একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প
আফছানা খানম অথৈ
সজিব মাস্টার হাই স্কুল টিচার। স্কুল ছুটির পর ষ্টেশনে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ এক সত্তর বছরের বৃদ্ধা মাতা হাত বাড়িয়ে বলল,
বাবা আমারে কটা টাকা ভিক্ষা দিবে? আজ দুদিন ধরে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। দিবে বাবা কটা টাকা?
সজিব মাস্টার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আপন মনে বলে,
উনি ভিক্ষুক, অথচ কি সুন্দর শুদ্ধ বাংলা বললেন। মনে হয় শিক্ষিত, কারণ কি? উনি ভিক্ষা করছেন কেন? বিষয়টা জানা দরকার। সজিব মাস্টার বৃদ্ধা মহিলাটির কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলো,
মা আপনি ভিক্ষা করছেন কেন? আপনার ছেলে মেয়ে নেই?
বৃদ্ধা শ্রদ্ধাভাজন মা, লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
আমার স্বামী, ছেলে মেয়ে সবই ছিল, এখন কেউ নেই।
মা কি হয়েছে উনাদের?
তুমি শুনে কি করবা বাবা?
কিছু করতে না পারলে ও আসল সত্যটা জানা হবে।
বাবারে আজ দুদিন কিছু খাইনি। তাছাড়া শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না। কি করে বলবো এত লম্বা ইতিহাস।
ঠিক বলেছেন মা, চলুন আমার সঙ্গে?
তুমি আমার কে, যে আমি তোমার সঙ্গে যাব?
আমি আপনার ছেলে, আর আপনি আমার মা। মা ছেলের বাসায় যাবেন এতে দোষের কি আছে?চলুন মা আমার সঙ্গে। খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিবেন।তারপর আপনার লম্বা ইতিহাস শুনব।
এতদিন পর মা ডাক শুনে আনন্দে উনার বুক ভরে গেল। তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। সজিব মাস্টার বলল,
মা আপনি কাঁদছেন কেন?
বাবা কাঁদছি খুশিতে, এতদিন পরে তোমার মুখে মা ডাক শুনে খুশিতে আমার বুকটা ভরে গেল। আমার দুছেলে সাজ্জাত আর মঞ্জুর কথা মনে পড়ে গেল। তাই চোখে জল এসে গেল।
সজিব মাস্টার মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
মা আর কাঁদবেন না চলুন আমার সাথে।
তিনি আর অমত করলেন না। সজিব মাস্টারের সঙ্গে তার বাসায় গেলেন। সজিব মাস্টারের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো,
উনি কে গো?
উনি আমাদের দুজনের মা। উনি আজ থেকে আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
সত্যি বলছ তো?
হ্যাঁ সত্যি।
সজিব মাস্টার আর তার স্ত্রীর দুজনের মা বাবা জীবিত নেই। তাই সজীব মাস্টারের স্ত্রী একজন মা পেয়ে খুব খুশি হলেন। মাকে সাবান দিয়ে গোসল দিয়ে ভালো কাপড় পরালেন। তারপর স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে এক সঙ্গে বসে খানা খাওয়ালেন।এরপর সজীব মাস্টার মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার বলল,
আপনার মায়ের সিরিয়াস কোন অসুখ নেই। এটা শারীরিক দুর্বলতা। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি, এগুলো ঠিকমতো খাওয়ালে উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
সজিব মাস্টার মায়ের ঔষধ পথ্য কিনে বাড়ি ফিরে আসলেন। তারপর নিজের হাতে ঔষধ খাওয়ালেন। তারপর মাকে বললেন,
মা আপনার এখন কেমন লাগছে?
বাবা ভালো লাগছে। এবার শুনবি আমার ভিক্ষা করার লম্বা ইতিহাস?
হ্যাঁ মা শুনব বলুন,
বাবা দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে বলে,
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। উনার ডাকে সারা বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমিটি গঠন করে।
এরপর ১৬ই মার্চ থেকে ২৫ই মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আলোচনা করেন। সব আলোচনা ব্যর্থ করে দিয়ে ২৫ই মার্চের “কাল রাতে” পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙ্গালি জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অসংখ্য ছাত্র, পুলিশ, ইপিআর ও সাধারণ জনগন, নারী-পুরুষকে তারা হত্যা করে। এ “কাল রাতে”বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এর ভিত্তিতে ২৬ই মার্চ শুরু হয় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। সকল বাঙ্গালি একজোট হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। আমার দুছেলে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ত। বড় ছেলে সাজ্জাত মাস্টার্স আর ছোট ছেলে মঞ্জু অনার্স। তারাও থেমে থাকতে পারলো না। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলো। আমার স্বামী ছিল একজন স্কুল টিচার।আমি ও আমার স্বামী দুজন মিলে হাতে লিখে মুক্তি যুদ্ধের খবরা খবর বিভিন্ন জাগায় প্রচার করতাম।খুব সাবধানে, তবুও এ খবর থেমে থাকলো না। রাজাকার টুনু মোল্লার কাছে পৌছে গেল।জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়, তিনি মিলিটারী বাহিনী নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেন। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধের খবর আর কিছু খাবার বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে গেলাম। ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।
আমি ফিরে দেখি আমাদের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ছাই।
স্বামীর লাশ রক্তাক্ত পোড়া অবস্থায় পড়ে আছে।কি করবো ভয় ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে গর্ত করে স্বামীর লাশকে কোন রকমে মাটি চাপা দিলাম। তারপর গ্রামের বাড়ি ফিরে গেলাম। সেখানেও শান্তি নেই। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ।
সারা গ্রামের মানুষ ভয়ও আতঙ্কের মাঝে খুব কষ্টে দিনকাল যাপন করছে। চুপিচুপি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করি। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে লিখে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌছাতাম। মিলিটারিদের গোলাগুলি, জ্ব্বালাও পোড়াও, গনহারে মানুষ মারা দিনে দিনে বেড়ে উঠল।বাঙ্গালি জাতিও থেমে নেই। কখনো প্রতক্ষ্যভাবে কখনো পরোক্ষভাবে মিলিটারিদের সাথে মোকাবেলা করছে। নভেম্বরের শেষ দিকে গোপনসুত্রে জানতে পারলাম মিলিটারি বাহিনী বরাল নদীর পাড়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প আক্রমন করবে খবর নিয়ে ছুটে গেলাম তাদের কাছে। তাদেরকে সতর্ক সংকেত দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে একি দেখলাম। রাজাকার খালেক মোল্লাসহ মিলিটারি বাহিনী আমাকে মারতে এসেছিল। আমাকে না পেয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে এ গ্রাম থেকে পালিয়ে অন্যগ্রামে গেলাম। এভাবে আজ এখানে কাল ওখানে ভয় ও শংকার মাঝে দিন কাটতে লাগলো।তবুও থেমে থেকেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতাম।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু আমার দু-ছেলে ফিরে এলো না। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলো। তারপর বঙ্গুবন্ধু দেশে ফিরে এলেন।আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরে গেলাম। কোনমতে মাথা গুজবার জন্য ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে নিলাম।কোনমতে অভাব অনটনের মাঝে কেটে যাচ্ছে দিনকাল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে শুরু হলো আরেক যুদ্ধ, এ যুদ্ধ বিজাতীদের সাথে নয়। সরাসরি স্বাধীনতার অগ্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। কোন কারণ ছাড়া রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেন তার পরিবারকে। তারপর এক তরফা গুলাগুলির মাধ্যমে নিহত হলো বঙ্গবন্ধুর পরিবার। সেদিন ছিল ১৫ই আগস্ট। এরপর আবার মুক্তিযোদ্ধাদের উপর চলে নির্যাতন। তারপর আমাদের গ্রামের রাজাকারের নেতা খালেক মোল্লা আমার বাড়ি এসে হুমকি দিয়ে বলে,
এই বুড়ি দেশতো স্বাধীন করলি কি পেলি?বলেছিলাম আমাদের দলে যোগ দিতে। কিন্তু কথা শুনলি না। এই বুড়ি বাড়ি ছেড়ে চলে যা, তানা হলে স্বামী ছেলের মতো মারা পড়বি।
তারপর থেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম।আজ এখানে কাল ওখানে ঘুরে বেড়াই।
এত বছর পর আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসল। মুক্তিযোদ্ধা কমিটি গঠন করা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করা শুরু হলো।
কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্যি কথা বলতে হয়, এখন ও আমাদের নাম তালিকায় পড়েনি। এই হলো আমার ভিক্ষা করার ইতিহাস।
সজিব মাস্টার আর দেরী করলো না। একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে শ্রদ্ধাভাজন মুক্তিযোদ্ধা মাতার করুণ ইতিহাস তুলে ধরলেন।খবরটা প্রচার হতে আর দেরী হলো না। দেশবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা কমিটির চোখে পড়লো।তাৎক্ষণিকভাবে তারা সজিব মাস্টারের বাড়িতে ছুটে আসল। তারপর তারা বলল,
মা আমরা আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থি। আমরা বিরাট ভুল করেছি। আপনার মতো একজন আসল মুক্তিযোদ্ধাকে এখনো নতিভুক্ত করতে পারেনি। আর কোন ভুল নয়। আজ থেকে আসল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনাকে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে।
মুক্তিযোদ্ধা কমিটি আর দেরী করলো না। লায়লা আফরোজ তার স্বামী হাসান মাস্টার তার দুই ছেলে সাজ্জাত ও মঞ্জু সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নতিভুক্ত করলেন। লায়লা আফরোজকে আসল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সকল সুযোগ সুবিধা দিলেন। কিন্তু লায়লা আফরোজ সজিব মাস্টারকে ছেড়ে গেলেন না। আর সজিব মাস্টার ও মাকে যেতে দিলেন না। দুজনের মাঝে মা ছেলের সম্পর্ক গড়ে উঠল। মাঝে বছর দুয়েক পার হলো। লায়লা আফরোজ বার্ধক্য জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সজিব মাস্টার মাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা কমিটির লোকজন ছুটে এসে উনার চিকিৎসা সেবাযত্নে ব্যস্ত হয়ে উঠল। লায়লা আফরোজ বললেন,
বাবারা আমার সময় শেষ, বয়সতো আর কম হলো না। আর কত বাঁচবো। হায়াত মউত সবই আল্লাহপাকের ঈশারায় ঘটে। এতে ডাক্তার কবিরাজ কারো হাত নেই। আমি গর্বিত বাঙ্গালি জাতি হয়ে,গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে। শেষ মুহূর্তে হলেও “একজন আসল মুক্তিযোদ্ধা” হিসেবে নিজের নামটি নতিভুক্ত করতে পেরেছি বলে। মাননীয়া প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্যালুট মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার জন্য।
তিনি আর দেরী করলেন না। মনে হয় এই কথাগুলো বলার জন্য অপেক্ষা করলেন। তার দুচোখ বন্ধ হয়ে গেল। সজিব মাস্টার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে উনাকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে সমাধিস্থ করা হলো।
Pingback: স্বাধীন বাংলাদেশ সংখ্যা | ২৬+ স্বাধীনতা দিবসের কবিতা » Chirkute Sahitto