদাস চেহারায় নীরব থাকে।নীরবতার জীবনে একটি রাজ্যের কথা কল্পনা করে।যে রাজ্যে স্বপ্নের মানুষটি রাজা আর হাসু বু নিজেই রাণী। হাসু বুর মনের রাজ্যের সীমানা অসীম। হয়তো কোন দিন এই রাজ্যের সীমানা শেষ হবে না।