শরতের শুভ্রতায়

শরতের শুভ্রতায়
এম এ রাজ্জাক

কাশফুল দোলে হেসে
পাকে মিষ্টি তাল,
ভাদ্র আর আশ্বিন মিলে
বাংলায় শরৎকাল।

বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস মিলে শরৎকাল। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে শরৎ তৃতীয় ঋতু । শরতে বাংলার রূপ-প্রকৃতি অপরূপ। এ সময়ের আকাশ স্বচ্ছ, নির্মল থাকে। কখনোবা তাতে তুলো রঙের মেঘ ভাসে, তার ফাঁকে দিয়ে সূর্য্যিমামা মিটিমিটি করে হাসে। শরতে শিশিরের দূর্বাঘাসে সাতসকালে হাঁটতে মনে শিহরণ জাগে। শরতের নদীতে সাদা পালতোলা নৌকা তরতর বেগে ধেয়ে যায় এবং সকাল -বিকাল হালকা মৃদুমন্দ বাতাস বয়। এ-সময় যে কারোর নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সাথে কথা বলতে ভালো লাগে । শরতের প্রকৃতি স্নিগ্ধ, শান্ত -কোমল। আকাশ যেন টলমলে উদার । নদীর দুপাড়ে সাদাসাদা কাশফুল, নলখাগড়া, শর, উলা, বুন, বীথিকার দোলা মনে লাগে । শাদা বক, সারস, গাঙচিল সহ বিবিধ পাখপাখালি আকাশে উড়ে। কোথাও নদীর ধারে খুঁটিতে, বাঁধে রাখা নৌকায় উপর মাছরাঙা পাখি মাছ পেতে তাক করে প্রহর গুনে । ছোট ছোট নদীতে ডিঙি নৌকায় জেলেরা খেপলা জালের বিস্তরণ ছড়িয়ে দেয়। ভোরে বা সন্ধ্যায় কেউ নদীপাড়ে ছিপ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত মাছ মারতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে। পথচারীরা স্পোর্টস ড্রেসে দ্রুতপদে পথ চলে।

শরতে বিলে-ঝিলে শাপলা, কলমি,পদ্ম, কচুরিপানা, চৌকো, হেলেঞ্চা, সানচি, ধনচে সহ বিবিধ বর্ণের ঘাসফুল দেখা যায়। এসময় ডিঙি নৌকায় চড়ে শাপলা -পদ্ম ফুল ছিঁড়তে খুব ইচ্ছে করে। অনেকে মনের টানে বিলের হাঁটু পানিতেই খালি পায়ে কাদায় নেমে ফুল ছিঁড়ে । স্নানবেলায় ঝিলের শান্ত – স্নিগ্ধ নিটল জলে গোসল করতে মন চায়। সবুজ ধানের খেতের মৃদুমন্দ বাতাসে মন ভরে। সকালের দুর্বা ঘাসের উপর শিশিরের ফোঁটা যেন মুক্তাভা মনে হয়। সবুজ মাঠে সকাল-সন্ধ্যায় খালি পায়ে হাঁটতে মনের কোনে শিহরণ জাগে । গ্রাম -গঞ্জের চারদিক পাখীর ডাক, হাঁসের প্যাঁক-প্যাঁকানি, বিবিধ পাখির কিচির মিচির প্রকৃতি প্রেমিকদের মুগ্ধ করে।

আরো পড়ুনঃ  মন্তব্যের টুকরো পাথর

শরতের গ্রাম বাংলায় বাড়ির উঠোনে কিংবা বাগানে ফোটে শিউলি, জবা, বেলি, কামিনী, শেফালি, টগর, মালতী, হাসনাহেনা, দোলনচাঁপা, জারুল, রঙ্গন, মল্লিকা, মাধবী, জুঁই, কেয়া, নয়নতারা সহ কতো ফুল! শরতের আবহমান গ্রাম -বাংলায় পাওয়া যায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, বেগুন, তরই, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, কচু, কাঁচকলা, পেঁপে, ওল, মান, খামাকচু, শিম, পালংশাক, লেটুস, বরবটি, ঝিঙে, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম ইত্যাদি সবজি। এসময় তাল, আমড়া, কামরাঙা, পেয়ারা, ডালিম, আঙুর, কমলা, বাতাবিলেবু, জলপাই, পেঁপে, কদবেল ইত্যাদি ফল অনেক পাওয়া যায়। দেশের প্রায় সর্বত্রই লালশাক, সবুজ শাক, ধনেপাতা, মুলা শাক, পুইশাক, কচু শাক, কলমিশাক, শানচি শাক, সজনে শাক, কান্জাল, কলার মুচি, জগঢাল ইত্যাদি শাকের সমারোহ দেখা যায়। শরতে আবহমান গ্রাম বাংলায় নানি-দাদি বা মায়ের হাতের তালের বড়া, নারকেলের বড়া, তালের পিঠা, পায়েস, পাকানো পিঠা, তেলের পিঠা, ডিমের পিঠা, মুড়কি, মুড়ি, খৈ, খির, তিলের খাজা, খাস্তা, কটকটি, চমচম সহ রকমারি মিষ্টি পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলায় নতুন -পুরাতন জামাই -মেয়ের বাড়িতে মাটির রঙিন হাঁড়িতে খাগড়াই-সন্দেশ- পাকানো পিঠার সাজ দিয়ে আনা -নেওয়া করা হয়। নতুন -পুরাতন আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হয়। অনেক ধুমধাম ও আপ্যায়নের পরে বিশেষ করে জামাই -মেয়েকে নতুন জামা -কাপড় দেওয়া হয়।

পূজা উপলক্ষে গ্রাম -বাংলায় মেলা বসে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মেলায় যায়। এসময় গ্রামের বন্যাবিধৌত এলাকায় ঐতিহ্যবাহি নৌকা বাইচ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে নদী তীরবর্তী হাট-ঘাট- বাজারে মেলা বসে। মেলায় হরেক রকম জিনিসপত্র পাওয়া যায়। প্রকৃতিকে ভালোবেসে চির আবহমান গ্রাম বাংলায় শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নিতে, ঝিলের শাপলা – পদ্ম- কলমির ফুল পেতে, সবুজাভ মাঠের ক্ষেতের দোলা দেখতে এবং নানি-দাদির হাতের তাল-নারকেলের নাড়ু-বড়া-ক্ষির খেতে আমরা সবাই সবুজাভ গ্রাম বাংলায় ছুটে যাই। শরতের শুভ্রতায় নিজেকে, নিজের মনকে শুভ্র করে তুলি।

আরো পড়ুনঃ  ঈদের খুশি এবং বাস্তবতা | ঈদ নিয়ে প্রবন্ধ

লেখক : এম এ রাজ্জাক, সহকারী অধ্যাপক, কেশরহাট মহিলা কলেজ, রাজশাহী।
gmail : ab2000razzak@gmail. com
তারিখ : ২৯ আগষ্ট ২০২৩, রাজশাহী।

1 thought on “শরতের শুভ্রতায়”

  1. Pingback: কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য পুরস্কার -২০২৩ » Chirkute Sahitto

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *