বৃষ্টিস্নাত সুন্দর দিনের দিনলিপি

বৃষ্টিস্নাত সুন্দর দিনের দিনলিপি
নাজমুল আলম মাহদী
ঠিকানাঃ জানীগাঁও, সদর সুনামগঞ্জ

এক.
রৌদ্রময় আকাশ। তেজহীন রোদ। মৃদু বাতাস।
পরক্ষণেই মেঘলা আকাশ। ঝিরি ঝিরি বাতাস। রোদ নেই। সূর্য লুকিয়েছে মেঘেদের ভিড়ে।

আব্বুর রিপোর্ট দেখাতে সিলেটের দিকে রওয়ানা দিব এখন। প্রেস্ক্রিপসন এবং অন্যান্য কাগজ-পত্র গোছিয়ে ‘বিসমিল্লাহি তাওক্কালতু ‘আলাল্লাহ’ বলে বাহির হলাম ঘর থেকে।

নতুন বাস স্টেশনে গিয়ে নিলাদ্রীর টিকেট কাটলাম। বাস ছাড়বে এক ঘন্টা পর; তাই কাউন্টারে বসে থাকলাম।বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। রিম ঝিম বৃষ্টি। তবে অপেক্ষায় থাকায় ভাল্লাগছিলো না; তাই বৃষ্টিতেও কোন ভালো লাগা খুঁজে পেলাম না। চুপ-চাপ বসে রইলাম।

দুই.
বৃষ্টিরা আপাতত ইতি টেনেছে। মেঘের কোলে হেসেছে রোদ। ইতিমধ্যে বাসও এসে গেছে। যাত্রীরা যার যার আসন গ্রহণ করছে। আমিও আমার সিট খুঁজে বসে পড়লাম।

ড্রাইভার সাহেব বাস স্টার্ট করলেন। গাড়ী ছুটলো গন্তব্য পানে। নিরিবিলি। যেনো গাড়ীতে চড়িনি; নির্জনে কোথাও বসে আছি। এই কারণটার জন্যই এক ঘন্টা অপেক্ষা করেও ‘নিলাদ্রী’ দিয়ে যাচ্ছি।

পাশে বসেছেন ঘুমকাতুরে এক ভাই। লম্বা-চওড়া সুন্দর মানুষ। উনার সাথে উনার কয়েক স্বজনও গাড়ীতে আছেন। তারাও লম্বা। গাড়ীতে সবচে’ লম্বা সম্ভবত তারাই।
লম্বা ঘুমকাতুরে ভাইটি বাস স্টার্টের কিছুক্ষণ পরই কানে হেড ফোন ঢুকিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারালেন। খুব সম্ভব গানই শুনছেন। জানিনা কেমন টাইপের গান। যাই হোক,উনি গান শুনছেন কানে হেড ফোন ঢুকিয়ে স্মার্ট ফোন দিয়ে। আমি ভাবলাম, আমিও তো নাশীদ প্রেমী। আমিও না হয় নাশীদ শুনি হেড ফোন ছাড়াই, এক হাজার টাকা দামের নরমাল মুঠোফোন দিয়ে।

আব্দুল্লাহ হাফিযাহুল্লাহ’র ‘মাওলা’ নাশীদটি প্লে করলাম।ভালো লাগা নিয়ে শুনতে লাগলাম। জানালার পাশের সিটে বসতে পারায়, জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। গাড়ী উঁচু টাইপের হওয়ায় গ্রামীণ গাছগাছালির সবুজ-সজীব দৃশ্যগুলো দেখতে পারাও সহজই ছিলো।তাই সফরের সমাপ্তি পর্যন্ত ভালো লাগাময় দৃশ্য আর প্রিয় মুগান্নীদের সুরের গাঙ্গেই হারালাম। ‘মাওলা’ নাশীদটির পর শুনলাম ‘ইয়া মুজিরু’। অতঃপর ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’।তারপর তাঞ্জির্ভাই’র ‘উক্বাবী শান’। অতঃপর খানিকটা পথ শুধুই প্রকৃতির রূপ দেখে। একবার কী ভেবে যেনো পেছন দিকে তাকিয়েছিলাম; তখন সোনালী আলো ছড়ানো সূর্যটা চোখে আটকেছিলো । একদম চমৎকার থেকেও বেশি কিছু লাগছিলো সূর্য মামার রূপ। এ-ভাবেই পৌঁছলাম গন্তব্যে।

আরো পড়ুনঃ  এক বিকেলের এলোমেলো গল্প

তিন.
শুভ্র-সফেদ আকাশ। একটু আগেও বৃষ্টি হয়েছে।প্রশান্তিদায়ক বৃষ্টির পানিতে ভেজা পুণ্যভূমির মাটি।সাঁ-সাঁ করে বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে গায়ের পাঞ্জাবী দোল খাচ্ছে। সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন।

কুমারগাঁও বাস স্টেশন থেকে ‘সি এন জি’ তে করে ‘মাউন্ট এডোরা মেডিকেল’ গেলাম। তৃতীয় তলা থেকে রিপোর্ট সংগ্রহ করে জানতে পারলাম— ডাক্তার সাহেব এক ঘন্টা পর রিপোর্ট দেখবেন। চলে গেলাম মেডিকেলের সপ্তম তলায় অবস্থিত প্রশান্তিভরা ছোট্র মাসজিদটিতে।

ওজু করে মাসজিদে প্রবেশ করি। এখন সন্ধ্যা। তবে সন্ধ্যাকাশে যে হলদে আভা থাকে সে আভা আজ নেই।তবুও আকাশ দেখে ভাল্লাগছে। শুভ্রতা মোড়ানো।কোথাও কালো মেঘ। বাতাস বইছে এখনো। মাসজিদের চতুষ্পার্শে কাঁচের দেয়াল। দেয়ালের পাশেই নানান প্রজাতির ছোট-ছোট ফুল গাছ। বাতাস তাদের গায়ে লাগায় এমন ভাবে নড়ছে, যেনো খুশিতে তারা চরকির মতো নাচছে। এই দৃশ্যটা সবচে’ ভালো লাগার ছিলো।কাঁচের দেয়াল দিয়ে প্রাণের শহরের আংশিক রূপ তখন একদম দিল ছুঁয়েছিলো।

চার.
হুমাইদীর ফোন বাড়ী থেকে। সে বলছে—‘ভাই তুমি কোথায় আছো?’ আমি জায়গার নাম বললাম। ফোনে বৃষ্টি সহ বাতাসের আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। সে আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলো—‘তুমি যেখানে আছো সেখানে কি বৃষ্টি হচ্ছে না?’ আমি বললাম—‘না তো’। সে বলছে—আমাদের এ-দিকে তো একদম উড়িয়ে দিচ্ছে। এতোটুকু বলে সে ফোন কেটে দিলো। মূলত তার ফোন করার উদ্দেশ্য আমাকে সতর্ক করাই ছিলো; কিন্তু আমি কী ভেবে যেনো তা একটুও মাথায় নিলাম না। গাড়ী থেকে নামার পর যদি ঝু্ম বৃষ্টি পেয়ে বসে, তখন বাড়িতে কিভাবে পৌঁছবো তা একটুও ভাবলামনা। অথচ রাত মোটামুটি অনেক হয়ে গেছে। গাড়ীতে আমার পাশের সিটে সেচনীর এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। উনার সাথে ভালো-মন্দ কথা বলতে বলতেই উনার গ্রাম পর্যন্ত আসা হয়েছে। উনি কথা বলতে পারেন বেশ ভাব-ভঙ্গি নিয়ে।কথায় যথেষ্ট মাধুর্যতাও আছে। আচরণও সুন্দর। সম্ভবত উনার সাথে যথেষ্ট আগ্রহ নিয়ে কথা বলার কারণেই, বাড়িতে যে খুব বৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে ভাবছিলাম না।

আরো পড়ুনঃ  পূর্নতা কলমে কানিজ ফাতেমা রুকু

উনার প্রথম প্রশ্ন ছিলো— ‘হুজুর পড়াশুনায় আছেন, না-কি পড়েন না?’ আমি উত্তর দিলাম। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন— ‘কোথায় পড়েন, কোন জামাতে পড়েন, বাড়ি কই?’ তাও বললাম।

উনি মুতাঃ দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কওমীতে পড়েছেন।অতঃপর আলিয়া মাদ্রাসায়া। সেই সুবাদে ‘সরফী’ (আরবী ব্যাকরণ সম্পর্কিত) কিছু নিয়ম-নীতি নিয়ে উনার সাথে আলোচনা বেশ জমে উঠেছিলো। ‘সরফী’ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা উনিই প্রথমে তুলেছিলেন। তাই সরফ সংক্রান্ত কিছু কথা বলা।নতুবা হয়তো বলার সু্যোগ হতো না। উনি সরফে ভালো ছিলেন। তাই একটার পর একটা বিষয় আলোচনায় এনেছিলেন। আমিও যতোটুকু জানি ততোটুক বলছিলাম।

কয়েক মূহুর্ত যাপন হতেই উনার সাথে যেনো খুব ভালো একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গেলো। উনার গ্রামে বাস আসার পর উনি মুসাফাহা করে নেমে গেলেন। আমি দো‘আ নিলাম। জানিনা, উনার স্মৃতিতে কতোদিন থাকবো আমি। তবে আমার বিশ্বাস, আমার স্মৃতিতে উনি আজন্মকালই থাকবেন। এমন অনেকের সাথেই চলার পথে মুলাকাত হয়। যারা সুন্দর আচরণ দিয়ে মুগ্ধ করেন।ভালোবাসা দিয়ে কাছে টানেন। আর বিনিময়ে থেকে যান স্মৃতিতে আ-জীবন। ভালো মানুষ হিসেবে।

পাঁচ.
নিঝুম রাত। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তারাদের ছিটেফোঁটাও নেই। তবুও যেনো একটি দিল কাড়া রঙ মেখেছে রাতের আকাশ। রাস্তা-ঘাট বৃষ্টির পানিতে ভেজা।কাঁচা রাস্তাগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে।

বাস গ্রামে এসে গেছে। গাড়ি থেকে নেমেই নির্জনতা ঘেরা রাস্তা দিয়ে, ভালো লাগাময় ক্লান্তি নিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছলাম ঘরে। অতঃপর রাতের খাবার খেয়েই ক্লান্তিদের হটাতে গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।

 

2 thoughts on “বৃষ্টিস্নাত সুন্দর দিনের দিনলিপি”

  1. বৃষ্টি ভেজা সুন্দর দিনের গল্প। ভাল্লাগলো খুব। মা শা আল্লাহ।

  2. সুন্দর লেখা, সাথে অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *