গল্প প্রশান্তির খোঁজে লেখিকা আমাতুল্লাহ খাদিজা খুশি

গল্প প্রশান্তির খোঁজে, লেখিকা আমাতুল্লাহ খাদিজা খুশি

 

অন্ধকার রাত, আকাশে তাঁরারা মিটিমিটি আলো দিচ্ছে। চাঁদের হালকাতম কিরণ এসে পরছে মুখের উপর।
__আচ্ছা এইযে চাঁদ, এইযে তাঁরা এদের কি কোন দুঃখ কষ্ট নেই? এরা কি সবসময় প্রজ্বলিত থাকে? তাহলে আমি যদি চাঁদ তাঁরা হতাম আমার মনেও হয়তো কোন দুঃখ কষ্ট থাকতো না।
এক নির্ঘুম রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।
কিন্তু কোন ভাবনার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনের মধ্যে আরো একটি ভাবনা বিরাজমান ছিলো,,
_সে আমাকে কিভাবে ঠকাতে পারলো? কিভাবে এত কষ্ট দিতে পারলো? তার মনে কি আমার জন্য একটুও দয়া হলো না? রিলেশনসীপটা ব্রেকআপ করার আগে সে কি একবারো ভাবলো না যে, এত কষ্ট আমি কিভাবে সহ্য করতে পারবো? আচ্ছা সে কি তাহলে আমার সাথে প্রেম নামের ছলনা করেছে। কেন করেছে কেন ? নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে আসছে, চোখ থেকে শ্রাবনের মতো পানি ঝরছে। চলে যাওয়ার আগে একবার তো বলে যেতে পারতো আমার অপরাধটা কি ছিলো? কি ছিলো আমার দোষ?

 

মনের মধ্যে নানা ভাবনা কড়াঘাত করছে। আজ সাব্বিরের সাথে সেই ২ বছরের পুরনো রিলেশনসীপ ব্রেকআপ হওয়ার পর থেকে কোন কিছুতেই যেন আমি শান্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। না পারছি খেতে, না পারছি ঠিকমত ঘুমাতে? কি করবো আমি?
সবকিছুই যেন অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। রবের ইবাদতেও মন বসেনা। কি করবো আমি? সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।
আজ যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে “ইয়া রব্ব! আমার মনে প্রশান্তি এনে দাও”।

রাত অনেক হয়েছে। সবকিছুর ভাবনা ঠেলে বিছানায় এসে শুয়ে পরলাম। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখলাম তাহাজ্জুদ সালাতের সময় চলছে এখন। কিন্তু সালাত আদায় করার বিন্দুমাত্র রেশ আমার মনের মধ্যে নেই। সাব্বিরের সাথে সাথে আমার রব্বে কারিমও যেন পর হয়ে যাচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে? ইচ্ছা থাকা সত্বেও কেন সালাতে দাঁড়াতে পারছিনা?
কথায় আছে, ‘হারামে আরাম নেই’।

 

খুব কষ্ট করে কোন রকমে রাতটুকু পার করলাম। দু চোখে ঘুম নেই। ঘুমও যেন আমায় পর করে দিয়েছে। পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ধ্বনিত হচ্ছে। আজানের জবাবটাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা। রবের এতটা অবাধ্য হতে পারে কোন মানুষ?
ফজরের সালাতেও আর দাঁড়ানো হলোনা। নির্ঘুম একটা রাত পার করলাম। সকালে উঠে কোন কিছুতেই মন বসছিল না। খুব ইচ্ছা করছিলো সাব্বিরের দুটো পা জড়িয়ে ধরে বলতে প্লীজ আমাকে এভাবে পর করে দিয়োনা? কেন জানিনা নিজেকে সামলে রাখতে পারছিনা, খুব কষ্ট হচ্ছে। আজ যেন নির্বোধ, নির্বিকার হয়ে পাথরের মত হয়ে গেছি। দুনিয়ার সামান্য সুখ অর্জন করতে আমার রব্ব কেই পর করে দিয়েছি। যেই মানুষটা আমি প্রতিটা সেকেন্ডের জন্য রবের ইবাদতে মশগুল থাকতাম এক সেকেন্ডের জন্য হলেও রবের ইবাদত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতাম না। সেই মানুষটা আমি একটা দিন, একটা রাত পার করলাম রবের ইবাদত বিহীন। কি করে এত অবাধ্য হতে পারলাম ?
সকালে রীতিমত কলেজে গেলাম। কলেজেও মন বসছিলো না। কলেজ থেকে বেরিয়েই সাব্বিরকে একটা কল করলাম। যদিও সাব্বির আমাকে কল করতে নিষেধ করেছিলো, কিন্তু আমি পারিনি সেটা করতে। প্রথমত সাব্বির কয়েকবার ফোনটা কেটে দিলো, অনেকবার কল করাতে লাস্ট বার সে কলটা রিসিভড করলো। অনেক আকুতি মিনতি করে তাকে লাস্ট বারের জন্য দেখা করার কথা বললাম, সে রাজি হয়ে গেল দেখা করতে।

আরো পড়ুনঃ  নিম্নমধ্যবিত্ত কলমে মুসাইবা আলম হৃদিমা

বিকেলে সাব্বিরের সাথে দেখা করলাম। কোন কারন ছাড়াই সে আমাকে ঘৃনা করে। সে আমাকে জানিয়ে দেয়, আমাকে নাকি এখন তার ভালো লাগেনা। আমার থেকেও ভালো কাউকে পেয়ে গেছে ও। আমাকে আর ওর প্রয়োজন পড়বেনা।
আমি নিস্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছি। কিছু বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলছি। আমি জীবনের চেয়েও যাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসতাম সে আমাকে এভাবে ভালোবাসার মূল্য দিলো আজকে? আমি কখনো ভাবতেও পারিনি সবথেকে কাছের মানুষটা এভাবে আমাকে আঘাত করবে। কেন এরকম হলো? কান্না করতে করতে সাব্বিরের সামনে থেকে বাসায় চলে আসলাম। নিজের রুমে এসে ভিতর থেকে দরজা লক করে মন ভরে অনেক্ষন কান্না করলাম। কান্না করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। মাগরিবের সালাতও আদায় করলাম না। পুরাই রবের অবাধ্য হয়ে গেছি। এশার সালাতের খানিক পরেই ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লাম। যদিও ঘুম আমায় পর করে দিয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও দু-চোখে ঘুম আনতে পারলাম না।

হঠাৎই মনের ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো। কোন পথে যাচ্ছি আমি ? আচ্ছা আমি না ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করি, রামাদ্বানে সিয়াম পালন করি, রবের প্রত্যেকটা হুকুমকে মেনে চলার চেষ্টা করি, তাও কেন হারাম রিলেশনসীপে আজ দু বছর ধরে পরে আছি?? হারাম রিলেশনের কারনেই কি আমি ইবাদত করেও মনে প্রশান্তি পাচ্ছিলাম না? সত্যি কথা বলতে আমি ইবাদত করতাম ঠিকি, কিন্তু কখনো সেই ইবাদতের স্বাদ অনুভব করতে পারিনি। মাঝে মাঝে ভাবতাম সাব্বিরকে ভুলে যাবো, কিন্তু তাকে এত পরিমান ভালোবেসেছিলাম ভুলতে পারিনি কখনো। আজ আমার সেই দিন এসেছে কোন কিছুতেই প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছিনা। কতদিন থেকে রবের অবাধ্যতা করে যাচ্ছি দিনের পর দিন। আমার রব্ব হয়তো চাচ্ছেন আমি তার কাছে ফিরি? এখনই তো সময় প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার। সত্যি কথা বলতে আজ বুঝতে পারলাম রবের থেকে দুনিয়ার মানুষকে বেশি প্রাধান্য দিলে বিনিময়ে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবেনা। পরিশেষে রবই যে আপন হয়, এটা আমরা বুঝতে পারি ঠিকি, কিন্তু তা অনেক দেড়িতে। দুনিয়ার সব ভালোবাসায় ধোকা আছে, কষ্ট আছে, শুধুমাত্র রব্বে কারিমকে যে কেউ একবার ভালোবেসে ফেলবে সে কখনো ধোকায় পরবেনা। রবকে হারানোর ভয় ও থাকবেনা।

আরো পড়ুনঃ  বৈশাখী বাফেট

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎ বলতেই পারিনা।
চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঝি পোকাদের ঝিঝি আওয়াজ ছাড়া কোন প্রানীর কোন শব্দ নেই। এমন সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ৩ টার কাছাকাছি বাজে, তাহাজ্জুদের সময়। এমন সময় রাতের ভাবনাকৃত কথাগুলো মনে পড়লে চোখ থেকে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। অহেতুক সময় নষ্ট না করে, ওজু করে এসে তাহাজ্জুদ সালাতে দাঁড়িয়ে গেলাম।

কেন যানিনা আজ রবের সামনে দাঁড়াতে নিজের কাছেই নিজেকে খুব লজ্জাবোধ মনে হচ্ছে। কতগুলা দিন পার করেছি রবের অবাধ্যতায়, হারাম রিলেশনসীপে জড়িয়ে থেকে কতই না আমলনামা ভরপুর করেছি। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম সেই হাদিসটার কথা।

‘আদমসন্তানের ওপর ব্যভিচারের কিছু অংশ লিপিবদ্ধ হয়েছে সে অবশ্যই তার মধ্যে লিপ্ত হবে। দুই চক্ষুর ব্যভিচার হলো দৃষ্টি এবং তার দুই কানের ব্যভিচার শ্রবণ, মুখের ব্যভিচার হলো কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হলো স্পর্শ করা ও পায়ের ব্যভিচার হলো পদক্ষেপ আর অন্তরে ব্যভিচারের আশা ও ইচ্ছার সঞ্চার হয়, অবশেষে লজ্জাস্থান একে সত্যে অথবা মিথ্যায় পরিণত করে।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৮০২)

জানা সত্ত্বেও তেমন গুরুত্ব দেইনি।
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম । একে অপরের সঙ্গে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই ইসলামে নিষিদ্ধ।

এসব রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ।
সিজদানবত অবস্থায় অঝোরে রবের দরবারে চোখের পানি ফেললাম,,, বার বার ভাবছিলাম এত এত গুনাহ করার পর রব্ব কি আমায় ক্ষমা করবেন? কিন্তু তবুও আমি রবের দরবারে দোয়া করতে ভুললাম না,,, প্রান খুলে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিলাম। আমার মনে হচ্ছে রব্বে কারীম যেন আমাকে ক্ষমা করার জন্য অধীর আগ্রহে আছেন,, শুধু আমার ফিরে আসার অপেক্ষা। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে আর ঘুমালাম না। খানিক কোরআন তেলাওয়াত করে ফজরের সালাত শেষ করলাম। সকালে রীতিমত নাস্তা করে কলেজের টাইম হলে কলেজে চলে গেলাম। আজও সাব্বিরের কথা মনে পরছে, কিন্তু তার জন্য কষ্ট হচ্ছেনা। কারন আমি রবের ইবাদতে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছি। আর যে একবার রব্বকে খুঁজে পাবে, দুনিয়াতে তার জন্য আর কিছুরই দরকার পড়েনা।
কলেজ শেষে বাসায় চলে আসলাম। আজ সারাদিন রবের ইবাদতেই কাটিয়েছি। নিয়ম করে সব ওয়াক্তের সালাত আদায় করে নিলাম।
রাতে এশার সালাতের কিছু পরে ঘুমোতে আসলাম। আজ সারাদিনটা যেন এক প্রশান্তিময় দিন কেটেছে।

আরো পড়ুনঃ  শিরোনামহীন অণুগল্প | তাবাসসুম রাফিয়া

আজ কেন যেন মনে হচ্ছে যে, যদি সাব্বিরের সাথে রিলেশনসীপে না জড়াতাম,, তাহলে হয়তো রবের ইবাদতে এই প্রশান্তি থেকে বঞ্চিত হতাম না। সাব্বিরের প্রতি মন থেকে কৃতজ্ঞতা চলে আসলো, ওকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছিলো। সে যদি আমাকে আজকে ধোকা না দিতো, যদি রিলেশন ব্রেকআপ না করতো, তাহলে হয়তো রব্বে কারীমের ইবাদতে যে প্রশান্তি লুকিয়ে ছিলো এতদিন, তা হয়তো খুঁজে পেতাম না। রবকে নিঁখুতভাবে চিনতে পারতাম না।

ইতিপূর্বে চোখে ঘুম ঘুম একটা ভাব চলে এসেছে। আর আমি মুখে বিড়বিড় আওয়াজে বললাম,,,,
“আল্লাহর স্বরনেই তো অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়”
(সুরা..রাদ, আয়াত : ২৮)

”সমাপ্ত”

 

নিয়মিত পড়ুন ও লেখুনঃ- দৈনিক চিরকুটে সাহিত্য 

2 thoughts on “গল্প প্রশান্তির খোঁজে লেখিকা আমাতুল্লাহ খাদিজা খুশি”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *